জীবন ভ্রমন
জীবন ভ্রমন ২৪ : খেজুরের রস । হাই স্কুল জীবনে প্রতি বছর শীতে গ্রামের বাড়িতে যেতাম । আব্বা চিটাগাং মেইল ট্রেনে উঠিয়ে দিতেন । রাত ১০ টার দিকে ছাড়ত । এই মেইল ট্রেনের শেষের দুই বগি লাকসামে রেখে বাকি বগি গুলো চিটাগং চলে যেত । সকালের দিকে ঐ দুই বগি নোয়াখালী লাইনের ট্রেনে সংযুক্ত করত ।
ভোর বেলা রেল স্টেসনের ফেরি ওয়ালার “এই ডিম ডিম, গরম ডিম , এই কলা কলা মিষ্টি কলা , এই গরম চা গরম চা ” ইত্যাদি ডাক আজও কানে বাজে । একবার রাতে ,আখাউড়া স্টেসন , ট্রেন ছাড়ে ছাড়ে অবস্থা , সিলেটের কমলা কিনার জন্য টাকা দিলাম । কমলা আর পেলাম না । কমলা না খেয়ে ভাই এর বকা খেলাম ।
শীতের দিন । আমাদের বাড়িতে দুইটা খেজুর গাছ । তেমন একটা রস পাওয়া যায় না । তার উপর যিনি গাছ কাটতেন তিনি ৫০% নিতেন । জেঠা আগেই বলে রাখছেন বাতিজারা আসলে এক সপ্তাহ তুমি রস পাবা না । দুই গাছ মিলে
হাফ হাড়ি রস হয় না ।
আমার বড় এক কাজিনকে বললাম । উনি বলল ” চুপ থাক , বুদ্বি আছে , কাউকে বলতে পারবি না , মাদ্রাসায় পড়ি , মান ইজ্জত সব যাবে যদি জানতে পারে “। ওই রাতে উনার সাথে ঘুমালাম । জসিমুদ্দিনের সেই বাণী শুনালেন ” খুব ভোরে উঠিতে হইবে সুর্য উঠার আগে , দেখিস পায়ের শব্দে কেউ যেন না জাগে ” ।
একশ থেকে দেড়শ মিটার দুরে । রাস্তার পাশে হানিফ পাগলাদের বাড়ি । পুকুর পাড়ে নতুন খেজুর গাছ । হাড়ি ভরে যায় । রাস্তা ও বাড়ির মাঝে ছোট একটা ধান ক্ষেত । আমি রাস্তায় বসে থাকলাম । সন্ধ্যায় হাড়ি ও পানির মগ রেডি করা ছিল । উনি রস নিয়ে ওদের হাড়িতে পানি দিয়ে চলে এলেন । অপারেশন শেষে বাড়িতে এসে চুপ চাপ শুয়ে পরলাম ।
সকালে জেঠিকে বললাম “আজ এক হাড়ি রস পাইছি । রসের সিন্নি করেন ” । জেঠি দেশী ভাষায় বললেন ” মনে হয় ঢাকার তুন গাছের লাই তাবিজ লই আইছস , হাচা করি ক’ কোনাই হাইছস ” । আমিও দেশী ভাষায় বললাম ” আঙ্গো গাছে অদ্দেক অইছে আর মুজা দাদা অদ্দেক দিছে “।
জেঠি রস ঝাল দিচ্ছে । আমরা রসই ঘরে চুলার পাশে বসে আছি । যেখানে ভাগের ভয় সেখানে সন্ধা হয় । শুরু হলো হানিফ পাগলার গালাগালি । চোদ্দ গুষ্টি তুলে গালি দিচ্ছে । শীতের সকাল । ঘন কুয়াশা । শব্দ তরঙ্গের জন্য উত্তম । সব গালি কানে এসে ইকো হচ্ছে । আমরা দুই জন হাসি চেপে ধরে রাখছি । কাজিন চুপে চুপে বলল ” ভুল হইছে , মনে হয় আজ পাগলার ভাগ ছিল ” ।
জেঠি বলল চিল্লায় কে ? আমি বললাম “মনে হয় কেউ হানিফ পাগলার রস চুরি করছে “। জেঠি বলল ” তোরা চুরি করস নাই তো , তোদের গতি মতি দেখে সন্ধেহ হয় , আমি এই বাড়ির মাইয়া ,মিছা কথা কইছ না ,যা পাগলারে ডেকে নিয়ে আয় “। জেঠিকে বাড়ির মেয়ে হিসাবে সবাই সম্নান করে । মোটামুটি ধরা খেয়ে
গেলাম । কিন্তু স্বীকার করলাম না ।
কথামত হানিফ পাগলারে ঢেকে আনলাম । ততক্ষণে সিন্নি বানানো শেষ । একসাথে বসে খেলাম । জেঠি বাটিতে একটু সিন্নি দাদির (পাগলার মা ) জন্য দিল । হাটতে হাটতে বাড়ির
সামনে পর্যন্ত আসলাম । বিড়ি খাওয়ার জন্য ৫০ পয়সা দিলাম আর বললাম ” হানিফ কাকা তুই আর গালি গালাজ করিস না , কাল সকালে তুই আমাদের গাছের রস নিয়ে যাস ” ।
হানিফ পাগলারে মোটামুটি শান্ত করে বিদায় দিলাম । আরো বললাম জেঠারে বলে কালকে তোরে ধানের চারা উঠানোর কাজ নিয়া দিমু । বুঝ হুস কম , মানসিক সমস্যা আছে । আট দশ স্টেপ গিযেই আবার গালি গালাজ করতে করতে বাড়ি গেল । আমি আর আমার সেই কাজিন সারাদিন গালি শুনতে শুনতে খেজুর রস বমি হয়ে বের হওয়ার অবস্থা ।
জীবন ভ্রমন ২৫ : আকাশে শান্তির নীড় – বিমান, বাংলাদেশ এয়ার লাইনস । এয়ারক্রাফট F28 । ৮০ সিটের বিমান । ৮১ সালে প্রথম আকাশ পথে ভ্রমন । দুই বন্ধু গিয়ে সীটে বসলাম । উড্ডয়নের সময় ও আকাশে উঠার পর বিমানের কম্পন দেখে মনে হলো এই বুজি পড়ে গেল । একটা স্যান্ড উইচ ও মিনি সাইজের একটা কোক শেষ না হতেই দমদমে এসে বিমান ল্যান্ড করে ।
প্রায় ৪০ মিনিটের মত জার্নি শেষ করে দমদমে ইমিগ্রাসনে আসলাম । বাংলা টাকা আছে কিনা জিগ্গেস করলো । মানি ব্যাগ চেক করে ” দাদা এই নোট দিয়ে কি করবে ” বলে ৫ টাকা রেখে দেয় । এরপর কাস্টম । ব্যাগ খুললাম । এই প্যাকেটে কি ? বললাম ” ইলিশ মাছ , একজন দিয়েছে তার আত্নীয়ের জন্য ” । বলল ” দাদা দুই পিচ রাখি , অনেক দিন খাওয়া হয় নি ” । বললাম ” আরেক জনের ,আমার হলে দিতাম “।
তারপর বলল “এক প্যাকেট ৫৫৫ দাও ” । কার্টুন ভেঙ্গে এক প্যাকেট দিলাম । পাশে একজন দাড়িয়ে ছিল । বলল ” দাদা অনেকদিন দোতলা সিগারেট খাওয়া হয় না , এক শলা হবে ! ” । পকেট থেকে একটা দিলাম । খুব খুশি হয়েছে ।
বের হয়ে ট্যাক্সি নিলাম । কলকাতা বড় মসজিদের পাশে আমেনিয়া হোটেল । চেক ইন করে দুইজন রুমে গেলাম । প্রথমেই সেই কাঙ্খিত লুঙ্গি কিনতে হবে – যার জন্য ইন্ডিয়া আসা । হোটেল কাউন্টারে জিগ্গেস করে সপ থেকে দুই জনে দুইটা লুঙ্গি কিনলাম । সেলাই করতে পারলাম না ।
সেলাই বিহীন লুঙ্গি পরে দুইজনে শুয়ে শুয়ে গল্প করছি । বেশ গরম । ফ্যান চলছে । বাতাস কম দেখে ফ্যানের দিকে তাকালাম । ফ্যান ঘুরছে কিন্তু মনে হলো ফ্যানের ডানাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে । ভেঙ্গে যেতে পারে । দিপু কে বললাম । দিপু ভয়ে বন্ধ করে দিল ।
বন্ধ হওয়ার পর দেখি ফ্যানের মাত্র দুইটি ডানা । হাসাহাসির পর আবার চালু করলাম । বাহিরে সারা রাত খটমট শব্দ । কলকাতা রাতে ঘুমায় না । সকালে ক্লিনারকে ফ্যানের কথা জিগ্গেস করতেই বলল ” দাদা এনার্জির দাম আছে , তোমাদের ওখানে ফ্যানের কয়টা হাত “।
নতুন জায়গা একটু আগে ঘুম ভেঙ্গে গেল । নাস্তা খাওয়ার জন্য বের হলাম । করিডোর খুঁজে পাই না । সন্ধায় যে করিডোর দিয়ে ডুকেছি সেই পথে এখন দোতলা বেড দেয়াল থেকে ঝুলে আছে । তিন তারকা হোটেল । দেয়াল থেকেও পয়সা কামাই । জানলাম এরা মাস হিসাবে থাকে । রাত ১১ টা থেকে সকাল ৭ টা এই সব বেডের ঘুমানোর সময় । নগ্ন কিছু পা দেখে ভযে রুমে ফেরত গেলাম ।
জীবন ভ্রমন ২৬ : বেনাপোল সীমান্তের ওপারে বনগাও রেল স্টেসন । অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । বন্ধু খালেদ আর আমি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি । উদ্দেশ্য কলকাতা সিয়ালদাহ রেল স্টেসন । শ এক টাকা, শ এক টাকা করে ফেরিওয়ালা ডাকছে । আমি বললাম ” মামা (খালেদ ) একশ আঙ্গুর এক টাকা , খুব সস্তা , চল খাই ” ।
যেহেতু আমার কলকাতা ভ্রমণের পূর্ব অভিগ্গতা আছে তাই খালেদ বলল ” এই ভ্রমনে তুই এখন গুরু , একতাদাইতুল বিহাজাল ইমাম, চল খাই ” । ফেরীয়য়ালাকে এক টাকা দিয়ে বললাম একশ আঙ্গুর দাও । সে মেপে সাত-আটটি আঙ্গুর দিল । আমি বললাম ” দাদা তুমি না বললে একশ এক টাকা ” । ফেরিওয়ালা ১০০ গ্রামের বাটখারা দেখিয়ে বলল ” দেখে নাও এইটা ১০০ গ্রাম ” । বেয়াকুব বনে গেলাম । হিসাবের টাকা । প্রথমেই ৪ রুপি লস ।
অনেক অপেক্ষার পর ট্রেন আসলো । আমরা দুই জন উঠে বসলাম । বনগাঁও থেকে কলকাতা সিয়ালদাহ স্টেশনের মাঝে অনেক গুলো স্টেশন । প্রতি দুই তিন মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন থামে । মৌমাছির জাকের মত মানুষ উঠে আর নামে । মানুষের ধৈয্য দেখেছি । পুরুষ ও মহিলার মাঝে কোনো ভেদাভেদ নাই । ঠেলাঠেলিতে সবাই সমান ।
এক স্টেশনে প্রচুর লোক উঠলো । পিপড়া হাটার জায়গা নাই । এক মহিলাকে দেখে আমি দাড়িয়ে সিট দেওয়ার চেষ্টা করলাম । পাশের লোক জিগ্গেস করলো ” দাদা, ওপার থেকে এসেছ ? চিন্তা করো না । বসে থাকো , কিছুক্ষণ পর তোমার কোলে বসে পরবে , মজা পাবে ” । আমি আর খালেদ টিপাটিপি করে বললাম পরের স্টেসন একটু দুরে হলে ভালো হতো ।
কয়েক স্টেসন পর ট্রেন কিছুটা খালি হলো । মোটামুটি হাটা যায় । এক TT টিকেট চেক করছে । আমার পাশে একটা ছেলে বয়েসে একটু বড় । অনেকক্ষণ গল্প করেছি । খালেদ আর আমার টিকেট TT দেখল । তারপর ওই ছেলের কাছে টিকেট চাইল । ছেলেটা ধানাই পানাই কথা বলছে । ওর দাদার পরিচয় দিচ্ছে । বুজলাম ওই টিকেট করে নাই । আমি আমার টিকেট দিয়ে তার হাতে খোচা দিলাম । বুঝতে পেরে সে নিয়ে নিল ।
এর মাঝে TT আরেক জনের টিকিট চেক করে আবার তার কাছে চাইল । খুব জারি মেরে TT কে টিকেট দেখালো এবং বলল ” আরে দাদা বাবু , দেখলাম তুমি কি কর , আজ টিকেট করেছি বলেই একটু মশকরা করলাম ” । TT চলে যাওয়ার পর আমাকে বলল ” দাদা তুমি আজ আমাকে বাচলে , এই শালা TT আচ্ছা হারামি, আমার দাদা কলকাতায় ট্যাক্সি চালায় ,তোমাদের হোটেলের নাম দাও , আমি বলে দিবো , সে তোমাদের ঘুরাবে , বেশি পয়সা নিবে না ” ।
ট্রেন সিয়ালদাহ স্টেসনে থামল । ওই ছেলে মজার মজার গল্প শুনিয়ে কয়েক স্টেসন আগে নেমে গেল । স্টেসন থেকে বের হয়ে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি । সাথে একটা পুলিস বক্স । এক পুলিস গিগ্গেস করলো ” কোথায় যাবে ? বুজতে পেরেছে আমরা ওপার থেকে এসেছি । পুলিশের বক্সে ডুকিয়ে বডি চেক করে কিছু খুচরা পয়সা ও সিগারেট এর প্যাকেট রেখে দিল ।
বের হওয়ার পর এক পুলিস জিগ্গেস করলো ” সব ঠিক আছে দাদা বাবু ” । বললাম “ওরা কিছু পয়সা রেখে দিয়েছে” । ওই পুলিস ভিতরে গিয়ে পয়সা গুলো এনে ফেরত দিল । আমরা দুই জন ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চলে এলাম । প্রথম সাত দিন বেশ ঘুরাঘুরি করলাম ।
শেষের তিন দিন । শপিং এর পর টাকা পয়সা প্রায় শেষ । হোটেল ও ট্যাক্সি ভাড়া রেখে হাতে তেমন টাকা নেই । ওই দিন একবেলা আইচ ক্রিম ও বাদাম খেয়ে কাটিয়েছি গড়ের মাঠে ঘুরাঘুরি করে । হোটেলের বয় কে জিগ্গেস করলাম সস্তা খাওয়ার হোটেল কোথায় । জানতাম তিন টাকা দিয়ে ভাত , ডাল ও গরুর মাংস খাওয়া যায় । মাংস একবার দিবে, তবে ডাল আর ভাত যত পারো খাও । সন্ধার পর লাইন পড়ে যায় ।
ওই দিন সস্তা খাবার খাওয়ার পর বুজলাম এইটা
পোষাবে না । হোটেলের বয় এরশাদকে ডাকলাম । দালালের কাছে দুজনের অতিরিক্ত জামা ও প্যান্ট বিক্রি করলাম । গুলিস্থান থেকে কেনা আমার ব্লেজার টি ৩০ রুপি দিয়ে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার কিনে নিল তার ইউনিতে পড়া ভাই এর জন্য ।
মোটামুটি অনেক পয়সা হয়ে গেল । আমি বললাম ” মামা, ঢাকায় গিয়ে জামা না কিনে ক্লাসে যাওয়া যাবে না ” । খালেদ বলল ” নো চিন্তা , আজ আমিনিয়া হোটেলে শেষ বিরানি খাবো আর মুভি দেখব ” । কলকাতা থেকে বেনাপোল বর্ডার ৮০ থেকে ৯০ কিমি এর মত । বারো মাসে তের পার্বন । জায়গায় জায়গায় চাদা বাজি ।
যে ট্যাক্সি ড্রাইভার আমার ব্লেজার টি কিনেছে তাকেই ঠিক করলাম । আগেই ২০ রুপির মত ড্রাইভার এর হাতে দিলাম চাদাবাজদের ম্যানেজ করার জন্য । আর বললাম ” এই টাকা থেকে যা বাচবে তোমার “। ট্যাক্সি তে উঠার পর ড্রাইভার বলল ” আমার দাদা বাবু তোমাদের কোটটি খুব পছন্দ করেছে , তোমাদের ধন্যবাদ ” ।
স্মার্ট ড্রাইভার । রিসার্ভ সাইন লাগিয়ে সরাসরি বেনাপোল সীমান্তে । বিশ রুপি থেকে ১৫ রুপি ফেরত দিতে চাইল । আমি আর খালেদ বললাম ” রেখে দাও দাদা , তোমার দাদাকে কোটের টাকা বাবদ ফেরত দিও ” ।
Related Articles
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি – আমার কিছু মন্তব্য -১
আমি একাধিক পোষ্টে, একে একে হেফাজতের ১৩ দফা দাবির ওপর আলোচোনা করে আমার ব্যক্তিগত মতামত আর সাজেশন উপস্থাপন করছি, এই
নতুন অভিবাসী ও ফ্রান্স : ওয়াসিম খান পলাশ প্যারিস থেকে
আমি বাংলাদেশের অভিবাসীদের কথাই বুঝাতে চাচ্ছি। প্রবাস বেশ কঠিন জায়গা। বিশেষ করে যারা প্রথম অভিবাসী হন তাদের জন্যতো বটেই। দেশ
খালেদার মুক্তি প্যারোলে না জামিনে
মুখে প্রতিদিন গরম গরম রাজনৈতিক বক্তৃতা দিলেও খালেদা জিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে নেপথ্যে একটি আলোচনা চলছে তা