ছোটগল্প – আত্ম বিসর্জন
এক
আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। সদ্যই হলে ওঠেছি। পাঠ্যের পড়াশোনাতে যতটুকু না আমার আগ্রহ তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সংস্কৃতিমনা বেশ কয়েকজন বন্ধু জুটে যায়। তাদের সাথে সখ্যতাও গড়ে ওঠে। হল থেকে অনতিদূরে ভোকেশনাল স্কুল। আয়তনেও বৃহৎ। অবশ্য এ কারণেই বোধহয় থানার মধ্যে সবকটি ভোকেশনাল স্কুলগুলোর পরীক্ষা কেন্দ্রও এটি।সেদিন ছিল ভোকেশনাল এসএসসি পরীক্ষার শেষ দিন। অপরাহ্নের সময় ব্যক্তিগত কারণে স্কুলের সামনের স্টেশনারি দোকানটাতে যাই। আমার সাথে ছিল সজল।
সূর্যের তেজসক্রিয়তা তেমন একটা নেই বললেই চলে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা পড়ামাত্রই ছাত্রছাত্রীরা দলবেঁধে বেরিয়ে আসতে লাগলো। কেউ হাসি মুখে আবার কেউ বা গুমরা মুখে। আমার কিছু প্রবন্ধ ফটোকপি হচ্ছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে আমি তাদের দিকে তাকাই। অভিভাবকদেরও বেশ জটলা। মনে হল ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় সময়সচেতন অভিভাবকদের সংখ্যাই বেশি!
সবার শেষে দুটি মেয়ে ধীর গতিতে হেঁটে আসছে। ততক্ষণে উপস্থিত সকল অভিভাবক এবং ছাত্রছাত্রীরাও চলে গেছে। আমার ফটোকপির কাজও ততক্ষণে শেষ হওয়ায় আমিও বেরিয়ে আসি। মেয়ে দুটিকে বেশ ফ্যাশন্যাবল মনে হল। যেমন রূপ তেমনি তাদের পোশাকের কারুকার্য। অবশ্য তাদের একজনে বোরকা পড়লেও সেটাও ছিল স্টাইলিশ। বোরকাটাও আজকাল ফ্যাশন্যাবল হয়ে যাচ্ছে!
মেয়ে দুটি খোশগল্প করতে করতেই আসছিল। আমি সামনে সজল পিছনে। আমি কালো চশমা পড়া মেয়েটির দিকে তাকাই। ওর ঠোঁট দুটি বেশ সুন্দর। একেবারে সতেজ কমলালেবুর মত। ছিমছাম চেহারা, দেখতে অনেকটা ভারতীয় নায়িকাদের মত। আমার চোখ আটকে গেল মেয়েটির লম্বা নাক দেখে। বলিউডের অন্যতম সেরা নায়ক হৃত্তিক রোশনের নাক থেকেও বড় মনে হল। বড় হলেও সেটি আপাংক্তেয় মনে হল না। বরং এই নাকের কারণেই যেন তার সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেছে বলে মনে হল।
আমি তার দিকে তাকাতেই সেও আমার দিকে তাকায়। এগিয়ে আসতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে ভাঙ্গা ইটে পা পড়তেই সে হোঁচট খায়। সজল হাসি চেপে রাখতে পারে না। খিলখিল করে হাসে। কিন্তু আমার কেন যেন হাসি না এসে অনেকটা অনুশোচনাই হল। আমার জন্যই বোধ করি…। আমার শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে সজলের হাসিও মুহূর্তেই ফিকে হয়ে যায়। মেয়েটি ভীষণ লজ্জা পেল। এমনিতেই ফর্সা তদুপরি দেখলাম গোধূলীর আবিরের ন্যায় রক্তিম হয়ে ওঠেছে। আমার ‘Sorry’ বলতে ইচ্ছে করল। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। একটু পর সিএনজি করে ওরা চলে যায়।
দুই
এর কয়েকমাস পর আমি অনেক চেষ্টার পর মেয়েটির ঠিকানা সংগ্রহ করি। হোঁচট খাওয়া মেয়েটির নাম মুক্তা। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। পরিবারের সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তিন ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র সেই-ই ছোট। মেয়েটি তখন কারিগরি কলেজে ভর্তি হয়েছে। বন্ধুদের পরামর্শে আমার মাথায় ভূত চাপে! রাত জেগে জেগে মনের মাধুরি মিশিয়ে মুক্তার নামে চিঠি লেখি। তখনও মোবাইল খুব একটা সহজলভ্য না হওয়ায় চিঠিই হয়ে ওঠলো একমাত্র ভরসা!
মুক্তার নামে চিঠি পোস্ট করি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে চিঠি গিয়ে পড়ে প্রভাষক লাকী ম্যাডামের কাছে। আর লাকী মেডাম হল মুক্তার বড় বোন। অফিসের দপ্তরি মুক্তাকে ভাল করেই চিনত। চিঠিটি উদ্দেশ্যমূলক মনে করে সে লাকী ম্যাডামের হাতে নিয়ে দেয়। প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে লাকী ম্যাডাম চিঠিটি খুলে। কম্পিউটার কম্পোজ চিঠি। প্রেরকের কোন নাম নেই। কেবল চিঠির শেষে লেখা ছিল- তোমার অচেনা প্রেমিক! ম্যাডামের ভারী রাগ হতে লাগলো। এই বয়সেই…! দপ্তরিকে ডেকে সিলেটী ভাষায় বলল- তাইর নামে কোন চিঠি আইলে আমার কাছে আনি দিবা, বুচছ নি গো?
– জি আফা।– আর তাইর লগে কোনতা মাতার দরখার নাই, মনো থাখবো নি?
-জি অয়।
কয়েকদিন হয়ে যায় কোন উত্তর না পেয়ে আমি পুনঃ চিঠি লেখি। সপ্তাহ খানেক যায় সে পত্রেরও কোন উত্তর আসে না। আমি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ি কিন্তু কেন যেন পত্র দেওয়া বন্ধ করলাম না। পত্র চলতেই থাকলো। হিসেব করে দেখলাম পনেরটির মত পত্র ছাড়া হয়েছে। ষোল নাম্বার পত্রটি ছাড়ার পরও কোন উত্তর না পেয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ি। উল্লেখ্য এই পত্রে আমার সম্পূর্ণ ঠিকানা দেওয়া ছিল।
এরপ্রায় সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা। হঠাৎ একটি উত্তর আসলো। আমি তো অবাক। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর কীর্তিমানরা যেমন খুশি হয় তেমনি অবস্থা আমার! পত্রটি পড়ে বন্ধুদের মধ্যে হইহুল্লোর শুরু হয়ে গেল। চিঠি উপলক্ষে সব বন্ধুদের যেন না খাওয়ালেই নয়। পত্রটির সারাংশ এমন ছিল যে- আমার পনেরটি চিঠিই প্রভাষক লাকী আপুর কাছে গিয়ে পড়েছে। এই কারণেই তার পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় নি। দৈবাৎ পত্রগুলো তার হস্তগত হয়। পত্রের ভাষা পড়ে সে খুবই মুগ্ধ। এখন সে দেখা করতে ইচ্ছুক। পত্রের নিচে কোথায় দেখা করব সে স্থান এবং সময়েরও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।
আমার কেন যেন খুব বিশ্বাস হল। কিন্তু এরই মধ্যে আমার সবচেয়ে স্টাইলিশ বন্ধু সৈকত এসে প্রস্তাব করল ঠিকানা অনুযায়ী সে গিয়ে দেখা করবে। সেকি কাকুতি মিনতি! সৈকত একবার আমার আম্মুকে রক্ত দিয়েও সে বাঁচিয়েছিল। সেই থেকে তার প্রতি আমার বেশ দুর্বলতাও ছিল। তার অসম্ভব অনুনয় বিনয় ও নানাবিধ দিক চিন্তাভাবনা করে রাজি হয়ে গেলাম। সৈকত আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে- You are great! You are so great!
দেখা করার দিন অজ্ঞাত কারণেই আমি বাড়িতে চলে যাই। এবং প্রায় অর্ধমাস পরে ফিরে আসি। ফলে তাদের সম্মুখ সাক্ষাতের ফলাফল আর জানা হয়ে ওঠেনি। আজ সৈকতের সাথে দেখা হতেই আমি তাদের সাক্ষাতের ফলাফল জিজ্ঞেস করি। আমার প্রশ্ন সে কৌশলে পাশ কেটে যায়। আমিও অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে তাকে পুনরায় আর প্রশ্ন করলাম না। ভার্সিটিতে ঢুকতে ঢুকতেই সজল অট্ট হাসি দিয়ে বলে – জানিস, সৈকত ও মুক্তার প্রেম এখন শেয়ার বাজারের মত তুঙ্গে!
কথাটি বলেই সে পুনরায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। আমিও তার সাথে যোগ দেই। কিন্তু সে হাসিতে কোন প্রাণ নেই, দিনের বেলায় চাঁদের আলোর মতই ম্লান!