হাওর উপাখ্যান
হাওর উপাখ্যান – ০১
জীবনের শ্রেষ্ঠতম বৃষ্টিবিলাস।
সুনামগঞ্জের সুরমা নদীতে লঞ্চের ছাদে বৃষ্টিতে অবগাহন। ডেক থেকে ভেসে আসছে বাউল গান।
রাতভর লঞ্চ ভ্রমণ। চলবে পালাগান, যাত্রাগান, রাধারমণের গান, উজান এলাকার গান।
উদ্দ্যেশ্য, জাতীয় হাওর উতসব।
তিন দিন থাকব হাওরের জল, নল খাগড়ার বন জঙ্গল নৌকা আর লঞ্চে। হাওরাঞ্চলের সংস্কৃতির সকল উপাদান নিজ চোখেমনে দেখে এসে সবাইকে টাটকা কিছু খবর দিব ইনশাআল্লাহ ।
আয়োজনে যা থাকছে—
নৌ শোভাযাত্রা,
লোকনৃত্যের মাধ্যমে অতিথিদের হিজল ফুল, শাপলা ফুল ও জলপদ্ম দিয়ে বরণ,
লোকবাদ্যযন্ত্র মেলা উদ্বোধন ( খোল- করতাল- একতারা- বাঁশি- ডুগডুগিসহ হাওরাঞ্চলের সনাতন পদ্ধতিতে সঙ্গীতের সাথে ব্যবহার্য উপকরণ ,বাঘের সিন্নি ধামাইল,লোকগান ( রাধারমণ, হাসন রাজা, দুর্বিন শাহ, শাহ আব্দুল করিম ),যাত্রাগান , লাঠিখেলা, পুথি পাঠ, গাজির গীত, ধামাইল নৃত্যগীত ।
সাথে সেই ১১ বছরের সাথী সমরাট দাদা ও তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সুমি আপু। আরো থাকছেন প্রায় শখানেক বিশুদ্ধ বাঙালি।
হাওর উপাখ্যান-০২
প্রায় ১১ ঘন্টা লঞ্চপথ পাড়ি দিয়ে এখন মধ্যনগর থানা সদরে। তবে থানা সদর বলতে যা বোঝায় তা নয়। ছোট্ট একটা বাজার কেন্দ্র করেই এ মধ্যনগর। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার থানা এটি।
এর চারপাশে পানি। পানি মানে নদী নয়। হাওর। হাওয়ারের মেলা এ অঞ্চলে। অদূরেই বিশাল বিশাল সুউচ্চ পাহাড়। কিন্তু এ পাহাড় আমাদের নয়। ভারতের। ভারতের মেঘালয় রাজ্য। মূলত এ পাহাড়্গুলিই বাংলাদেশ ও ভারতের বিভাজন রেখা।
প্রত্যন্ত বললে ভুল হবে দুর্গম এ এলাকা। জেলা সদরের সাথে এই মধ্যনগরের দুরত্ব জলপথে প্রায় ১১ ঘন্টা। বলা বাহুল্য এখানে আসতে হলে এই জলপথ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ট্রলার বা নৌকায় একমাত্র বাহন।
আসার পথে উল্লেখ্য যা দেখলাম, হিজল গাছ। যা অনেকটা নতুন জামাইয়ের মতো। মাথায় টোপরপরা পাতা।
এই জলপথ সোজা হলে হয়তো এতো সময়সাপেক্ষ হতো না। পুরো রাস্তাটিই সাপলুডু গোছের। অনেকটা সর্পিলাকার। মাঝে মাঝে স্বর্গীয় সোপানের মতো গাছে সারি আর চিরল চিরল পথ। হাজারও মাছ ধরার ট্রলার। যা মনে করাতে বাধ্য পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসকে। নিজেকে কুবের মনে হবে অনায়েসে। তবে কপিলাকে পাওয়া যাবে না নিশ্চিত!
দৃশ্যমান পাহাড়্গুলো চরমভাবে হাতছানি দিলেও যাওয়ার পথ নেই। কাটাতারের বেড়া বিদ্যমান। পাহাড় ফুরে মেঘ বের হচ্ছে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। ইশ! ইকারাশকে মনে পড়ছে।
লঞ্চ থেকে নামতেই ‘জাতীয় হাওর উতসবে’র আয়োজকরা কলমি ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। হাওর অঞ্চলের খুবই সহজলভ্য এ ফুল। আপাতত ঠাই মিলেছে এখানকার এক প্রায়মারি স্কুলে। চারপাশে বাচ্চাকাচ্চারা ভির জমিয়েছে আমাদের দেখতে। নিজেকে বিয়ে করতে আসা বর বর মনে হচ্ছে।
সকাল ৮.১৫ মিনিট
মধ্যনগর, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ।
হাওর উপাখ্যান-০৩
হাওর প্রধান এই এলাকায় অভুতপূর্ব একধরণের সঙ্গীত আছে। এবং এই বিশেষ ধরণের গান এই এলাকাতেই উতপত্তি ও বিস্তৃত। বিশেষ এই মৌলিক গানের নাম হলো- ধামাইল।
ধামাইল খুবই জনপ্রিয় গান এই জনপদে। মূলত ধামাইল গান গ্রুপভিত্তিক গাওয়া হয় । একে নৃত্যসংগীতও বলা যেতে পারে। কারন এ গান শুধু গাইলেই হয় না, এর সাথে নাচতেও হয়। সাধারণত এই এলাকার কিশোরিরাই গায় এ অভাবনীয় সুন্দর গান। তারা খুব মজা করে গায়। প্রথমে একজন এক লাইন গায়, পরে সবাই তা সমস্বরে গায়। তবে এ গান বড়রাও গায় তবে তা খুবই কম। বড়রা কোরিওগ্রাফিতেই থাকে!
অনেকটা বংশীয় রীতিতে এ গান চলে আসছে। বৃত্তাকারে নাচ ও হাতের তালির মাধ্যমে যৌথভাবে গান গাওয়া হয়। নাচের ঢঙে গান!
সুনামগঞ্জের এই দুর্গম এলাকায় এসে এ গান শুনে আমি মুগ্ধ। বাংলা মায়ের বুকে এতো সম্পদ, না আসলে জানা যেত না। মালয়েশিয়ার বিমানের মতোই হারিয়ে যেত এ জানা।
খুব অবাক হলাম কেন ধামাইল এই হাওর এলাকার বাইরে যাচ্ছে না। বৃহত্তর সিলেটে এত রুপ আর সৌন্দর্য তা আসলে অজানাই রয়ে যেত। জীবনের স্বাদ যেন পাচ্ছি।
মধ্যনগর থানা মাঠ, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ
রাত ৯.৩০ মিনিট।
হাওর উপাখ্যান-০৪
সমুদ্র নাকি টানে! হাওরও টানে। টানতে বাধ্য। এখানকার হাওরগুলো কিশোরি প্রেমিকাদের মতোই। চপলতার প্রেম, উচ্ছ্বলতার প্রেম। প্রতিটি বাঁকে বাঁকে টান, প্রেমীয় টান। এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
ছোট নৌকা, বড় নৌকা, ট্রলারের সমাহারও বলা যায় এ হাওরগুলো। ঢেউয়ের ছলাত ছলাত শব্দ ব্লাকহোলের টানে। নাওয়া খাওয়ার কথা কর্পূরের মতো উড়ে যায়। মাছধরা নৌকাগুলোই বলে দেয় এ হাওরের বুকই মাছেভাতে বাঙালি এই প্রবাদের জনক।
হাওরগুলোর মাঝে মাঝে হিজল গাছের ছড়াছড়ি। এই গাছগুলোর সদর্পে দাড়িয়ে থাকার অর্থেই এ হাওরগুলোতে আছে প্রাণপ্রাচুর্যের অপূর্ব সম্ভার। ডিঙি নৌকাতে ভ্রমণ যেন স্বর্গীয় যান। আর খালি গায়ে স্নান, যেন আর্কিমিডিস হয়ে বনে যাওয়া।
তবে আধুনিকতার সব স্বাদই আছে এ হাওরগুলোতে। প্রায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক এভেইলএবল।
আফসোস, ক্লিওপেট্রা মতোই সুন্দরী টাঙুয়ার হাওরেই যাওয়া হলো না। সময়ের ঘোর মাতালে হলো না। তবে যাবো, নিজেকে সঁপে দেবো অকাতরে, অবলীলায়।
হাওর পাড়ের মানুষগুলো দাতা হাজি মুহসীনের মতো। আপনি কারো কাছে সাহায্য চাইবেন কিন্তু পাবেন না তা হবে না। অসম্ভব ভাল মানুষ এনারা। অসম্ভব হেল্পফুল।
রাত্রি কাটানোর অবলম্বন ছৈওয়ালা নৌকা। যদিও ইচ্ছে করেই এ পথ বেছে নেওয়া। নৌকা ভাসে, আমরা ভাসি। বৃষ্টির ফোটাগুলো যেন গায়ে পড়ছে! এমন সৌভাগ্য বুঝি আর হবে না। সৌভাগ্যের ফুলঝুরি এই ট্যুরটি আমার জন্য। শুধু মাছ মারার জাল নিয়ে নামতে পারিনি।
কিশোরি প্রেমিকাকে খুব মানুষই কাছে পায়। আমারও তাই। খুব অল্পক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে যাবো এই সুনামগঞ্জ থেকে। বাট আমি আছি, স্মৃতিতে।
শ্যামবাড়ি হাওর, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ
২.৩০ মিনিট