১৯৭১ ভেতরে বাইরে – একটি নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ বিশ্লেষন
মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ, জনাব এ, কে খন্দকার একজন সৎ এবং ভদ্রলোক বলে সুপরিচিত। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া চাকুরিরত সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন জেষ্ঠ্য এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমানে জীবিত সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম। তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ “১৯৭১ ভেতরে বাইরে” প্রকাশের পর অতন্ত্য দুক্ষজনক হলেও, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ কেউ তাকে এমনকি ‘রাজাকার’ বা আই এস আই’এর এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঠিক সেই সময় আমি ঢাকা থেকে কমোডর ফারুক (অব), মেজর নজরুল (অব) সহ আরো অনেকেই আমাকে একটি নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ বিশ্লেষন করার অনুরোধ করেছিলেন।
আমার বিশ্লেষন যাতে নিরপেক্ষ, নির্মোহ এবং আবেগতাড়িত না হয় তার জন্য আমি বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করি এবং ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রচুর বই নতুন করে পড়াশুনা করি।
“১৯৭১ ভেতরে বাইরে” বইটির মধ্যে ভুমিকা ও পরিশিষ্ট সহ মোট ১৫ টি অধ্যায় রয়েছে। এর মধে নৌ কমান্ডো ও বিমান বাহিনী অধ্যায় দুইটি’ তথ্য বহুল এবং অনুমানের উপর নির্ভরশীল নয়। এই দুইটি অধ্যায়ের সাথে নৌ কমান্ডো খলিলুর রহমানের “মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযান”, মোঃ শাহজাহান কবির বীরপ্রতিক’এর “চাঁদপুরে নৌ-মুক্তিযুদ্ধ” এবং মেজর রফিকুল ইসলাম পি এস সি’র “মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডো”র এবং ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক’ এর “সত্তায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ” গ্রন্থের অপূর্ব মিল লক্ষনীয়! তাই পালাক্রমে এই দুইটি অধ্যায় বাদে বাকী ১২ টি অধ্যায় এর একটি নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ বিশ্লেষন করাই আমার লক্ষ্য।
এই বইটি অনেকেই রেফারেন্স হিসাবে ব্যাবহার করা শুরু করেছেন এবং ভবিষ্যতে’ও করবেন বলে মন হচ্ছে। তাই ইতিহাসের স্বার্থেই এই বইটি কতটুকু নির্ভরযোগ্য তার নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ বিশ্লেষন হওয়া খুবই জরুরী।
“১৯৭১ ভেতরে বাইরে” বইটির প্রচ্ছদে বইটির নির্ভরযোগ্যতা’র কথা বলা হয়েছে এবং একই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে যে জনাব এ, কে খন্দকার ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে বিমান বাহিনী প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন (!)। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট্ব পরবর্তী প্রকৃত ঘটনা কিন্তু তা বলে না, কারন ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জনাব এ, কে খন্দকার সাহেব বঙ্গভবনে গিয়ে সেনা ও নৌবাহিনী প্রধানের সাথে খুনী মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন(১, ২, ৩, ৯, ১০ এবং ১৬ আগষ্ট ১৯৭৫ সালের প্রতিটি জাতীয় সংবাদপত্র )।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ’ করলে তিনি বঙ্গভবনে আনুগত্য প্রকাশ না করেই পদত্যাগ করতেন। ধরে নিলাম সেনা ও নৌবাহিনী প্রধানের মত তিনিও জীবনের ভয়ে খুনী মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। জনাব এ, কে খন্দকার সাহেব যদি পরবর্তী ২৪-৪৮ ঘন্টা বা সর্বোচ্চ কয়েকদিন এর মধ্যে পদত্যাগ করতেন তা হলে তিনি অন্তত দাবী করতে পারতেন যে আমি ১৫ আগষ্ট্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমি পদত্যাগ করেছিলাম। ‘প্রতিবাদে’ পদত্যাগ করেছিলাম বলে দাবী করতে হলে কারন হিসাবে পদত্যাগ পত্রে তার উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয়। কারন পারিবারিক বা স্বাস্থ্যগত কারনেও যে কেউ পদত্যাগ করে থাকতে পারেন।
এই প্রসংগে উল্লেখ্য, ১৯৭৫ এর আগষ্টের শেষার্ধে মোশ্তাক সরকার ততকালীন সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ’কে সরিয়ে তাদের পছন্দের জিয়াউর রহমান’কে সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দান করে। তাই সফিউল্লাহ সাহেব যদি দাবী করতেন যে আমি ১৫ আগষ্ট্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলাম, তা শুধু মিথ্যাই নয়, হাস্যকর দাবী হিসাবে প্রতীয়মান হতো।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক বাহিনী’র পক্ষ থেকে কোন প্রতিরোধ না হলেও বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েকজন সামরিক বাহিনী’র অফিসার এর প্রতিবাদ করেছিলেন! “৭৫-এর ক্যাপ্টেন জাহাংগীর ওসমান বীর প্রতীক, ৭০ সালে তিনি ছিলেন ব্রাম্মনবাড়িয়া ছাত্র সংসদের ভিপি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নভেম্বরে নির্বাচিত হয়ে ’৭২-এর আগষ্টে কমিশন প্রাপ্ত অফিসার ছিলেন তিনি। বংগবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে কমিশন প্রাপ্ত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীর প্রথম ব্যাচের সদস্য ছিলেন লেফটেনেন্ট আবদুল কাদের। ১৫ আগষ্ট প্রতূষ্যে তিনি ঢাকা ষ্টেডিয়ামে সেনাবাহিনীর টিম নিয়ে অনুশীলন করছিলেন। বিকালেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে দেশ ত্যাগ করেন। পরে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসলে ওসমান ও কাদের দুই জনেরই কোট মার্শাল হয়”। (সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর, মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক; পৃষ্ঠা ৩৮)
আমি ১৯৭৫ এর হত্যাকান্ড ও পরবর্তী ঘটনাবলী উল্লেখ রয়েছে এমন তথ্যনির্ভর প্রত্যেকটি বই তন্ন তন্ন করে খুজেছি, কিন্তু কোন বইয়ে জনাব এ, কে খন্দকার সাহেবের এই দাবীর সমর্থনে কোন প্রমান পাই নাই।
১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জনাব এ, কে খন্দকার পদত্যাগ করেছিলেন বলে তার বইয়ে দাবী করা হলেও, তিনি কবে পদত্যাগ করেছিলেন তার কোন উল্লেখ নাই! জনাব এ, কে খন্দকার সাহেবের কাছে যদি তার পদত্যাগ পত্রের কোন কপি থেকে থাকে তা উল্লেখিত বইয়ের ‘পরিশিষ্ট’এ প্রকাশ করলে তার দাবীর নির্ভরযোগ্যতা প্রমানিত হতো। একই সাথে তার পদত্যাগ পত্রে কি কারনে তিনি পদত্যাগ করেছিলনে আবশ্যই তার উল্লেখ থাকার কথা। তিনি যদি তার পদত্যাগ পত্রের কপি হারিয়ে ফেলেন, তাহলে তিনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তার ফটোকপি জোগাড় করে তার বইয়ের পরবর্তী সংস্করেনে প্রকাশ করবেন বলে আশা করব। (চলবে)
তথ্যসূত্রঃ
১। এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক; মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী
২। বাংলাদেশঃ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১; ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন
৩। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল
৪। তিনটি সেনা অভ্যূথান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল এম. এ হামিদ
৫। বাংলাদেশঃ আ লেগেসী অফ ব্লাড, এন্থনী ম্যাসকারেহান্স
৬। বাংলাদেশঃ দ্য আনফিনিসড রেভ্যূলেশা, লরেন্স লিফসূল্যজ
৭। বঙ্গবন্ধু হত্যাঃ ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস; অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
৮। হু কিলড মুজিব, আব্দুল লতিফ খতিব
৯। পচাত্তরের রক্তক্ষরন, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি
১০। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর, মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক