খুঁজে ফিরি শৈশবে দেখা পূজা আর পূজারিদের
আমার বন্ধু মনোজ। জয়শ্রীর ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। ২০০৭ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে এই পৃথিবী থেকে তাঁকে চলে যেতে হয়। জয়শ্রী চৌধুরী বাড়ির ঠিক পাশেই তাঁদের বাড়ি। ছেলেবেলায় এই চৌধুরী বাড়িটি আমার কাছে সাক্ষাৎ ভুতুড়ে বাড়ি ছিল। খুবই দৈন্যদশা। ভাঙা দালান, দালানের গা ঘেঁষে নানা ধরনের গাছ জন্মেছিল। শুনেছি একসময় জয়শ্রী চৌধুরী বাড়ির বিরাট নামডাক ছিল। ওই তল্লাটে চৌধুরীরা নাকি হাতির পিঠে চড়ে জমি দেখতে যেতেন। চৌধুরী বাড়ির সামনেই ছিল বিরাট ধারাম হাওর। হাওরের দিকে তাকিয়ে আঙুল উঁচিয়ে চৌধুরীরা বাড়িতে আগত অতিথিদের বলতেন, আপনার দুই চোখে যত দূর স্পষ্ট দেখা যায় সবই আমাদের জায়গা জমি। তবে আমাদের ছেলেবেলায় চৌধুরীদের জৌলুশের ছিটেফোঁটাও আর ছিল না। তাদের অধিকাংশই জয়শ্রী ছেড়ে, দেশ ছেড়েও চলে গিয়েছিলেন বলে শুনেছি। এরপরেও জয়শ্রীর সর্বজনীন পূজাটি চৌধুরী বাড়ির সামনেই হতো। পূজার পুরো সময়টা হিন্দু-মুসলমান একাকার হয়ে যেত। মুসলমানদের জন্য আলাদা খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকত।
প্রতিমার জন্য বিশাল স্টেজ করা হতো। দেবীদুর্গা ও তাঁর সাথিদের খুব সুন্দর করে সাজানো হতো। ভাটি অঞ্চলে তখন ইলেকট্রিসিটি ছিল না। মণ্ডপ ও মণ্ডপের চারপাশ আলোকিত করতে অনেকগুলো হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হতো। এই লাইটের উজ্জ্বল সাদা আলোতে প্রত্যেক দেব-দেবীকে খুব জীবন্ত মনে হতো। দেবীদুর্গা দশ হাত মেলে সিংহের ওপরে আসীন হয়ে যেন সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। পৌরাণিক যুদ্ধদেবতা কার্তিককে মনে হতো যেন বীরদর্পে বসে আছেন, বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে মনে হতো শ্বেতপদ্মে বসা পদ্মলোচনা ও বীণা পুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তি। আর ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর হাসি যেন ঝলমল করে আছড়ে পড়ত পুরো এলাকা জুড়ে। গত ৩০ বছর ধরে দুর্গাপূজার নাম শুনলেই ছোটবেলায়
জয়শ্রীতে দেখে আসা এমন পূজা মণ্ডপের ছবিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনোজ বলেছিল—দেবীদুর্গা একজন বহুরূপী নারী। তিনি শক্তির দেবী, অসীম ক্ষমতাধর। তিনি দুর্গতি নাশ করেন বলে তাঁকে দুর্গা বলা হয়। আবার তিনি দুর্গম নামক অসুরকে নাশ করেছিলেন বলে তাঁর নাম দুর্গা। দুর্গার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ব্যূহ বা আবদ্ধ স্থান। বলা হয়ে থাকে, মানুষকে আবদ্ধ করে রাখা দুঃখ আর শোককে তিনি দূর করেন। আবার অনেক শাস্ত্রকারেরা মনে করেন দুঃখের দ্বারা যাকে লাভ করা যায় তিনিই দুর্গা। শরৎ আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে শারদীয়া দুর্গাপূজার বোধন ও অধিবাস হয় সেটার শেষ হয় সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী তিথিতে বিসর্জন দিয়ে। দেবীদুর্গার বাহন সিংহ। তবে তিনি আসতে পারেন তাঁর ইচ্ছেমতো যেকোনো বাহনে চড়ে। সেটি হতে পারে নৌকা কিংবা রথ। অথবা আধুনিক কোনো বাহন।
দুর্গাপূজায় ষষ্ঠীর দিন থেকে বিসর্জনের আগ পর্যন্ত জয়শ্রী একটা উৎসবের গ্রাম হয়ে যেত। আমার কাছে পূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল মণ্ডপে গানের পর্বগুলো। করুণাদা ছিল আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় গায়ক। ভাটির জয়শ্রীতে তাঁর মতো বড় গায়ক সেই সময় এবং পরবর্তীতে অনেক বছর কেউ ছিলেন না। শ্রাবণ মেঘের দিনের সেই বিখ্যাত মতি গায়কের মতো। চারদিকে এক নামে সবাই তাঁকে চিনত। করুণাদা একাই মাতিয়ে রাখতেন পূজামণ্ডপ। আমার মতো ছোট বালকের কাছে তিনিই ছিলেন তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গায়ক। সে সময় তাঁর গানগুলোর মর্মার্থ কিছু না বুঝলেও, পরবর্তীতে তাঁর গাওয়া বহুল প্রচলিত ভক্তিমূলক গানগুলো আমাকে বারবার শিহরিত করেছে। জয়শ্রীতে পূজার সময়ে দেখা ধূপ-ধুনার পাত্র নিয়ে নানান ভঙ্গিমার নাচ এখনো ভুলতে পারিনি। এখনো চোখে ভাসে কৃষ্ণ তিল, তুলসী করজোড়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে কত চেনা না চেনা মানুষ দেবীকে ভক্তিভরে প্রণাম করছে। অনেক প্রবীণকে দেখেছি যতবার দেবীর সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করছেন ততবার হাত কপালে তুলে প্রণামের ভঙ্গি করছেন। একবার দুইবার করে করে অনেককে পনেরো বিশবারও প্রণাম করতে দেখেছি।
জয়শ্রীর এই পূজায় দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনরাও আসতেন। অনেক নাইওরীও আসতেন। সন্ধ্যার পরে হিন্দু পাড়ার সকল তরুণী মেয়েদের পূজামণ্ডপে ঢল নামত। এই গ্রামে জন্মেছি, কিন্তু এদের অনেককেই আমি চিনতাম না। এদের বেশির ভাগের বয়স ছিল ১৮ বা ১৯। আমার বোনের বয়সী। আমার বোনের দু-একজন বান্ধবীও সেখানে থাকতেন। তারা আসতেন দল বেঁধে। দেবীর সামনে তাদের প্রণাম করার দৃশ্যটি হ্যাজাক বাতির আলোকিত আলোতে এতটাই মোহনীয় আর স্বর্গীয় ছিল যে, পূজা বলতে এখনো আমি আমার বালক বয়সে দেখা এমন মোহনীয়, এমন নিবেদিত প্রণামকেই বুঝি।
বিসর্জনের দিন একটা করুণ পরিবেশের সৃষ্টি হতো। শঙ্খের সুর আর উলুর হাহাকারে চারদিক কেমন যেন ভারী হয়ে উঠত। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন একদিন মনোজ জানিয়েছিল, এটাকে সে বিসর্জন মনে করে না, সে বিশ্বাস করে মা দুর্গা মর্ত্যলোকে বাপের বাড়ি থেকে কৈলাসে তাঁর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। আটপৌরে বাঙালি নারী যখন বাপের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য এসে আবার চলে যাওয়ার সময় আবেগে ডুকরে কেঁদে ওঠে, তেমনি দেবী আজ কাঁদবে। আর দেবী কাঁদবেন বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল নারী আর তাঁর ভক্তরা কেঁদে উঠবেন। ভক্তদের চোখের জল, কান্না, সিঁদুরের লাল রং সব রেখে তিনি চলে যাবেন ১১ মাস ২৬ দিনের জন্য। বিদায়ের এই ক্ষণে অন্য এক মাত্রা দিত বৃষ্টি। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হতো। সারাদিন। দুর্গা দেবীকে বিসর্জন দেবে বলে মনের দুঃখে আকাশও যেন ক্রন্দসী। ঝিরিঝিরি এই বৃষ্টির সঙ্গে পূজা যেন একই সুতোয় বাঁধা। ২০০৩ সালে সিলেট ছেড়ে প্রবাসে আসার আগ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দশমীতেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি হতে দেখেছি। আবার, শুভ মহালয়া থেকে বিসর্জন পর্যন্ত—কখনো একদিন, কখনো দুদিন কখনোবা পুরো সময়টিই টিপ টিপ বৃষ্টি হতো। সেই বৃষ্টির মধ্যে দেবীকে নৌকার গলুইয়ে বসিয়ে, ঢাকঢোল করতাল বাজিয়ে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। দেবীদুর্গার প্রস্থানের দিন প্রকৃতির এমন বিমর্ষ রূপের কথা মনে হলেই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
আজ প্রায় ১৪ বছর ধরে প্রবাসী। দুর্গা পূজার সেই রং ও রূপ এখন আর মনে করতে পারি না। অনেক কিছুর ভিড়ে আস্তে আস্তে ফিকে হতে হতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতিগুলো। এর পরেও সুযোগ পেলেই পূজা দেখতে যাই। খুঁজে ফিরি শৈশবে ফেলে আসা সময়গুলো।
Related Articles
প্রিয় ছাত্রলীগ এবার থামো!
ফজলুল বারী: কয়েকদিন ধরে মনটা বেশ খারাপ। প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কিছু নেতার বক্তৃতা-বিবৃতির ভাষায় বাংলাদেশ বিরোধী শক্তির বিরোধিতা উধাও!
21st Century “Kunta Kinte”! Chapter 8: Life Goes on…
21st Century “Kunta Kinte”! Introduction: Revealing the “untold”! | Chapter 1: The realisation! | Chapter 2 : The beginning! |
অস্ট্রেলিয়ার হ্যালোইন সম্প্রীতি
হ্যালোইনের উৎস বা ইতিহাস কি সেই বিষয়ে আমার ধারণা খুবই কম তবে অস্ট্রেলিয়াতে যেভাবে হ্যালোইন পালন করা হয় সেটাকে আমার