কান্নার তনু

কান্নার তনু

তনু যখন সব বন্ধুদেরকে ফোন দিয়ে বলছিল, আমি চলে যাচ্ছি, মাফ করে দিস; আমরা কেউ তার কথা বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু খ্যাপা ছেলেটা সত্যি সত্যি সেই রাতে বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিল। তন্ময় পাল তনু, আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী ছেলে। আমাদের সময়ে চাঁদপুর থেকে HSC তে একজনই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল এই সেই তনু। উচ্চতায় একটু বেশি ছোট ছিল বলে আমরা তাকে নিয়ে সবসময় মজা করতাম। মনে আছে স্কুলে পড়ার সময় ওকে বল বানিয়ে ক্লাসের ফাঁকে একজন আরেকজনের কাছে ছুঁড়ে ক্যাচ ক্যাচ খেলতাম। HSC শেষে মেডিক্যালে ভর্তি হল, ভালো লাগলো না। এক বছর পর ছেড়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে ফার্মেসি। কিন্তু অদ্ভুত প্রেম আর তার পরিণতি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান প্রেমের কাছে হেরে গিয়ে অভিমানে চলেই গেলো।

মেঘনাপাড়ের ছেলে তবুও সাঁতার জানতো না তনু। মেঘনা ডাকাতীয়ার আদরে বেড়ে ওঠা, তাই হয়তো শেষ সময়েও সেই পানিকেই বেছে নিয়েছিল সঙ্গী হিসেবে। দুইদিন পর জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল তনুর ছেড়ে যাওয়া দেহ। তার লাশের সাথে সেই প্রথম আর শেষ শ্মশানে যাওয়া, সেই প্রথম চিতা জ্বালানো, সেই প্রথম বিসর্জন। সে রাতে ঘুমাতে পারিনি, আরো কয়েক রাত। আমার রাত জেগে নদীতে নৌকা চালানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, চাঁদের আলোয় পানিতে ওকে দেখতাম হেঁটে বেড়াচ্ছে। একা হলেই মনে হত তনু ডাকছে। বছরের এই দিনে আজো সেই দুঃসহ স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে।

সুমন যখন মারা যায় আমি জানতেও পারিনি। ঢাকায় ছিলাম। মাসখানেক পর স্কুলে ফিরে জানতে পারি সে আর কোনদিন ক্লাসে ফিরবে না। আর কোনদিন টিফিন নিয়ে মারামারি কিংবা কলম দিয়ে খোঁচাখুঁচি করবে না। সামান্য জ্বর থেকে হাসপাতালের ভুল চিকিৎসায় হারিয়ে গিয়েছিল সে। সেদিন কাউকে কিছু না বলে টিফিনে স্কুল থেকে চলে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম সন্ধ্যার পর অনেক রাতে ফিরেছিলাম ঘরে, এলোমেলো হেঁটে বেড়িয়েছি কোথায় যেন। আমার খোঁজে ততক্ষণে আব্বু আম্মুর ভয়াবহ অবস্থা।

প্রাইমারি স্কুলের কথা, নতুন চাঁদপুর শহরে এসেছি, কাউকেই তেমন চিনিনা। বন্ধু হিসেবে প্রথম যাকে পেলাম তার নাম ছিল সূজন। দুজন দুই স্কুলের ফার্স্ট বয়, তাই প্রতিবার পরীক্ষা শেষে কে কত নাম্বার পেয়েছি সেটা নিয়ে ভয়াবহ প্রতিযোগিতা চলতো। সূজন-সখি সিনেমার জনপ্রিয়তায় তার নাম হয়ে গিয়েছিল সখি। খুব বেশি ফর্সা ছিল তাই খ্যাপাতে হলে তাকে ডাকতাম সাদা লাউ অথবা চেউয়া সূজন (আমাদের কাছে মনে হত তার গায়ের রং সাদা লাউ আর চেউয়া মাছের মত)।
আমাদের পাশের বাড়িতেই সূজনরা থাকতো। সে ছিল আমার দৈনিক ঝগড়ার পার্টনার, জীবনে সবচেয়ে বেশি মারামারি করেছি তার সাথে। মারামারি করেই আমাদের দিন শেষ হত। খেলা শেষে একে অপরকে ঢিল মেরে অথবা ধুমসে পিঠে সন্ধ্যার কিল মেরে পালিয়ে যাওয়া ছিল ডেইলি রুটিন। সেদিনও তাকে ঢিল মেরে পালিয়ে গিয়েছিলাম। লুকিয়ে থেকে দেখেছি রাগে লাল হয়ে হাতে একটা আধলা ইট নিয়ে আমাকে খুঁজছে। আধা ঘণ্টা পরে খবর এলো ছাদ থেকে পড়ে সূজন মারা গেছে। অথচ সেই ছাদ থেকে আমরা দুজন কত যে লাফিয়ে পড়েছি তার হিসেব নেই। শেষ দেখাতে তাকে মেরেছিলাম এই কষ্ট আমি বহুবছর ভুলতে পারিনি, লুকিয়ে কত যে কেঁদেছি, আকাশের দিকে তাকিয়ে তার উদ্দেশ্যে কত যে মাফ চেয়েছি হিসেব নেই।

রতন ছিল আমার সেই ছোট গাঁয়ের টিনের চালার প্রাইমারি স্কুলের সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে। স্কুল থেকে বিশেষ তল্লাসি অভিযানে প্রায়ই তাকে ধরে আনতে হত। পড়াশোনায় কখনোই ভালো ছিলনা কিন্তু দৌড়ে পুরো স্কুলে সে ছাড়া আর কেউ আমার সাথে প্রতিযোগিতায় আসতো না, থানা পর্যায়েও একবার আমরা দুজনই ১০০ মিটারে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়েছিলাম। কোন একটা অদ্ভুত কারণে আমার প্রতি তার ভয়ানক মোহ ছিল, তাই একাধারে সেই ছিল আমার ডান আর বামহাত। যতবার “মুন্না ভাই” সিনেমা দেখেছি সার্কিটের মাঝে তাকে খুঁজে পেয়েছি। আগের দিন স্কুলে কোথা থেকে জানি এক ব্যাগ জলপাই এনে দিয়ে বলেছিল একটা ঘুঘুর বাসার খোঁজ পেয়েছে, বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গিয়েছে। কালকেই পেড়ে এনে দেবে আমাকে। জলপাই দেখে জানতে চাইছিলাম, আবার চুরি করেছিস? রতন কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিল, তাইলে কি করুম, আমগো কি গাছ আছে নাকি?

পরদিন যথারীতি সুপুরি গাছের খোল দিয়ে খাঁচা বানিয়ে নাচতে নাচতে স্কুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু রতন আসেনি। স্যাররা স্কুল ছুটি ঘোষণা করে আমাদের নিয়ে রতনের বাড়ি চললো। সারা গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছিল সেখানে। রতন বাপের সাথে রাগ করে পুরো এক বোতল কীটনাশক খেয়েছে। ক্লাস ফোরে পড়ি সবে, বাচ্চা ছেলে তাই লাশের কাছে আমাদের যেতে দিচ্ছিলো না কেউ। লুকিয়ে চুরিয়ে গিয়ে দেখেছি মড়কের ইঁদুরের মত রতন পড়ে আছে পাটি দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায়, মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে তখনো। পাশে হতবিহল হয়ে বসে আছে তার বাবা, গতকালই যে তার মাকে ছেড়ে নতুন আরেকটা বিয়ে করেছে। রতনের চেহারা, তার বাড়ির রাস্তা প্রায় সবকিছুই ভুলে গেছি আজ কিন্তু রতনকে ভুলতে পারিনি। আমার সেই শিশুমনে এক ভয়ানক অধ্যায় হিসেবে সে থেকে গিয়েছিল। ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে তাকে ডাকতাম বলে আম্মু আমাকে অনেকদিন বুকের কাছে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছে।

মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তবুও কিছু মৃত্যু গেঁথে গেছে মাথায় মগজে। আজো দুঃস্বপ্নে তারা ফিরে ফিরে আসে। এগুলো সব অনেক ছোটবেলার ঘটনা তাই দিন তারিখ কিছুই আজ আর মনে নেই। কিন্তু প্রতিবছর যখন তনুর চলে যাওয়ার দিনটি আসে আমার শৈশবের সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরাও ফিরে ফিরে আসে তার সাথে।আমার এই ব্যাথাময় স্মৃতিগুলো তাই তনুর সাথে বাঁধা।

তনু, ভাই আমার, জানিনা কেমন আছিস, ওই জগতটা কেমন তাও জানিনা। ওখানে কি দেখা হয় আর সবার সাথে? শুনতে পাস আমাদের, তোর বন্ধুরা আজো তোর জন্য কাঁদে, জানিস কি তুই? এই দূর প্রশান্ত পাড়ে সিডনী হারবারের শান্ত জলে তাকিয়ে ভাবছি তোর কথা। তোর দেহভস্ম তো এই জলেই মিশে গিয়েছিল সেদিন। সেই ডাকাতীয়া মেঘনা হয়ে তাসমান সাগর, তুই আছিস তো এখানে?

জেনে হয়তো খুশি হবি আমি, আমরা সবাই ভালো আছি। সেই মেয়েটাও ভালো আছে। হয়তো বিয়ে থা করে সংসার করছে। জীবন আমাদেরকে ভালো থাকতে বাধ্য করে, তোর কথাও এখন আর মনে পড়েনা. তুই চলে যা ভাই, আর কোনদিন ফিরে আসিস না। তুই চলে যা খ্যাপা, আমাদের খোঁজ নিতে হবে না, আমরা ভালো আছি ।
“মৃত্যুতেও থামেনা উৎসব
জীবন এমনি প্রচন্ড প্রচুর…”


Place your ads here!

2 comments

Write a comment
  1. Anonymous
    Anonymous 3 March, 2015, 10:11

    কান্নার তনু পড়ে আমার চোখে জল এসে গেছে। আর কিছু বলতে পারতেছি,

    Reply this comment
  2. Ajoy
    Ajoy 5 March, 2015, 20:50

    Farhad- I believe you have more story to share; awaiting for more of your stories to read.

    Reply this comment

Write a Comment