নীল ছাতা
বৃষ্টি হচ্ছে।
নীতু দাঁড়িয়ে আছে নীল ছাতার নিচে। ছোট ছাতা। এই ছাতায় দু’জন একসাথে ধরে না। শুভ তাই নীতুর মাথায় ছাতা ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে।
– তোমার কি ধারণা? মাথার ওপর ছাতা ধরে বৃষ্টিতে ভিজলেই আমার রাগ গলে পানি হয়ে যাব?
– না, আমার ধারণা উল্টা। আমার ধারণা, এতে তোমার রাগ আরও বেড়ে যাবে।
– তাহলে মাথার উপর ছাতা ধরে আছো ক্যানো?
– রাস্তার লোকজনকে দেখাচ্ছি। তারা ভাবছে ছেলেটা নাম্বার ওয়ান উজবুক। উজবুক না হলে কেউ গার্লফ্রেন্ডের মাথায় ছাতা ধরে বৃষ্টিতে ভেজে না।
– তাতে তোমার লাভ কি?
– আমার কোন লাভ নেই। বিনামূল্যে মানুষকে এন্টারটেইন করছি। ওই দেখো, বাস থেকে মানুষগুলা কেমন হাসি হাসি মুখে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে মজার জিনিস তারা এই জনমে দেখে নাই। শুধু তাই না। তারা বাড়িতে গিয়ে এই ঘটনা আয়েশ করে সবাইকে বলবে। সবাই হেসে গড়াগড়ি খাবে। ঘটনা যা ছিল তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশী ডালপালা ছড়াবে। দেখা যাবে, সেই ঘটনায় তুমি দাঁড়িয়ে না, আমার কাঁধে চড়ে বসে আছো, আর আমি হাত উঁচু করে তোমার মাথায় ছাতা ধরে বসে আছি!
– তোমার কি মনে হয় না তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ? তোমার সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত।
– কথা সত্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একটু আধটু মানসিক সমস্যা আমাদের সবারই আছে। আমাদের সবচেয়ে বড় অসুস্থতা হচ্ছে, আমরা সকলেই ভাবি আমি নিজে মানসিকভাবে সুস্থ, আমার চারপাশের লোকজন অসুস্থ।
নীতুর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। শুভ আকারে ইঙ্গিতে উল্টো তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। শুভর সাথে কথা বলার এই এক সমস্যা। সব কিছুকে বুমেরাং বানাতে সে ওস্তাদ।
– তুমি কি বলতে চাচ্ছ, আমি মানসিকভাবে অসুস্থ? নীতু কড়া গলায় বলল। সে আর তার রাগ চেপে রাখতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে বৃষ্টির ভেতর হাঁটা দেয়। কিন্তু এই মুহূর্তে তা সম্ভব না। তার হাতভর্তি স্কুলের টিউটোরিয়াল পরীক্ষার খাতা। খাতাগুলো বৃষ্টিতে ভিজলে সমস্যা। আজ রাতের মধ্যে তাকে খাতা দেখে শেষ করতে হবে। স্টুডেন্টদের এ ক’দিনে সে অনেক ঘুরিয়েছে।
শুভ ছাতাটা খানিকটা নিচু করলো। বৃষ্টির ছাঁট বাড়ছে। নীতু ভিজে যাচ্ছে। তাকে ভিজতে দেয়া যাবে না। কোনভাবেই না। রাস্তার মানুষগুলো এখনই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর ভিজে গায়ের সাথে শাড়ী লেপটে গেলেতো কথাই নেই। চোখ দিয়ে গিলে খাবে।
– নাহ। তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ হবে কেন? দেখো না, লোকগুলো ক্যামন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। এটা মানসিক অসুস্থতা ছাড়া আর কি! কিন্তু গিয়ে দেখো, ওরা ভাবছে, সমস্যা আমার। আমি বৃষ্টিতে ভিজে তোমার মাথায় ছাতা ধরে আছি। আহাম্মক ছাড়া এই কাজ কে করে!
– তোমাকেতো কেউ আহাম্মক হতে বলে নি। তুমি বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমানের মত কাজ করো। তুমি তোমার ছাতা নিয়ে চলে যাও। গিয়ে তোমার বন্ধুর বোনের বিয়ে খাও। যাওয়ার আগে পাঁচটাকার আমলকী কিনে খেতে খেতে যেও। মুখের রুচি বাড়বে। হজম শক্তি বাড়বে।
– বাহ। তোমার আইডিয়াতো ভালো। আইডিয়া পছন্দ হয়েছে। এইজন্যই তোমাকে আমি এতো পছন্দ করি। তুমি প্রায়ই আমার কাছে জানতে চাও না, তোমাকে আমি কেন এতো ভালোবাসি? এইজন্য তোমাকে আমি এতো ভালোবাসি। তোমার মাথা হচ্ছে গুগুল। যখন যা দরকার ক্লিক করা মাত্র হাজির। থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম।
নীতু হতভম্ব হয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলের সমস্যা কি! স্কুলের ক্লাশ শেষ করে সে শুভর জন্য টানা দেড়ঘণ্টা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। দেড়ঘণ্টা পর সে এসে হাজির হয়েছে। তার বন্ধুর বোনের বিয়ে। সেই বিয়ের সব দায়-দায়িত্ব তার। দম ফেলার ফুরসত নেই। দেড়ঘণ্টা পর হাজির হয়ে সে নির্বিকার গলায় বলল, ‘চলো, চলো, বৃষ্টি এসে যাবে। আকাশের অবস্থা দেখছো?’
নীতু কোন কথা বলল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। তার মনে হচ্ছে, সে অনন্তকাল এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। একসময় তার পায়ে শেকড় গজিয়ে যাবে। সে তার পাশের বিশাল রেইনট্রি গাছটার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে। বৃষ্টি এলে চুপচাপ সেই বৃষ্টিতে ভিজবে।
নীতুর চোখ টকটকে লাল। শুভ তার হাত ধরল। টুপটাপ বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। শুভ তার হাত ছেড়ে দৌড়ে রাস্তার ওপাশে চলে গেলো। সে ফিরল নীল রঙের ছোট্ট এক ছাতা নিয়ে। কী সুন্দর সেই ছাতা। এই ছাতার গাল থাকলে ভালো হতো, আদর করে গাল টিপে দেয়া যেত।
সেই থেকে নীতু দাঁড়িয়ে আছে। কোন রিকশাও পাওয়া যাচ্ছে না। সে তার দাঁড়ানোর জায়গা থেকে একচুলও নড়ে নি। বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। হাওয়া বইছে। শুভও নড়ে নি। সেও তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। নীতু কথা বললে উত্তর দিচ্ছে। কথা না বললে চুপ করে নীতুর মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার শীত শীত লাগছে। গা কাঁপছে। জ্বর এসে যাচ্ছে নাকি! সমস্যা হচ্ছে, নীতুর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। সে বরং তাতে আরও রেগে যাবে। পরিস্থিতি খারাপ হবে।
নীতু হাত উঁচু করে রিকশাটা থামাল। বৃদ্ধ রিকশওয়ালা অবাক দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে আছে। নীতু এক পা এগিয়ে রিকশায় উঠলো। খুব ধীরে পরনের শাড়ীটা গোছালো। তারপর বলল, ‘মামা, পলিথিন? বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিতো!’
– ‘পলিথিনতো নাই খালা। বেয়ানে যহন রাস্তায় বাইর হইছি, তখনতো আসমান ছিল ফকফকা। এমুন বিস্টি নামবো কেডায় জানতো!’
শুভ নীতুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসে। তারপর এক পা এগিয়ে রিকশার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ছোট্ট ছাতাটা নীতুর হাতে গুঁজে দেয়, ‘আমাকে তো রিকশায় উঠতে দিবে না, দিবে?’
নীতু মুখ ফিরিয়ে নেয়। জবাব দেয় না।
-‘ছাতাটা এক হাত দিয়ে সামনে ধরে রাখো। বৃষ্টির ছাঁট তাহলে লাগবে না’।
– ‘আমার ছাতা লাগবে না’।
শুভ কোন কথা বলে না। সে ছাতাটা শক্ত করে নীতুর হাতে গুঁজে দেয়। তারপর দেখিয়ে দেয় কোথায় ধরে রাখতে হবে, ‘এখন বৃষ্টি লাগিও না। তোমার গায়েতো জ্বর। চোখ লাল হয়ে আছে। তখন যে হাত ধরলাম, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। এইজন্যই ছাতাটা কেনা। নিতে ইচ্ছে না হলে বাসায় ঢোকার আগে ফেলে দিও’।
শুভ মিষ্টি করে হাসে। সে তাকিয়ে আছে নীতুর চোখে। নীতুও। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাদের মাঝখানে তুষারের মতো ঝরছে। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা রিকশার প্যাডেল চাপে। রিকশাটা প্রবল বৃষ্টির ভেতর এগিয়ে যায়। শুভ এটা ভাবে নি। সে ভেবেছিল, শেষ মুহূর্তে নীতু তাকে রিকশায় উঠতে বলবে। তারপর শুভর বৃষ্টি ভেজা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আলতো করে হাত রেখে বলবে, ‘তুমি এমন কেন?’ শুভ মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে থাকবে। কোন কথা বলবে না। নীতু শুভর মুখটা আলতো হাতে তার মুখের কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলবে, ‘আচ্ছা, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন বলতো?’
শুভ তারপরও চুপ করেই থাকবে। কি জবাব দিবে সে! তার কাছে এই প্রশ্নেরতো কোন জবাব নেই। তারচেয়ে নিঃশব্দে বসে থাকা ভালো। সে এখনো নিঃশব্দই আছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। নীতুর রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে। শুভর কান্না পাচ্ছে। সে কখনো কাঁদতে চায় না। কান্নায় তার ভীষণ লজ্জা। কিন্তু এখনতো কাঁদাই যায়। এই বৃষ্টিতে তার কান্না কে দেখবে! শুভ ঝাপসা চোখে সামনে তাকায়। ঝাপসা চোখেই সে দেখে, নীতুর রিকশাটা ফিরে আসছে। প্রবল বৃষ্টির তোড়ে নীতুর হাতে ধরা নীল ছাতাটাকে কি যে অদ্ভুত আবছায়া লাগে! নীতুর মতই। সুন্দর আবছায়া। নীতু রিকশা থেকে হাত বাড়ায়, তার হাতে নীল ছাতাটা। সে বলে, ‘ভেবে দেখলাম, তোমার ছাতাটা আমি বাসা পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাই না। তাই ফেরত দিতে এলাম। আসলে, তোমার কোন কিছুই আমার আর সহ্য হচ্ছে না।’।
শুভ কোন কথা বলে না। সে নীতুর চোখে তাকায়। তারপর নিঃশব্দে নীতুর বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে ছাতাটা নেয়। কিন্তু হাতটা আর ছাড়ে না। তারপর টুক করে লাফিয়ে উঠে পড়ে রিকশায়। নীল ছোট্ট ছাতাটা ধরে রাখে সামনে। ছাতার পেছনে নীতুর পাশে জড়সড় হয়ে বসে থাকে শুভ। নীল ছাতায় বৃষ্টি ছুঁয়ে যায়। আর নীতু আলতো হাতে ছুঁয়ে যায় শুভর ভেজা খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো, তারপর বলে, ‘তুমি এমন কেন?’ শুভ উত্তর দেয় না। সে এখন কোন উত্তর দিবে না। কথা বলবে না। সে কেবল তার মাথা নিচু করে চুপাচাপ বসে থাকবে। অপেক্ষায় থাকবে। কারণ, এরপরের বাকী গল্পটুকু সে জানে।
সে জানে, জল মিশে যায় জলে।