প্রকৃতভাবে স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় চাই
শিক্ষার মান ও শিক্ষকের মর্যাদা বর্তমানে দেশের সবখানে আলোচিত একটি বিষয়। সবার বক্তব্য শিক্ষার মান কমছে। আর শিক্ষকদের দাবী শিক্ষকদেও মর্যাদা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না । সরকার শিক্ষার মান অবনতির এবিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে। তবে সরকারের মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী একটি মন্তব্য আমার নজরে এসেছে। তিনি শিক্ষার মান উন্নয়নে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে পরামর্শ দিয়েছেন। মাননীয় মন্ত্রী সত্য স্বীকারকে করেছেন। সেজন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। তবে বিনয়ের সাথে বলতে চাই গুড়ো দুধ বা গমের মত পণ্য আমদানি করে শরীরে পুষ্টিহীনতা দূর করা যাবে হয়তো যদি না সেগুলি পঁচা হয়। তবে মনের পুষ্টি সাধনে বিদেশী শিক্ষক দিয়ে বিদ্যাদানের ব্যবস্থা নিলে যে ভাল মানুষ হবে সে গ্যারান্টি কোথায়? আমার মত অনেকেই একমত হবেন দেশে এখনও ভাল শিক্ষক আছেন যারা সুযোগ পেলে বদলে দিতে পারেন সবকিছু। তাঁদের আগে উপযুক্ত সম্মান ও সুযোগ দিতে হবে। যখন সেটি ব্যর্থ হবে তখন না হয় শিক্ষক আমদানির কথা ভাবা যাবে।
শিক্ষার মান কমেছে দাবী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভর্তি পরীক্ষা ফলাফল পর্যালোচনা করেছেন। শিক্ষার মান একাবিংশ শতাব্দীর পর্যায়ে নিতে সরকার নানা ট্রেনিং কার্যক্রম গ্রহন করেছেন। উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকার ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মেজবাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্পর কাজ চলছে। তবুও কোথাও যেন একটি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সেই শুন্যতা বা ফাঁক আমার কাছে মনে হয়েছে সমাজ সৃষ্ট। আর সে শুন্যতা পূরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রকৃত স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদেরকে জবাবদিহিতার নামে শৃংখলিত করা যেমন সমীচীন নয়, তেমনি স্বাধীনতার যথেচ্ছ ব্যবহারও কাম্য নয়।
আমরা সবাই যখন বিদ্যালয়ে প্রথম অভিষিক্ত হই তখন কিছু কথা মনযোগ দিয়ে শুনতে হয়। যেমন তলোয়ারের চেয়ে কলমের কালি শক্তিমান। জ্ঞানই শক্তি। আসুন জ্ঞানের সন্ধানে ফিরে যান দেশ সেবায়। কিন্তু বাস্তবে একথাগুলো কেবল দেওয়ালে শোভা পায়। আমরা অনেক বড় বড় নেতা, আমলা ও জেনারেলের কথা শুনছি মিডিয়ার কল্যাণে। ওনারা জ্ঞান দেওয়াটাকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে ওই সব কথা বলেন। ওনারা স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস নিতে যান। সম্প্রতি ওনারা জ্ঞান সৃষ্টির নেশায় ডক্টরেট অব ফিলসফি ডিগ্রি করছেন। কি বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!
মুখে জ্ঞানের কথা বললেও আমরা সবাই কম বেশী পেশী শক্তির কাছে আত্মসমার্পণ করি। তাই যিনি সোর্ড অব অনার পেয়ে থাকেন তাকে সমীহ করি ও সময় এলে দেশের প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি বা প্রধান সামরিক প্রশাসক বানাই। বাংলাদেশই নয় সারা পৃথিবীই এই শক্তির তোষণ করে। অথচ যে ছেলেটি বা মেয়েটি বোর্ডে প্রথম হল, যে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হলো এবং সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে øাতক বা øাতকোওর অর্জন করলো তাকে ভুলে যাই।
নবম জাতীয় পে-কমিশনের চেয়ারম্যান একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনিও ভুলে গেছেন। আর যারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বিচারক-এমপি-মন্ত্রী-আমলা হয়েছেন তারাও নীরব রয়েছেন।
শিক্ষকদরে পাশে দাড়িয়ে তারা অন্তত: বলতে পারতেন সর্বোচ্চ বেতন দিতে না পারি তবে সর্বোচ্চ সম্মান আপনাদের দেব। কেঊ মুখ খুলেনি। কিসের এত ভয় তাদের জানি না। তবে এটা প্রমাণ করে আমাদের শিক্ষা যথাযথ হয়নি। আর এজন্য দায়ী ওই শিক্ষক বোধহয়। সে ঠিকমত তিনি পড়াননি। তিনি কোচিং ব্যবসা- নোট ব্যবসায় জড়িত। তাই ছাত্র তাকে সম্মান দিতে চান না।
শিক্ষা নিয়ে যে বাণিজ্য চলছে তাতে দেশের মানুষ ও তরুণ সমাজ দিশেহারা। এবার নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি চলছে। হযবরল লেগে গেলে সচিবের ডাঁনা কাটছেন মন্ত্রী। এবার কোচিং ব্যবসা বন্দ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার ভর্তির সুযোগ আদালত থেকে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। কি সব অদ্ভুত চিন্তা! শুধু বলতে পারি কোচিং সেন্টার বন্দ হবে না। প্রাইভেট পড়া বন্দ হবে না। বরং, ছাত্ররা স্কুল কলেজে না গিয়ে সারাবছর কোচিং এ যাবে। কারণ এই সব সেন্টার উন্নত দেশেও আছে যেখানে কড়া শাসন কাজ করে।
যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েন তারাতো সারা বছরই কোচিং সেন্টারে যায়। সুন্দরবনের বিরল প্রজাতি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত হয়ত হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক পাওয়া যাবে যাঁরা কোন প্রকার প্রাইভেট পড়ানো বা কনসালটেন্সি করেন না। প্রাইভেট পড়ে, পল্লী অঞ্চলে গিয়ে নকল করে পাশ করে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। ডাক্তার হয়ে রোগী মারবে। আর মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থী অকালেই ঝরে পড়বে। নম্বরভিত্তিক এই ভর্তি সংস্কৃতি সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
এদেশে বিচারালয়, পার্লামেন্ট, ও সচিবালয় হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে। মর্যাদা কার উপরে থাকবে এই ইতিহাসই বলে দেবে। মাননীয় স্পীকারের শিক্ষকরা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। বর্তমানে যারা সমাজের উচ্চপদে তাদেও অনেক আগেই অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সিলেকশান গ্রেড পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। তাঁদেরকে নীচুধাপে বেতন প্রদান সুপারিশ শিক্ষা সংকট এর চরম বহি:প্রকাশ। কথায় কথায় আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা বলি, কিন্তু ভুলে যাই তিনি কিন্তু শিক্ষকদের অধিনায়ককে উপাচার্য উপাধি দিয়ে আচার্যের অধীনে ন্যাস্ত করেছেন। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকের মর্যাদা সর্বজন স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু আরও দিয়েছেন ১৯৭৩ সালে অধ্যাদেশ। স্বাধীন দেশের স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়। দিনে দিনে আইনের ফাঁক ফোঁকর অনুসন্ধান করে পাকিস্তান ও বৃটিশ শাসন পুণ:জাগরিত করা হয়েছে।
আমাদের অর্থমন্ত্রী জানেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয় মানব সম্পদ উন্নয়ন বিশ্বমর্যাদার মানদন্ড। কথায় আছে সময় গেলে সাধন হবে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর মত হতে হবে। বেরিয়ে আসতে হবে সামরিক মোড়ক থেকে। দি রিপাবলিক গ্রন্থে প্লাটো যেমন গুহায় বন্দি মানুষের মুক্তি দেখেছেন জ্ঞানের আলোকে, সক্রেটিস যেমন দেখেছেন জ্ঞানই পূর্ণ তেমনি আমাদের উপলব্ধি হতে হবে । নতুবা আমাদের সব অর্জন ধুলিষ্যাৎ হয়ে যাবে।
কথায় আরও আছে পুথিগত বিদ্যা পরহস্ত ধন নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। প্রবাসী শ্রমিকদের অর্জন নিয়ে অহংকার করে ও বিদেশী শিক্ষক আমদানি করে একদিন আফসোস করতে হবে। বিদেশী পার্লামেন্টেও বাঙালি স্থান পেয়েছে। বিদেশের মিশনে আমাদের সামরিক বাহিনী কাজ করে। বিশ্ব জ্ঞান প্রতিযোগিতায়ও আমাদের স্থান করে নিতে হবে। শিক্ষার বরাদ্দ নিয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা নিরসনে ও পে-স্কেল নিয়ে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের মতই এগিয়ে আসবেন বলে জাতি প্রত্যাশা করে।
সৈয়দ মুজতাবা আলীর ইংরেজ সাহেব ও তিন পা ওয়ালা কুকুর কাহিনীর পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না। পুরোন সেই অন্ধকারযুগ পেরিয়ে আমরা প্রকৃত ডিজিটাল চেতনাকে আলিঙ্গন করতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ টেকসই উন্নয়ন স্বপ্ন দেখছেন। আর সেজন্য তিনি অতীতে যেমন শিক্ষার সর্বোচচ বাজেটের জন্য লড়াই করতেন আজও তিনি সেই অবস্থান নিতে পিছুপা হবেন না বলে আমার বিশ্বাস।
নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে শৃংখলিত করেছেন সামরিক-আমলা। তারা বারবার আপনাকেও শৃংখলিত করেছে। আপনিই বলেছেন তাদের জন্য আপনার সন্তানদের পড়াশোনা নষ্ট হয়েছে। ওরা একসময় বঙ্গবন্ধুকেও শৃংখলিত করতো! বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কোথায় ছিল তাতো সবাই জানে। আর ছাত্র-শিক্ষক সব সময় আপনাদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে শৃংখলিত হয়েছেন।
আমরা ১/১১-র নির্যাতন ভুলে যাইনি। যখন আপনার সন্তান হার্ডভার্ডে পড়ছে তখন আপনাকে শৃংখলিত করে তাঁর চরম ক্ষতি করেছে। আমরা এশাবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় চাই। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী শিক্ষক-ছাত্র সমতুল্য কেঊ হতে পারে কি? বাঙালির ইতিহাসই এ প্রশ্নের উওর বলে দেয়। গণতন্ত্র রক্ষা ও বিকাশে প্রকৃতভাবে স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন। আজ জবাবদিহিতার নামে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে শৃংখলিত করা হচ্ছে। এর পরিণাম শুভ হতে পারে না। শিক্ষকদের বেতন স্কেল নিয়ে যা হয়েছে তা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী নয় কি? যারা এমন ভুলটি করেছেন তাদের প্রতি অনুরোধ আসুন নতুন করে শিখে যান নৈতিকতা কি? “দু:খিত” পদটি উচ্চারণে কেন এত ভয়? কোন ভুলবোঝা বুঝি হয়নি। বলুন ভুল হয়েছে। আসুন নতুন কওে অঙ্গীকার করি: প্রকৃতভাবে স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় চাই। অর্থনেতিক উন্নয়ন হলেও নৈতিক উন্নয়নে আমরা অনেক পিছিয়ে। সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনাই রাষ্ট্রব্যাবস্থার লক্ষ্য। আর সুশাসন মানে অনুরোধে কাজ করা, আদেশ দিয়ে নয়। আদেশ দেওয়ার দিন ৪০ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। সত্যটা গোপন রাখার চেষ্টা সফল হতে পারে না। কারণ তথ্য অধিকার আইন আছে। বোধকরি এখানেই শেষ করা উচিত।
অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Related Articles
যুদ্ধাপরাধী সাঈদি চান্দে!
ফজলুল বারী: হিজরী ১৪৩৮ সাল এখন। অর্থাৎ এ পর্যায়ের ইসলাম ধর্মের বয়স ১৪০০ বছরেরও অনেক বেশি। এ ধর্মের শেষ নবী হযরত
অবিন্যাস্ত
এক ভোর রাতে নিজের অস্তিত্বের ব্যবচ্ছেদ করতে করতে শেষ পর্যন্ত যেটায় উপনীত হলাম, তা হল, এই হিসেবি ঘেরাটোপের, আর হিপোক্রেসিতে
রান ৪/৩৩: এমন ব্যাটিং দেখা হইতে ঘুম উত্তম
বাংলাদেশ ক্রিকেট গতকাল এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। মনের গহীন থেকে অভিনন্দন। মুশফিক আউট হবার পর একদলা হতাশা আর কষ্ট নিয়ে