জীবন ভ্রমন ২২ , ২৩

জীবন ভ্রমন ২২ , ২৩

জীবন ভ্রমন ২২ : ১৯৭২ সালে ঢাকা  এসে মতিঝিল  পোস্ট অফিস প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই । ডিপামেনটাল  স্কুল । অগ্রাধিকার  ভিত্তিতে চতুর্থ  শ্রেণীতে  ভর্তি   হয়েছি । চুয়াত্তর সাল । একেই স্কুলে  ক্লাস সিক্স এ উঠেছি । ক্লাস শুরুর  দিনে  পরিচিত কয়েক জনকে  দেখলাম না । মার্চ মাসে হঠাৎ মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে যাওয়ার শখ হলো । আব্বা বলল “এখন ভর্তির সব ফর্মালিটি শেষ , হেড মাস্টার ফয়জুর রহমান সাহেব খুব শক্ত  লোক , গিয়ে লাভ নাই “।

ফুফাত ভাই ড:  খলিলুর রহমান সাহেব  ছিলেন বিশিস্ট শিক্ষাবিদ , টেক্সাসে কোনো এক ইউনিতে ইকনমিক্সের  শিক্ষক  ছিলেন । শুনেছি বংগ বন্ধুর সরাসরি  নির্দেশে পাবলিক এডুকেশন  বিভাগের  প্রধান হন ।  আব্বা প্রায়  শুক্রবারে সার্কিট হাউজ রোডে যেতেন ওই ভাইয়ের বাসায় । তখন অনেক ভিআইপি ওই রোডে থাকতেন ।

আমি আব্বাকে বললাম খলিল ভাই বললে হতে পারে । কারন আমাদের স্কুল থেকে কয় দিন আগে একটা ছেলে আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি হয়েছে । আব্বা সরাসরি নাকচ করে দিলেন এবং বললেন “সম  বয়সী হলেও উনি আমাকে মামা বলে যথেস্ট সম্মান  করে , আমি উনাকে বলতে পারব না, ভাগিনার কাছে নিজেকে ছোট করতে পারবো না ” ।

আমার মন খারাপ  দেখে এক  দিন পর আব্বা একটা দরখাস্ত লিখে আমাকে নিয়ে গেলেন আইডিয়াল স্কুলে । পিয়নের কাছে নাম ও গ্রামের বাড়ির  ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে চাইলেন । ভিতরে  ডুকে সালাম বিনিময়ের পর স্যার বললেন আপনাদের বাড়িতে আমাদের আত্নীয়তা আছে । ওমুককে চিনেন ! এর পর পুরানো দিনের  কয়েকটা  পারিবারিক কথা বললেন ।

অবশেষে আব্বা আমার আগ্রহের কথা বলে  দরখাস্ত টা উনার হাতে দিলেন । হেড স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে পিওন কে একটা ফাইল এনে কিছু একটা দেখে বললেন ” তোমাকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে , ভর্তি হতে পারবে যদি  ৫০ নাম্বারের পরীক্ষায় ৩২ এর উপর পাও,  ইচ্ছা করলে আজকে পরীক্ষা দিতে পারো  অথবা প্রিপারেশন নিয়ে কালকেও আসতে পারো “।

আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং বললাম স্যার  আজকেই দিতে পারবো । অফিসের একজনকে ডেকে আমার পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন । আব্বা বিদায় নিয়ে অফিসে চলে গেলেন । আমি এক ঘন্টার একটা পরীক্ষা দিলাম । অংক , বাংলা ও ইংলিশ  গ্রামার এর উপর পরীক্ষা । সাথে সাথে এক শিক্ষক খাতা চেক করলেন ।

অফিসের বাহিরে টূলে বসে  অপেক্ষা করছি   । হেড  স্যার পিয়নকে দিয়ে ডাক দিলেন ।  ভয়ে  ভয়ে ভিতরে গেলাম । স্যার বললেন ” ৪২ পেয়েছ , ভর্তি হতে চাও ? ” । বললাম জ্বী স্যার ।  স্যার আমার দরখাস্ত ও পরীক্ষার খাতা এক সাথে  স্টাপল করলেন ।

একটা ভর্তি ফর্ম দিয়ে বললেন ” এইটা ফিল আপ করে ,  বর্তমান স্কুল থেকে TC  নিয়ে তাড়াতাড়ি  ভর্তি হয়ে যাও “। মহা খুশি । তিন চার ঘন্টার মধ্যে অনুমতি পেয়েছি । সালাম দিয়ে বের হয়ে গেলাম । আব্বা ভর্তির দিন কৃতজ্ঞতা   প্রকাশ  করে  আসলেন । আর কোনো দিন যেতে হয় নি ।

আজ অবধি ফয়জুর রহমান স্যার কে বিনম্র  শ্রদ্দা করি । ১৯৯৪ সালে অস্ট্রলিয়ায় রেসিডেন্সি এর জন্য দরখাস্ত করতে সবকিছু ইংলিশে করতে হবে । স্কুলের অথোরাইজেশন লাগবে । স্যারের ছেলে বন্ধু ডা: এখলাসকে  ফোন দিলাম স্যারকে একটু বলে রাখার জন্য ।

পনের বছর পর সালাম দিয়ে রুমে ডূকলাম । বললাম  “স্যার  ৭৯ সালে  পাশ করেছি । এখলাসের  বন্ধু “। স্যার বললেন ” চেহারা মনে আছে , সাল মনে নেই ” । টেস্টিমোনিয়াল  কারেকশন করছেন আর  খোজ খবর জিজ্ঞেস  করছেন । আব্বার কথা জিগ্গেস করলেন । মনে হলো ২০ বছর আগের সেই দিনের কথা স্যারের মনে আছে । শিক্ষকদের অসম্ভব স্নরণ শক্তি ।

 

জীবন ভ্রমন ২৩  : আগস্ট মাস । সম্ভবত দাদা হাতেম তাই এর একটা গল্প  ” অভাবের সংসার, খেতে বসে বাবা জিগ্গেস করলো এই মুরগির  তরকারী কোথায় পাইছ ? , মা  চুপ চাপ , ছেলে বলে  উঠলো – সত্য বললে মা মার খাবে , আর না বললে বাবা হারাম খাবে ” । উত্তরটা পাঠকের জন্য থাকলো । ১৫ আগস্টের ঘটনায় উম্মুক্ত মনের রাজনীতি  বিদদের অবস্থা  অনেকটা এই রকম ।

বিশেষ দিনে কাউকে কটাক্ষ না করেও নিজের দলের বা মতের লোককে সম্নান দেখানো যায় । এই জিনিসটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই । অনেক  সময় অন্যকে কটাক্ষ  করতে গিয়ে নিজেকেই ছোট করে ফেলে । যাকে সম্নান করতে  যাওয়া তার সম্নানও ম্লান হয়ে যায় ।

ক্যানবেরায়  আসার পর থেকে ১৫ আগস্টের সব কয়টি অনুষ্ঠানে আমি যাওয়ার চেষ্টা করেছি । আমি আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও মিউচুয়াল  রেসপেক্ট এর অভাব হয়নি । আমি আমার অবস্থান থেকে কথা বলেছি । বরং পারদ্পরিক সম্মান বেড়েছে । আজ পারস্পরিক সন্মানের একটা কথা মনে পড়েছে ।

অনার্স দ্বিতীয়  বর্ষের ছাত্র । বন্ধু শ্যমল নাটকে অভিনয়ের কাহিনী শুনাতো। আর আমি নাটক পছন্দ করতাম । এই  নাট্য প্রীতি থেকে ” কিষান নাট্য গোষ্টি ” নামে একটা গ্রুপ করলাম । সম্ভবত  স্বাধীনতা  দিবস উপলক্ষে এই নাট্য গোষ্ঠির প্রথম অনুষ্ঠান ।

সেই দিন ক্যম্পাসে অডিটৌরিয়াম সাজানোর কাজ সেরে বিকাল তিনটার দিকে হলে রুম J তে গেলাম । হ্যাপি ( এজাজ আল মামুন ) রুমে দাড়ানো ।   আমার বিধ্বস্থ অবস্থা দেখে হ্যাপি বলল ” মুকুল ভাই আপনার স্পিচ রেডি করছেন ! প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে ভালো একটা স্পিচ দিতে হবে ” । আলোচনার এক পর্যায়ে বললাম ” যদিও তুমি ছাত্রলীগ কর কিন্তু কবি মানুষ  , একটা স্পিচ ড্রাফট করে দাও “।

জীবনের প্রথম পাবলিক স্পিচ । পাঁচটার দিকে হ্যাপি আমার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল “একবার পড়ে দেখেন ” । আমি পকেটে রাখলাম আর বললাম ” একবারে স্টেজে পড়বো , খারাপ হলে আমার  দোষ আর  ভালো  হলে তোমার ” । হাসতে হাসতে আরো বললাম ” শেষে জয়-বাংলা লেখো  নাই তো , তা হলে ধানের শীষের আশা  শেষ ” । হ্যাপি হাসতে হাসতে উত্তর দিল ” ভালই হবে , আমরা নৌকায়  তুলে নিব ” ।

সঙ্গত কারণে নীল রঙের একটা টি সার্ট আগেই কিনে রেখেছি ।  নতুন টি সার্টটি পরে  রওয়ানা দিলাম । অবশেষে  আমার ডাক পড়ল বক্তব্য রাখার জন্য । পকেট থেকে বের করে দাড়ি কমা সহ পাঠ করলাম । অনেকে  ব্যক্তিগত ভাবে  সুন্দর বক্ত্যবের জন্য  ধন্যবাদ  দিলেন । প্রমাণিত  হলো “বিশ্বাসে মিলায়  বস্তু তর্কে বহু দূর ” ।

গত বছর বাংলাদেশ মিশনে ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় এক ছোট বোন দর্শকের সারি থেকে বলল ” মুকুল ভাই আপনে আমাদের দলে যোগ  দেন ” । আমি বললাম “দেশের সাথে আছি, নিজ অবস্থানে থেকেও বঙ্গ বন্ধুকে সম্মান করা যায় “।

ক্যানবেরাতে  ১৫ আগস্টের কোনো এক অনুষ্ঠানে এক জনের অপ্রাসঙ্গিক কটাক্ষের প্রেক্ষিতে বলেছিলাম : ” অন্যদিন  রাজনীতির সমালোচনা করা যেতে  পারে , আজ বিশেষ  দিন , i  have  no problem to hate killers and to pay respect to bongobondhu – a big hearted leader who  successfully motivated peoples for six points  demand  resulting independence  movement , ১৫ই  আগস্ট  ঢাকায়  ছিলাম , সন্মান  করলেই সন্মান পাওয়া যায় ” ।

অনুষ্ঠান শেষে তিনি হাত মিলিয়ে মিলিয়ে বললেন ” sorry  , i  did not mean anything  bad ” .

 


Place your ads here!

Related Articles

Amar Ekushey 21st February:

221st February is a day of national mourning, pride, reflection and action. It is the Language Martyr’s Day. It is

বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ আইন

ফজলুল বারী: বাল্য বিবাহ আইন জায়েজ করতে কিছু জ্ঞানপাপী নানা মিডিয়ায় নানান অসত্য তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন! বিদেশেও নাকি এমন আইন

বৈচিত্রতার সৌন্দর্য: পাহাড়িদের জন্য ভাবনা

১৯৪৭ সালে যখন দ্বিতীয়বারের মতন বাংলা যখন ভাগ হল তখন অনেকেই আজকের বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। বিশেষ করে শিক্ষিত,

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment