হাউস ওয়াইফ হতে চাই না
ভুল করে কোনদিন লিখিনি আমার জীবনের লক্ষ্য হাঊজ ওয়াইফ হওয়া। গালভরা শব্দ। মনে হয় খুব সন্মানের । আমার কাছে খুব অপমানের। একবিংশ শতাব্দীর একটা মেয়ে ঘড়ে বসে রান্না বাণ্ণা করবে আর একজনের ঘাড়ের উপর নিঃসংকোচে চড়ে বসবে। নিজের প্রয়োজনের জিনিষ টুকি টাকি সবই স্বামীর টাকা দিয়ে করবে? এটা ঠিক আমি মানতে পারি না। যদিও হয়তো ভালো ও উদার মনের স্বামীরা কখনও জানতে চান না টাকার হিসাব। তারপরে ও সূক্ষ্ম একটা জবাবদিহিতা থেকেই যায় নিজের অজান্তে।
হাউস হাসবেনড শব্দটার সাথে সযতনে আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজ অপরিচিত । কোন হাজবেনড নিজের কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছে সংসারের সুখের জন্য তা শোনা ডুমুরের ফুল। অথবা স্ত্রী অনেক বড় চাকরী করে, আমি ছেলে মেয়ে দেখি সংসার সামলাই এই রকম কোন ছেলে উদাহরণের জন্য আছে কিনা আমার জানা নাই। বাংলায় আছে ঘর জামাই। কিন্তু খুব অলস প্রকৃতির আর বোকা টাইপের ছেলে ছাড়া হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও ঘর জামাই পাওয়া দুস্কর।
আমাকে যখন কেউ বলে কি করেন ? তখনি আমি বেলুনের মত চুপসে যাই। মনে মনে আমি এক দৌড়ে খাটের নীচে চলে যাই । সেখান থেকে খুব আস্তে করে বিড়ালের মত মিউ মিউ করে মিনমিনে গলায় বলি হাঊজ ওয়াইফ। এখন আবার নূতন ভাবে দেশী বোতলে বিদেশী মদের মত বলা হয় হোম মেকার। সম্মান কি বাড়ল নাকি? আমি বুঝি কম । কিন্তু এই অপমানের বোঝা আমার ঘাড়ে তূলে দিল কে? পরিবার না সমাজ?
সব কিছু বুঝার পরও আমি হাঊজ ওয়াইফের ঘেড়াটোপ থেকে বের হতে পারিনি ভয়ে পাছে আমার সংসার ভেসে যায়? আমার অথবা আমার মত হাজারো নারী তাদের কি যোগ্যতা ছিল না নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের একটা আলাদা আইডেণ্টী খুঁজে নেবার? সাধারণ দৃষ্টিতে হাঊজ ওয়াইফদের কোনকিছুর অভাব নাই । স্বামীর সবকিছুতে তার সমান অধিকার । কোন কোন সময় একটু বেশীই হয় ।
প্রতিটি সক্ষম হাঊজ ওয়াইফ কি তাতেই সন্তুষ্ট? আমার মনে হয় না । প্রতিটি হাঊজ ওয়াইফ চায় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা । সেও কারো সন্তান। যে বাবা মা তাকে কষ্ট করে লালন পালন করেছেন ,সেই মেয়েটারও ইচ্ছে করে বাবা ,মার পাশে দাঁড়াতে প্রয়োজনে হাতটা বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু যে মেয়ে সারাক্ষণ নিজের প্রয়োজনেই হাত বাড়িয়ে রাখে অন্যের দিকে, তার ইচ্ছেটা অনেকটা গুজুর ও চিত হয়ে শোয়ার মত। অথবা কাটামুণ্ডের দিবা স্বপ্ন ।
দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত একটা সক্ষম মানুষ প্রতিটি পদক্ষেপে একজনের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। এই জীবন অসম্মানের ,প্রতিটি সময় কৈফিয়তের । এই জীবন ঘৃণার, প্রতিটি সময় প্রশ্নের মুখোমুখি। এই জীবন ভিক্ষুকের, প্রতিটি সময় দয়ার দান গ্রহণ করার। মনে হয় চোখ থাকিতে অন্ধ । কান থাকিতে বধীর ।
হাঊজওয়াইফ শব্দটা আমার কাছে সপাং সপাং করে চাবুক মারার মত আমার চেতনাকে প্রতি নিয়ত আঘাত করে । এই জীবন আমি সপ্নেও চাই নাই। ভুলেও চাই নাই। মনে হয় কেউ চায় না । পরিস্তিতি তাকে বাধ্য করে । বাধ্যতার বেড়াজালে আটকে থাকতে । যে মেয়ে তার পুরোটা জীবন সংসারের সুখের জন্য নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ টা অনায়াসে বিসর্জন দিয়ে দিল শেষ বয়সে সেই মহিলা টা সংসার বা সমাজ থেকে কি পায় ? একজন মহিলা যখন শেষ বয়সে অসুস্ত হন তখন কলিজার টুকরার মত ছেলেমেয়েরা এবং প্রিয় স্বামী চিন্তিত হয়ে পড়েন এই বিশাল ব্যয় ভার কি ভাবে সামলাবেন । তখন সেই অ্যাডজাস্টম্যানট আর সেক্রিফাইস করা মহিলাটার সাথী হয় চোখের জল আর নিজের বোকামি আর দীর্ঘশ্বাস। এখনি সময় প্রতিটি মেয়েকে হাউজওয়াইফ এ না আটকে থেকে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার। এমন একটা সমাজ যেখানে স্বামী ও স্ত্রী দুজন ই সংসার এর অপরিহার্য, দুজন ই সমান অধিকার নিয়ে নিজের সংসার কে দেখবে, দায়িত্ব পালন করবে। সমাজ সংসার তোমার সুখের সময় থাকবে দুঃখের সময় নয়। নিজেকে গড়ে তোল সব রকম কালিমা থেকে দুরে সরে মানুষের মত মানুষ হও সবার জন্য আমার এই প্রার্থনা ।
সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে এই কথা সত্যি হয়েছিল আমার মায়ের জীবনে । এখন দেখি আমার জীবনে ও একই সুর বাজে। সান্তনার । তাই রবিঠাকুরের সাথে গলা মিলিয়ে বলি –
যা না চাইবার তাই আজি চাই গো
যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো ।