চাঁপাতলার কান্নাও চাঁপাই থাকবে?

চাঁপাতলার কান্নাও চাঁপাই থাকবে?

অভ্যাস মতো আমার দিনটি শুরু হয়েছিল আজ বাংলা পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে।অনলাইনে প্রথম আলো পত্রিকাটিতে চোখ বোলাতেই চোখ কেড়ে নিল রাজীব নুর ও মাসুদ আলমের ‘চাঁপাতলায় শুধুই কান্না’ প্রতিবেদনটি। গত রোববার, ৫ই জানুয়ারী ২০১৪, ভোট শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায় বাংলাদেশের যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে; জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বসতবাড়ি, লুটে নেওয়া হয়েছে তাদের সবকিছু। অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, নির্বাচনের পর এমন বিভতস হামলা যে হতে পারে সেটা তাদের ধারণার মধ্যে ছিল না।

একাত্তরে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোষর রাজাকার আল-বদর বাহিণীর নির্যাতনে সাধারন মানুষের মনে যে আতঙ্কের সৃষ্ঠি হয়েছিল গত রবিরারে জামায়াত-শিবিরের নির্যাতনে মালোপাড়ায় হিন্দুদের মধ্যে সেধরনের এক আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা দেখা যায়। জামায়াত-শিবিরের তান্ডব থেকে জীবন বাচাতে দেয়াপাড়ায় আশ্রয় নেয়া মালোপাড়ার শিশু-কিশোরেরা মালোপাড়ায় তাদের বাড়িতে ফেরার কথা শুনে ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল। ভয়াবহ সেই হামলার নিসংসতা সহজেই অনুমান করা যায় রাজীব নুর ও মাসুদ আলমের প্রতিবেদনে দেওয়া এহসান-উদ-দৌলার কেমারয় ধরা ছবি টি থেকে- ‘খাবারের জন্যে কাঁদছে শিশু, শিশুকে খাবার দিতে না পেরে কাঁদছে মা’।

রাজীব নুর ও মাসুদ আলমের এই প্রতিবেদনে জানা যায় যে মালোপাড়ায় মৎস্যজীবী হিন্দু পরিবারগুলোর ১০২টি পরিবারের মাত্র দুটি ঘর ছাড়া সব ঘরেই ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। লুটেরা লুটে নিয়েছে সবকিছু- পুড়িয়ে দিয়েছে ঘরের আসবাব, লেপ-তোশক, বিছানা; ধংস করেছে মৎস্য পরিবারগূলোর জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বন মাছ ধরার জালগুলো; ঘরে অবশিষ্ট রাখেনি খাবারমতো কিছুই। হামলাকারীদের হাত থেকে জীবন বাচাতে এসব পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই ভৈরব নদের ওপারে দেয়াপাড়ায় আশ্রয় নেয়। সর্বস্ব হাড়ানো এসব পরিবারগুলোর চোখে-মুখে এখন শুধুই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। রাতের বেলায় আবারও জ়্বালাও-পোড়াও হয় কি না- এই আতংকে ওরা আতংকিত (সুত্রঃ রাজীব নুর ও মাসুদ আলমের লেখা ‘চাঁপাতলায় শুধুই কান্না’, প্রথম আলো, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪)।

একাত্তরে দেশ ছিল পরাধীন- সেসময় নির্যাতিত হয়েছিল অবাঙ্গালী’র হাতে বাঙ্গালী। দেশ এখন স্বাধীন। স্বাধীন দেশে গত রবিবারে নির্যাতিত হলো এক বাঙ্গালীর হাতে আরেক বাঙ্গালী- পুড়িয়ে দিলো এক বাঙ্গালী আরেক বাঙ্গালীর ঘরবাড়ি; লুটে নিল এক বাঙ্গালী আরেক বাঙ্গালীর সবকিছু।

একাত্তরের নির্যাতন শুধূ বাঙ্গালীর ধর্ম-বর্ণের বিচারে হয়নি, রবিবারের নির্যাতন ধর্ম-বর্ণের বিচারে হয়েছে। নির্যাতিতরা সবাই হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী মৎস্যজীবী খেটে খাওয়া বাঙ্গালী।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভয়নগর উপজেলা থেকে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ভোটাররাই শুধু ভোট দেয় নি, অন্য ধর্মে বিশ্বাসীরাও ভোট দিয়েছিল। ভোট দেওয়ার অপরাধে যদি হামলা চালানো হবে তবে সেই হামলা ধর্ম বর্ণের বিচারে হবে না, অথচ রবিবার যশোরের অভয়নগর উপজেলায় হামলা হয়েছে শুধু হিন্দু পরিবারের উপর। মালোপাড়ার বাসিন্দারা সম্ভাব্য হামলার ব্যপারে আগে থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করে রাখলেও তারা কেউই হিন্দুদের রক্ষা করতে এগিয়ে যান নি। এ ঘটনা থেকে এই ধারনা হয়ওটা সঙ্গত যে মালোপাড়ায় হামলার কারন নেহায়ত ভোটের পক্ষ্যে বিপক্ষ্যে অবস্থানের জন্যে নয়, হয়তো অন্য কিছু যেটা আমারা নিশ্চিত করে এখনও জানি না।

গত বছরে যেভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতে ইসলামী সহ ক্ষমতাসীন দলের এক প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের সাথিয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটিয়েছিল, তা মনে পরলেই ভয় হয়। দৃশ্যপটে মালোপাড়ার এই হামলার সাথে জামাত-শিবির জরিত থাকলেও এর পিছনেও সাথিয়ার মতো কোন নাটকিয়তা নেই তো?

সাথিয়ায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার তত্ত্ব- উপাত্তের ভিত্তিতে গত ২৪ নভেম্বর ২০১৩ প্রথম আলো ‘সাম্প্রদায়িকতার রিংমাস্টারগন’ শিরোনামে ফারুক ওয়াসিফের যে প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল তা থেকে জানা যায় যে সাথিয়ায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার নেপথ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতে ইসলামী সহ ক্ষমতাসীন দলের এক প্রতিমন্ত্রী। হিন্দু’র অর্থ ভাগাভাগি করে আত্মসাত করতে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে ওরা সেদিন সাথিয়ায় এক কাট্টা হয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়েছিল।

এধরনের সাম্প্রদায়িকতার রিংমাস্টারগনই ঘটনার নেপথ্যে থেকে হাটহাজারিতে হিন্দু-মুসলিম দাংগা ঘটিয়েছিল। মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে গরীব রাজমিস্ত্রি মোঃ জসিমকে দিয়ে মসজিদের দেওয়াল ভাঙ্গিয়ে তার পাল্টা জবাবে মন্দির ভাঙ্গানোর মাধ্যমে হাটহাজারিতে হিন্দু-মুসলিম দাংগা ঘটান হয়েছিল (সুত্রঃ Samakal, 17 February 2012)।

এ থেকে সহজেই বোঝা যায় এদানিং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নাগরিকদের সর্বসান্ত করতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটান হয়; প্রশাসনকে রাখা হয় নিস্ক্রিয় করে। তাইতো হামলার এক ঘণ্টা আগে বিষয়টি মালোপাড়ার বাসিন্দারা আঁচ করতে পেরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি জানালেও কোন নেতা কিংবা প্রশাসনের কেউই মালোপাড়ার হিন্দুদের সেসময় রক্ষা করতে এগিয়ে যান নি; অথচ ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে নেতাদের অনেকেই গিয়েছিলেন ভুক্তভুগিদের দরদ দেখাতে।

সাথিয়ায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় মন্ত্রি জরিত ছিল আর মালোপাড়ার হামলায় স্থানীয় নেতা ও পুলিশ প্রশাসন ছিল নিস্ক্রিয়। সঙ্গত কারনেই বলা যেতে পারে যে যেদেশের মন্ত্রিরা তার সংখ্যালঘু নাগরিকদের উপর অত্যাচারের ষরযন্ত্র করে; যে দেশে একের পর এক হামলা চালিয়ে সংখ্যালঘুদের জান-মালের ধংস করানো হয়; যে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার কোন সুবিচার হয় না সেই দেশে ‘চাপাতলার কান্না’ চাপাই থাকবে।

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি সমুন্নত রক্ষার চাপে সংখ্যালঘুদের কান্না চাপা থাকে- এবারেও হয়তো সেই একই কারনে চাঁপাতলার কান্নাও চাঁপাই থাকবে। সংখ্যালঘুদের এই চাপা কান্নাকে জিইয়ে রেখে দেশের ভিতরে রাজনীতি করা যায়, কিন্তু বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতির ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখা যায় না।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment