আবহমান বাংলার নববর্ষ সারা পৃথিবীতে

আবহমান বাংলার নববর্ষ সারা পৃথিবীতে

একদিকে সময় ও তার বিবর্তন যেমন মানুষকে করে তুলেছে প্রকৃতিমুখী, ঠিক তেমনি এমন প্রকৃতি চিন্তাও তার পরবর্তী লোকাচার মানুষকে দিয়েছে সংস্কৃতি ও দেশ। তাই নববর্ষ চিন্তা চেতনা প্রকৃতি থেকে উত্সারিত নতুন অভিজ্ঞান। আমি নিজে এই চেতনার সঙ্গী; শীতের কুয়াশায় আকাশের মেঘে; বর্ষণের জলধারায় আমি ভেতরে অনুভব করি ঋতু ও তার রূপান্তর। যেহেতু গ্রামে থাকি বেশি, এই প্রকৃতির রূপান্তর খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে, অনুভব করি তার ছায়া। মনে হয়, এই বর্ষ চেতনা যেন প্রতিবছর আমাদেরকে নতুন জীবন দান করে। নববর্ষকে নিয়ে যে জাগরণ এসেছে তা মানুষকে আবার গ্রামমুখী ও শস্যমুখী করলে তা দেশের জন্য মঙ্গল। শহরের মানুষরা একসময় গ্রামে ছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এসে তারা ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি করেছিলেন। পরে তাদের সন্তানরা আর বেশি গ্রামের দিকে ফিরে তাকাননি। বরং গ্রামের সংস্কৃতিকে শহুরে রূপ দিয়ে চলেছেন। এক জগাখিচুড়ি সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন। অনেকে বলেন, এই নববর্ষ এক ধরনের নতুন আবিষ্কার, তাও এত প্রাচীন নয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও সময় চেতনার নিরিখে দেখলে উপলব্ধিতে আসে যে নববর্ষের চেতনা আসলে অনেক প্রাচীন। শহরে ভুভুজোলা বাজিয়ে এটাকে বিকৃত না করে বরং শহরে করা যেতে পারে ঢেঁকি ও শস্য উত্সব, প্রাচীন পালাগানের উত্সব ও পীর-মুর্শিদী প্রভৃতি গানের উত্সব। নববর্ষ উদযাপন চাইলে আমরা আরো গভীর শুদ্ধ করতে পারি। আরো বেশি ইতিহাস সচেতন, সত্য ও একনিষ্ঠ করতে পারি, নববর্ষের অনুষ্ঠানগুলো আমরা গ্রামে গিয়ে খোলা প্রান্তরে পালন করতে পারি।

পৃথিবীতে এমন এক সময় ছিল যখন মানুষের সময় সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না। মানব মননে ছিল না দিন, মাস কিংবা বছর নিয়ে চিন্তা, তখনো সময়কে ভাগ করতে শিখেনি মানুষ। সময় তখন ছিল অবিভক্ত ও সীমাহীন। মানুষ তারপর দেখতে ও চিনতে শিখলো ঋতুর আনাগোনা, ফসলের অভ্যাস কিংবা আকাশে তারার বিন্যাস। প্রাচীন মিশরীয়রা দেখলো আকাশে একটা তারা এলে তার কিছুদিন পরে নীল নদে আসে বন্যা। তখন তারা সেই তারার সাথে ঋতুর ও আবহাওয়ার একটা কার্যকারণ খুঁজে পেল। সেই তারার প্রাচীন উপমহাদেশীয় নাম বিশাখা, আর সেই নাম থেকে এসেছে শৈখা।

পহেলা বৈশাখের ইতিহাস তাই অনেক পুরোনো। তারাদের নাম, প্রাচীন ঈশ্বরদের নাম তাই লেগে আছে ঋতু ও সময়ের গায়ে যদিও বর্ষ উদযাপন হয়ে উঠেছে মানবিক। ধর্ম ও বর্ণ, গোত্র ভাষাকে উপচে মানুষের সময় চিন্তা ও সময়কে ঘিরে জীবনের উদযাপন। পরবর্তীতে মানুষ সময়কে ভাগ করেছে বছরে, মাসে ও দিনে। নিয়ে এসেছে শুরু ও শেষের চিন্তা। তাতে মিলিয়েছে জীবনের শুরু ও শেষের চিন্তা, স্মৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি সব এই বাত্সরিক সময় চিন্তা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আসছে সেই প্রাচীন অথচ নবীন পহেলা বৈশাখ। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে তাকে বরণের প্রস্তুতি। মূলত গ্রামে আমার বাস। আমি দেখতে পাই এ বৈশাখকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, দেশ ও সংস্কৃতিকে নতুন করে পাওয়ার আয়োজন। এতো সর্বজনীন কোন উত্সব আর খুব বেশি চোখে পড়ে না। শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ সবাই মেতে উঠে এই আয়োজনে। আগামীতে যে প্রকৃতি পাগল সংস্কৃতি-সমাজ আমরা নির্মাণ করতে যাচ্ছি তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই বর্ষবরণের উত্সাহে।

প্রবাসী বাঙালিরাও এ উদ্যোগে মেতে ওঠেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অলিম্পিক পার্কে জমে উঠে বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে নববর্ষের এই আমেজ ছড়িয়ে যায় সারা পৃথিবীতে। থাইল্যান্ড, লাওস প্রভৃতি এশীয় দেশে একই সময়ে উদযাপিত হয় নববর্ষ। এই বর্ষবরণ, এই সময় চিন্তা একদিক দিয়ে আমাদের আবার তা সারা পৃথিবীরও। একদা প্রাচীন মিশরীয়দের মনে যে চিন্তা কুঁড়ি মেলেছিল তা এখন বিশাল মহীরুহ হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। নববর্ষ তাই আবহমান বাংলার ও সারা পৃথিবীর।

Abed Chaudhury

Abed Chaudhury

আবেদ চৌধুরী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি জিনবিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক এবং কবি। তিনি ক্যানবেরা শহরে বসবাস করেন। আবেদ চৌধুরী আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রথম সারির গবেষকদের একজন। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে, যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন স্টেট ইনস্টিটিউট অব মলিক্যুলার বায়োলজি এবং ওয়াশিংটনের ফ্রেড হাচিনসন ক্যানসার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। ১৯৮৩ সালে পিএইচডি গবেষণাকালে তিনি রেকডি নামক জেনেটিক রিকম্বিনেশনের একটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন, যা নিয়ে সে সময় আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যাপক গবেষণা হয়। তিনি অযৌন বীজ উৎপাদন-সংক্রান্ত (এফআইএস) তিনটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন, যার মাধ্যমে এই জিনবিশিষ্ট মিউটেন্ট নিষেক ছাড়াই আংশিক বীজ উৎপাদনে সক্ষম হয়। তাঁর এই আবিষ্কার অ্যাপোমিক্সিসের সূচনা করেছে, যার মাধ্যমে পিতৃবিহীন বীজ উৎপাদন সম্ভব হয়। ১৯৯১ সালে তিনি শৈবাল ও অন্তরীক্ষ নামে কবিতার বই লেখেন।


Place your ads here!

Related Articles

Bangladesh Politics: All evil guided BDRs ! Hunt them!! Hang them!!!

There is no excuse why these evil guided BDRs. will not be hunted and given due punishment. They have not

নববর্ষে প্রবাসে বাঙালির নবজাগরণের উৎসব

বাংলা নববর্ষের আবাহনে মেতে উঠেছেন প্রবাসী বাঙ্গালীরা, উৎসব আয়োজনে মতোয়ারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। বাঙালির জীবনে এ উৎসব আনন্দ

ক্রিকেটবোর্ডকে লেখা খোলা চিঠি

[এই লেখাটা ক্রিকেট নিয়ে। লেখাটা প্রথম যেদিন লিখি, মনে আছে, লিখতে লিখতে কেঁদে ফেলেছিলাম। আজ লেখাটা আবার পড়ছি, কাঁদছি, কাঁদতে

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment