অসম্পূর্ণ সকাল

অসম্পূর্ণ সকাল

সকালের চাক ভাঙ্গা রোদ গায়ে মাখতে বেলকুনিতে দাঁড়ালাম। সচরাচর এই সময়টায় আমি বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে চায়ের সাথে প্রকৃতি পান করি। আমার হাতে ধরা রং চা থেকে বাঁক খাওয়া ধোঁয়া নাক স্পর্শ করে বিলীন হয়ে যায়। আমি গরম চা খেতে পারি না, অতীত অভিজ্ঞতায় জিহ্বামুখ পুড়িয়েছি বহুবার। এই ভয় থেকে চায়ে বার কয়েকবার ফু দিয়েও মুখে নেওয়ার সাহস করতে পারছি না। আমার চোখ আটকে গেল সামনের ছাদ ছাড়িয়ে জলপাই গাছটার দিকে। ঢাকার ভিতর এতটা বিশাল সাইজের জলপাই গাছ থাকতে পারে আমার ধারনা ছিল না। ঐ জলপাই গাছের পাতানো ডালে একটা দোয়েল চুপচাপ বসে আছে। একটু পরপর পা নিয়ে মাথা ঘষে যাচ্ছে। একটু দূরে অনবরত লেজ নাড়িয়ে যায় আরেকটা শান্ত দোয়েল। সম্ভবত এটাই পুরুষ দোয়েল, স্ত্রী দোয়েলের মনোযোগ চেষ্টায় নিমগ্ন। জগতের সকল পুরুষ জাতি স্ত্রীদের মনোযোগের নেশায় যেমন মত্ত থাকে। হয়তো এটা না থাকলে প্রাণিদের বিলুপ্তি ঘটে যেত অনেক আগেই।

আমি চুমুক দিয়ে দেখলাম চা ঠান্ডা পানি। আমি ঠান্ডা চায়ে দ্বিতীয়বার চুমুক দিলাম, খেতে খারাপ লাগছে না। সকালের প্রকৃতি আমাকে বিমুগ্ধ করে রেখেছে। এরই মধ্যে স্ত্রী পাখির মন গলেছে, দোয়েল যুগল ইতোমধ্যে ঠোঁট ঘষাঘষি করছে। লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে।

জলপাই গাছ পেরুলে বরাবর বারান্দায় কালো কি যেন উড়ছে। আমি ভাল করে চেয়ে দেখলাম, কালো জিনিসটা আসলে কোন মেয়ের চুল। সকাল সকাল স্নান সেড়ে লম্বা কৃষ্ণচুল রোদে শুকাচ্ছে। এত ঘন ইরল বিরল চুলে রোদ পড়ে চিকচিক করছে। অকাসাৎ এই চিকচিক করা কালো চুল মনের রেখা ছুঁয়ে যায়। আমি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি চা কাপ হাতে। দূরের কাকের কা কা শব্দে মেয়েটা মাথা তুলে তাকায়। তার দৃষ্টি ঘোলাটে, মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে চক্ষুযুগল ঢাকা পড়েছে। আমি দৌঁড়ে গিয়ে বাইনোকুলারটা হাতে নিলাম। চোখে নিয়ে তুলে ধরতেই মেয়েটা দৌঁড়ে পালালো। আমি জানলাম, মেয়েদের অবশ্যই তৃতীয় আরেকটা নয়ন থাকে।

ঐদিনই ছিল নতুন বাসায় আমার প্রথম সকাল। এরপর পালা করে ঠিক ঐ সময়টাতে চায়ের কাপ হাতে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে যাই। গলায় ঝুলতে থাকে বাইনোকুলার। তবে মেয়েটা প্রথম দিনের মত চুল খোলে বসে না। কখনো তোয়াল শুকাতে দিতে আসে বারান্দায়, কোনো কোনো দিন বই হাতে বাহানা করে আমার বরাবর তুলে ধরে। আমি অনুমান করতে পারি, মেয়েটার বয়স বিশ কিম্বা একুশ। লম্বা লিকলিকে ফর্সা মেয়েটার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা একদম বেমানান। তারপরও কেমন যেন দেখতে ভাল লাগে, দেখে মন আলতো করে ছুঁয়ে যায়। চা শেষ হবার পরও আমি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে থাকার ফলাফল, অফিসে রোজ দেরি। অফিসের কাজেকর্মে মন পাই না। উল্টো সব কিছুতে হাসি পায়। লোকে বলে, এ ভীমরতির নাম প্রেম। মনুষ্য প্রেমের দাস। আমি বাসায় ফিরি সন্ধ্যার পর। ততক্ষণে নেমে আসে অন্ধকার। ওদের বারান্দায়, আমার মনে।

ইদানিং আমি শুভ্র সকালের জন্য প্রার্থনা করি, আবার ছটফটও করি। ভোর হতে বাইনোকুলার চোখে ধরে রাখি। বিনা কারণে বেলকুনিতে পায়চারী করি। যেন মেয়েটাকে না দেখা পযর্ন্ত অস্থিরতা বাড়ে। কী মুশকিল, এ মেয়ের নাম ধামও যে আমি এখনো জানি না।

গত দু’দিন সকাল সন্ধ্যা তেড়ে আসা বৃষ্টিতে দেহমন বিষন্ন। বৃষ্টির তোড়জোড়ে বেলকুনিতে দাঁড়ানো যায় না, মুহূর্তেই ভিজে চুপসে যেতে হয়। অথচ মেয়েটিকে দেখার জন্য মন সারাক্ষণ খা খা করে। ব্যাপারটা কেমন যেন অভ্যাসে পরিনত হয়ে উঠেছিল। অথচ মেয়েটির বারান্দা দরজা সেই বন্ধই আছে। আমি মুখ ভার করে অফিসে চলে যাই, সেই একই মুখ নিয়ে বাসায় ফিরি।

বৃষ্টি থেমেছে আজ তিনদিন। অথচ ঐ মেয়েটির দেখা নেই। বারান্দার দরজা জানালা বন্ধ তো বন্ধই। মাথার ভিতর আজেবাজে চিন্তারা ভিড় জমায়। আমার অস্থিরতা বাড়ে। সিদ্ধান্ত নিই এখনই মেয়েটির বাসায় যাব।

পরপর কলিং বেল দেয়ার অনেকক্ষণ পর এক বৃদ্ধ দরজা খুলে দিল। আমি কোনো ভনিতা না করেই জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের বাসার মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া মেয়েটা কোথায়? বৃদ্ধ লোকটা একটু সময় নিয়ে আমাকে দেখে নিল। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে। ভাঙ্গা গলায় আমাকে বলল, তুমি কে? তোমাকে তো ঠিক চিনি না।

আমি আশ্বস্ত করে বললাম, আমি পাশের বাসায় থাকি। কিন্তু মেয়েটা কোথায়?

বৃদ্ধ খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, আমি সাথীর দূর সম্পর্কীয় চাচা। সাথী তো নেই। গত ৫ দিন আগে শাহবাগ মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। চোখে একটু কম দেখত মেয়েটা, আহ সেটাই কাল হয়েছে। রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাস এসে চাপা দিয়ে চলে গেছে, সাথে সাথে স্পস্ট ডেড। কেন, খবরে দেখো নি?

লোকটা এত স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলছিল বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ল, আমি তো পেপারে খবরটা পড়েছি, মেয়ের নাম সাথীই ছিল। মুহূর্তে আমার বুকে ব্যাথা শুরু হল, মাথা শূন্য হয়ে গেল। আমি পড়ে গেলাম। এর পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।

আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অনেকদিন লেগেছিল প্রায়। আর কোনদিন ঐ বাসায় যাওয়া হয় নি আমার। হয় নি বাইনোকুলার হাতে নেয়া, ওটাতে এখন ধূলো জমে গেছে। এরপর আর কখনো চা কাপ হাতে দাঁড়ানো হয় নি বেলকুনির দোয়েল ডাকা রোদে।

আমি এখনো রাস্তায় মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া কোনো মেয়েকে দেখলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ভাবি, এই বুঝি এসে বলবে, তোমাকে অনেকদিন বেলকুনিতে চা খেতে দেখি নাহ। আসো না কেন? আমি তো রোজ সকালে চুল ছড়িয়ে বসি তোমার জন্য।

শুনে আমার ঠোঁটের কোণে হাসি, চোখের কোণে নোনাজল, খেলা করে যায় একসাথে।


Place your ads here!

Related Articles

‘She is Not a Duchess’ by Abu Sufian

Here in the closet, this picture evokes attention Of many who come to my house; Not mine actually–a gift from

সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের পথে

সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে “একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা” অর্জনের পথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা গত শনিবার ৩রা সেপ্টেম্বর সিডনির বিশেষ পর্যটনকেন্দ্র খ্যাত

সুইসাইড প্রতিরোধে গনসচেতনতার প্রয়োজন

বেশ কয়েক মাস আগে কেনবেরাতে এক বাংলাদেশী সুইসাইড করেছিল। সেই সুইসাইডের পরপরই কেনবেরাতে বাংলাদেশের কয়েকজন লোক মিলে ‘সুইসাইডের কারন ও

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment