কেনবেরার দূর্গা পূজা ও তার শিশু শিল্পীরা

কেনবেরার দূর্গা পূজা ও তার  শিশু শিল্পীরা

বরাবরের মতো এবারেও কেনবেরার বাংলাদেশীরা বারোয়ারি দূর্গাপূজা করেছিল । ২০০৬ সালে এই পূজার শুরু হয়েছিল
কেনবেরার ফ্লোরির হিন্দু মন্দিরে । এবছর ছিল সেই পূজার দশ বছর পূর্তি । পূজার দশ বছর পূর্তি উদযাপন হয়েছিল মন্দিরের
বাইরে এক কমুনিটি হলে- ১৭ এবং ১৮ অক্টোবর । কেনবেরাতে মন্দিরের বাইরে এবারেই প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন হলো ।
পূজার অনুষ্ঠানে অনেকের মাঝে এবারে উপস্থিত ছিলেন এ, সি, টি, কমুনিটি সার্ভিসেস -এর পরিচালক আর
অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ।

রীতি অনুযায়ী পুরোহিত ডেকে পূজার মন্ত্র পড়ে দূর্গার কাছে আশীর্বাদ চাওয়া ছাড়াও এবারের অনুষ্ঠানে নাচ,
গান আর বক্তৃতার পাশাপাশি ছিল ফ্যাশন শো । শিল্পীদের কেউ একক কন্ঠে কেউবা সমবেত কন্ঠে গান গেয়েছিল;
কেউ স্টেজে উঠেছিল নিজ সঙ্গীতদলকে নিয়ে; কেউবা দল ছাড়া । সকল শিল্পীরা কেনবেরার স্থানীয় । সব কিছু মিলিয়ে এবারের
পূজার অনুষ্ঠানটি আমার ভালো লেগেছে ।
সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছে শিশুদের স্টেজ পারফরম্যান্স । ইংরেজি ভাষার মধ্যে বেড়ে উঠা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাংলায়
গান গাওয়া, কিংবা বাংলা গানের মিউজিকের তালে তালে নাচ করা কষ্ঠকর হলেও ওদের স্টেজ পারফরমান্স ছিল নিখুত ।
ওদের কেউ কেউ নাচ কিংবা গান শিখেছে ঘরে মা কিংবা বাবার কাছে, কেউবা কেনবেরার বাংলা গানের স্কুল থেকে, কেউবা
শুধুমাত্র ইউ টিউব থেকে ।

স্টেজ পারফরমার দের মধ্যে বয়সে যে সবচেয়ে ছোট ছিল সে ছিল নৃত্য শিল্পী- ওর বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর ।

ইংরেজি ভাষার মধ্যে বেড়ে উঠা সাড়ে তিন বছরের বাঙালী শিশু বাংলা গানের তালে মনমাতানো নাচ যে নাচতে পারে তা
নিজ চোখে না দেখলে অন্যের কাছে শুনে আন্দাজ করা আর না হোক আমার জন্যে কঠিন হতো । আমি ওর নাচে অবাক হয়ে
ওর মায়ের কাছে ওর নাচের ব্যপারে আগ্রহ নিয়ে আরো কিছু জানতে চাইলে ওর মা জানালেন যে অহনা (মেয়েটির নাম)
ইউ টিউব দেখে দেখে নাচ শেখে- ও কোন নাচের স্কুলে এখনো যেতে শুরু করেনি ।

শিশুদের পারফরমেন্সে আমার মনে হয়েছে যে বাঙালি সংস্কৃতিকে কেনবেরাতে ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে জাগিয়ে রাখার
একমাত্র উপায় যদি নাচ গানই হয়ে থাকে তাহলে সেই কাজটির দায়ীত্ব এসব শিশুরা দক্ষতার সাথেই পালন করতে পারবে ।
তবে আমরা বয়স্করা ওদেরকে বাঙালী সংস্কৃতির সাথে দীর্ঘদিন জড়িয়ে রাখতে পারব কিনা সেটাই বরং ভাবনার বিষয় ।

২০০৬ কিংবা ২০০৭ সালের দিকে যেসব শিশু শিল্পীরা কেনবেরার পুজো গুলির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যমনি ছিল সেই সব
শিশু শিল্পীদের কেউ এখন আর বাংলা গান বাজনার স্টেজে পারফরম করে না । এমনকি বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দর্শকের
সারিতেও ওদেরকে নিয়মিত দেখা যায় না । ওদের কেউ পড়ছে কলেজে, কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ে । কেউবা চাকরি করছে |
বাংলা গানবাজনা ওদের হয়তো এখন তেমন আর ভালো লাগে না ।

বাংলা ভালো ভাবে না বলতে পেরেও যে শিশুটি বাংলা গান ভালো ভাবে গাইতে পারে, বাংলা গানের তালে তালে নাচতে পারে,
সেই শিশুটিই একটু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাংলাকে ভুলে যেতে শুরু করে । এর কারণ আমার ভালো জানা নেই ।

আমি মেনে নিতে পারি না আমার সেই বন্ধুদের যুক্তি যারা বলেন এনিয়ে এত ভাবনার কি আছে? ইংরেজি ভাষার দেশে বাংলা
গান বাজনার প্রয়োজন কি? ওদের এই কথায় আমি ভয় পেলেও অবাক হই না ।

স্বার্থপর মানুষ নিজেকে নিয়েই ভাবে । ওদের সন্তানেরা বাংলা গান বাজনা জানে না । তাই কেনবেরায় বাংলা গান বাজনার ভবিষ্যত
নিয়ে ওদের মাথা ব্যথাও নেই ।

আমার ভয় এই জন্যে যে, ওদের এই ধরনের ভাবনা চিন্তা আমাদের বাংলা সংস্কৃতিকে মাল্টিকালচুরাল কেনবেরাতে স্থান
গড়ে নিতে অসহায়ক হচ্ছে । ওদের এই ভাবনা চিন্তা আমাদের শিশু শিল্পীদের প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় হচ্ছে ।
আমার ভয় এজন্যে যে ওরা ওদের ছেলে মেয়েদের বাংলার দিকে আকৃষ্ট করতে খুব একটা আগ্রহী না হয়েও বাংলা
কমুনিটির কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা সেজে বসেছে ।

ওরা বাংলাকে ছেড়ে ইংরেজিকে আকড়ে বাঁচতে চাইলেও, আমি বাংলাকে ছেড়ে অষ্ট্রেলিয়াতে বাঁচতে চাই না ।
কারন বাংলা ভাষা আর বাংলা সংস্কৃতি’র মাধ্যমে আমি আমার ছেলেদের সাথে বাংলাদেশে আমার রেখে আসা
আত্মীয় স্বজনদের সাথে বন্ধন পাকা পোক্ত করতে চাই । আমি চাই আমার ভাষা ও সংস্কৃতি আমার মৃত্যুর পর
আমার সন্তানদের মধ্যে বহমান থাকুক । আর তাই আমি নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলাকে, বাংলা সংস্কৃতিকে হাড়িয়ে
যেতে দেখে আতংকিত হই ।

পূজা আমার বাংলা সংস্কৃতি’র একটি অংশ – আর সেই সংস্কৃতি’র প্রতি শিশু শিল্পীদের আকর্ষণ যখন থাকে না
আমি আতংকিত হই এদেশে আমার সংস্কৃতির ভবিস্যত ভেবে ।

আমাদের ছেলে মেয়েদের বাংলাকে এড়িয়ে চলার প্রবনাতাকে রোধ করা জরুরী । যে শিশুটি সত্যিকারভাবেই বাংলা গান গাইতে
ভালোবাসতো সেই শিশুটি কি কারণে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাংলা গানকে এমনকি বাংলা গানের অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে চলে- এর কারণ
আমাদের খুঁতিয়ে দেখতে হবে ।

আমরা বিদেশে যারা বাংলায় কথা না বলে মনের খোশ মিটিয়ে আড্ডা দিতে পারিনা, বাংলা সংস্কৃতির একটু অবমাননা হলে
দশ হাত নিতে ছাড়ি না, ডলার খরচ করে বাংলা গান শুনতে দ্বিধা করি না তাদের জন্যে সম্ভবত বিষয়টি গুরত্বের সাথে বিবেচনায়
নেওয়ার সময় এসেছে ।

আজকে যারা বাংলা ভাষার কিংবা বাংলা গানের স্কুলের মাধ্যমে, কিংবা বৈশাখী মেলার মাধ্যমে, কিংবা ধর্মীয় আচার-অনুষ্টানের
মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বহমান রাখতে সচেষ্ট তাদের সেই চেষ্টাও বৃথা প্রমাণিত হবে যদি কিনা মুখে বাঙ্গালী আর
অন্তরে অবাঙ্গালী মহলের হাতে থাকে বাঙালী প্রতিষ্ঠানগুলি ।

আমরা যদি আমাদের শিশুকিশোরদের বাংলাকে এড়িয়ে চলার প্রবনাতাকে রোধ করতে না পারি, আমরা যদি তাদেরকে
বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চায় উতসাহিত করতে না পারি, আমরা যদি সাংগঠনিক ভাবে ওদের বাংলা সংস্কৃতির প্রতিভাকে লালন করার সুযোগ
করে না দিতে পারি তা হলে এসব প্রতিভাবান শিশুশিল্পীদেরও আমরা ২০০৬ সালের শিশুশিল্পীদের মতোই হাড়িয়ে ফেলব ।
এখনো সময় আছে শিশুকিশোরদের কথা মাথায় রেখে বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন করার ।

Ahona pic 4 pic 6 pic 8 pic 2 pic1 pic 3 pic 7


Place your ads here!

Related Articles

SHUROLOK presents Musical Evening

SHUROLOK presents Ghoroa Ashor* SHUROLOK’s next Ghoroa Musical Evening is about celebrating the lives of Rabindranath, Nazrul and other poets

হিমু ভাবনা – জিল্লুর ভাই

ক্যানবেরাতে এখন গ্রীষ্মকাল। এবারের গরম গত বছরের মতো নয়। গত বছর এই সময় জনপদ ছিলো তীব্র দাবানলে পর্যদুস্ত। একেবারে তথৈবচ

Music through the passage of time: A Canberra night by Dhrupad

“গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি ভুবন খানি” Music is the elixir of human soul. Eons and eons ago, when human

1 comment

Write a comment
  1. Probir Sarker
    Probir Sarker 17 November, 2015, 00:12

    Very nice article.

    Reply this comment

Write a Comment