সাখাওয়াৎ আলম চৌধুরীর গল্প
” একটু পানি খাওয়ান তো!”
আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম,” ছোট বোতল নাকি বড় বোতল?”
” আরে বোতলের না! এমনি সাধারণ খাওয়ার পানি দেন।”
এতক্ষণ মেয়েটির কথা শুনালাম তাকে না দেখেই। দেখার সাথে সাথে চোখ ছানাবড়া। এতো সেই মেয়ে। যে প্রতিদিন এখান থেকে বাসায় যাতায়াত করে। আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। আর একারণেই তড়িঘড়ি করে জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসে করে তাকে দিলাম। মেয়েটি এক ঢোঁকে পানি শেষ করে ফেললো। আমি জানত চাইলাম আরো দিবো কিনা। মেয়েটি পানি শেষ করেই হাফ ছাড়লো। আর সাথে সাথে চোখ উল্টিয়ে বললো,” এতো গরম পানি! এটা খান কিভাবে?”
আমি তার প্রতিউত্তরে কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু অপলকে তার দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া।
প্রচুর গরমে একেবারেই ঘেমে গেছে সে। ঘামে তার চুলের গোড়ায় প্রচুর ঘাম জমে আছে। সেই সাথে চেহারা ঘামে থ্যাকথেকে হয়ে আছে। বয়স কত হবে? চৌদ্দ পনেরর বেশী হবেনা। এই বয়সের মেয়েদের আলাদা একটি লাবণ্য ধরা পরে চেহারায়। যতই গরম হোক না কেন সৌন্দর্য যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ে।
আমি তাকে জানালাম যে আমি তেমন পানি খাইনা। আমার কথা শুনেই মেয়েটি বলে,” আপনি না খেলে অন্যরা খাবে না। “
কথার পিঠে কথা বললো সে। খুবই ভালো লাগলো আমার।এরপর মেয়েটি আমাকে বলে প্রতিদিন যেন ফ্রিজে ঠান্ডা পানি রাখি। এতে মানুষের উপকার হবে। আর সে নিজেও মাঝে মাঝে খাবে।
মেয়েটির সহজ কথা আমাকে অভিভূত করলো। আমি একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে সম্মতির মাথা নাড়ালাম।এবার মেয়েটি সোজা গিয়ে তার বন্ধুদের সাথে বসলো।
যাত্রীছাউনির একপাশে আমার ছোট্ট দোকান। চট্টগ্রাম শহরের একটি ব্যস্ততম জায়গায় এই যাত্রীছাউনিটি। নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস এখানে পাওয়া যায়। সেই সাথে দৈনিক পত্রিকাসহ স্কুল কলেজের টুকিটাকি সবকিছুই পাওয়া যায়। যাত্রীছাউনিটির একপাশে দোকান। অন্য পাশে যাত্রী বসার জন্য লোহার একটি লম্বা চেয়ার।
ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ভাইয়ের দোকান চালাচ্ছি। ভাই বিদেশ চলে গেছে। তাই আমাকেই বসতে দোকানে। আমি এসেছি তেমন বেশিদিন হয়নি। আর বেশিদিন থাকবো সেটাও বলতে পারছি না। কেননা ভাইয়া খুব জোর চালাচ্ছে আমাকেও বিদেশ নিয়ে যেতে।
যখন থেকে এই দোকানে এসেছি, তখন থেকেই এই মেয়েটির উপর আমার চোখ পড়ে যায়।যদিও এখন পর্যন্ত পছন্দ করার মতো কোন মেয়ে খুঁজে পাইনি। কিন্তু এই মেয়ের দিকে চোখ পড়ার বিশেষ কারণ তার চঞ্চলতা। বন্ধুর সাথে হইহুল্লোড় ইত্যাদি।
যে জায়গায় আমার দোকান তার কিছু দূরেই টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ। সেই সাথে চট্টগ্রাম ভার্সিটি যাওয়ার রেলস্টেশনও খুব নিকটে।
মেয়েটি সেই টেকনিক্যাল স্কুলে পড়ে বলেই মনে হলো। কেননা তার পোশাকই তার পরিচয় বহন করছে। তার দিকে দৃষ্টি যাওয়ার আরো বেশি কিছু কারণ অবশ্য রয়েছে। তার মধ্যে হলো সে আমার গ্রামেরই কিছু ছেলের বন্ধু। যারা প্রতিনিয়ত এই যাত্রীছাউনি থেকে যাতায়াত করে। চুয়েট ভার্সিটি আমার গ্রামের এলাকায় অবস্থিত। তারা সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন এখান থেকে চুয়েটের বাসে করে বাড়ি ফিরে।
বাড়ির ছেলেরা স্টেশনে আসলেই আমার সাথে যোগাযোগ করে। যেহেতু আমি শহরে থাকি, তাই তাদের কাছে এলাকার খবরাখবর পাই। তারাও খুব খুশি হয় আমার ব্যবহারে। তাদের সাথে সবসময়ই বন্ধু সুলভ আচরণ করি। সেইসাথে যখন যেমন সাহায্যের প্রয়োজন হয় তখনই তা দেওয়ার চেষ্টা করি।
এভাবে কয়েক মাস যায়। কথায় কথায় একসময় মেয়েটির খোঁজ নেয় আমি বাড়ির ছেলেদের কাছথেকে । তারা জানায় যে মেয়েটি খুবই ভালো। তার বাবা চুয়েটের সরকারি কর্মচারী। তারা এক ভাই এক বোন।
যেহেতু একজায়গায় প্রতিদিনই দেখা হয় চোখাচোখি হয়। তাই একসময় আমার আগ্রহ জন্মে তার জন্য। তাকে চুপিচুপি দেখতাম। তার মাঝে একধরনের সারল্য খুঁজে পেয়েছিলাম। তারা যে সময়টিতে আসতো তখন খুবই ব্যস্ত সময় বেচাকেনার জন্য। তারপরও তাকে না দেখলে কেমন জানি করে উঠতো হৃদয় মাঝে। এভাবেই আমার আকাংখা আমার ভিতরেই থেকে যায়।
আমি কাউকে কখনো বুঝতে দেয়নি। তবে মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার দূর্বলতা। কেননা প্রায়শই তার দিকে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়েছে অনেকবার। এতোদিনের চোখাচোখির পর হঠাৎ যখন পানি চাইতে আসলো। তখন নিজের মাঝেই একধরনের অন্যরকম অনুভূতির জন্ম নিলো।
আমার ভিতরে কেমন জানি অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলাম। অথচ তার সাথে আমার কিছুই হয়নি। বলতে গেলে একপেশে ভালো লাগা।
এটা শুধুই ভালো লাগা আর কিছু নয়। আমাদের প্রতিনিয়ত জীবন যাপনে অনেক কিছুই তো ভালো লাগে। ঠিক সেই রকম ভালো লাগাই তৈরী হলো আমার গহীনে। কিন্তু সেই ভালো লাগা কখন আমার ভিতরটাকে নাড়িয়ে দিলো সেটা কখনোই বুঝতে পারিনি।
ঐ দিনের পর প্রায় একসপ্তাহ তার সাথে চোখাচোখি হলেও কথা বার্তা আর এগোয়নি। ও বলেছিলো ঠান্ডা পানি রাখার জন্য। তাই ঐদিনের পর থেকেই আমি ওর জন্য ঠান্ডা পানি রেখেছিলাম ফ্রিজে। আমার বাড়ির ছেলেরা আসতো কথা বলতো, পানি খেতো। আর তারাই বললো খুব ভালো করেছেন আমাদের জন্য ঠান্ডা পানি রেখেছেন। আগেও তারা পানি খেতো কিন্তু সেটা ছিলো নরমাল পানি। কিন্তু তাদেরতো বলতে পারছিনা কার জন্য তারা এই ঠান্ডা পানি খেতে পারছে।
এভাবে একদিন নিজ গরজে সাহেদের কাছে জানতে চাইলাম তাদের এই বান্ধবী প্রেম করে কিনা। তারা জানালো যে তাদের জানামতে মেয়েটি এখনো কোন প্রেম করে না। তখন সাহেদ রহস্য করে আমাকে বলেছিল, “আপনি নদীকে পছন্দ করেন? “
আমি লজ্জ্বা পেয়ে বললাম, “না না তেমন কিছু না।এমনি বললাম। খুব হাসিখুশি একটা মেয়ে। তাই জিজ্ঞেস করা।”
সুমন জানালো যে নদী খুবই বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। তবে খুবই সরাসরি কথা বলে। তার কাছে প্রেম ট্রেম কখনো পাত্তা পায়না। এমনকি তাদের টেকনিক্যাল কলেজের এক ছাত্র তাকে প্রপোজ করেছিল। সে ঐ ঘটনাকে অনেক লম্বা করে ফেলে। যেহেতু ও স্কুলের ছাত্রী তাই অথরিটি বিষয়টা খুবই গুরুত্ব দেয়। এরপর থেকে কেউ ওর সাথে এব্যাপারে কথা বলতে সাহস পায়না।
তাদের কথা শুনে মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য তারা জানতে চেয়েছিল হঠাৎ এই কথা কেন বলছি। আমি অবশ্য তাদের বুঝতে দেইনি আমার দূর্বলতা। তবে তারা হয়তো কিছু বুঝতেও পারে। এভাবে দিন চলে যায় মাঝে মাঝে নদীর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়।
যখনই তার সাথে এমন কিছু হয় তখন আমি নিজের ভিতরে নিজে থাকতে পারি না। আমার কেন জানি অন্যরকম একটা অনুভূতি হতে থাকে । আমি বিশ বছরের তাগড়া যুবক। স্বাভাবিকভাবেই এই বয়সে এইসব একটু আধটু উঁকিঝুঁকি দিবে। কিন্তু আমি মনেহয় একটু বেশীই ভাবতে শুরু করলাম। এভাবে আরোও দিন যায় । আমি এখনো আশায় আছি আবার কখন সে আমার কাছে এসে পানি চাইবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।
তাই আমিও আস্তে আস্তে তাকে ভুলতে চেষ্টা করলাম। এই বয়সটাই এমন। কারো সাথে একটু কথা বললেই বা, একটু চোখাচোখি হলেই ধরে নেয় যে মেয়েটি দূর্বল। একটু আগবাড়িয়ে কথা বললেই হয়তো হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা বরই নির্মম। শুধু ভাবনাটুই সার।
একসময় চিন্তা করলাম ছোট ভাইদের মাধ্যমে একবার চেষ্টা করব নদীর সাথে কথা বলতে। কিন্তু নিজের আত্মসম্মানে লাগে। তাই ওদিকেও যেতে পারছি না। ওরা যখন আসতো তখন দুপুর গড়িয়ে যেতো। এসেই কমপক্ষে দশ বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো। আর ট্রাফিক জটে পরলে তো কথাই নেই। সে হিসাবে যথেষ্ট সময় পাওয়া যেত তাকে দেখার বা ভাব বিনিময় করার। ভাব বিনিময় কথাটা ভুল। আমার ভাব -ই আমার ভিতরে থেকে যেত। সেটা প্রকাশ করার তেমন সুযোগই পাচ্ছিলাম না।
আমার দোকানে পত্রিকার ফ্রি লিটল ম্যাগাজিন দুই টাকা করে বিক্রি করতাম। অনেকে কিনত আবার অনেকে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে ফেলত। আমি কিছুই বলতাম না। যেহেতু আমি এই গুলো টাকা দিয়ে কিনছি না। সেহেতু পড়লে পড়ুক। কি অসুবিধা। আমি চিন্তা করতাম যে প্রতিদিন এইখান থেকে যাতায়াত করে। সে আজকে অথবা কালকে ফ্রি পড়বে। কিন্তু সবসময়ই ফ্রি পড়তে যেকোন কারোরই লজ্জ্বা লাগবে।
আর হয়ই তাই। অনেকে ফ্রি পত্রিকা পড়ে নেয়। আমি কিছুই বলিনা। যারা এভাবে ফ্রি পড়া শুরু করে। তারাই আস্তে আস্তে আমার নিয়মিত গ্রাহক হয়ে যায়। বিষয়টি খুবই মজার। তো ছোট ভাইয়েরাও এসে ছোট ম্যাগাজিন গুলো পড়ত। ওরা বই নিয়ে সীটে বসে পড়ত। এভাবে ওদের দেখাদেখি নদীও ওদের থেকে নিয়ে পড়তে থাকে। যতটুকু সময় থাকতো ততক্ষণ পড়ত। গাড়ি চলে আসলে আমাকে ফেরত দিয়ে দিত।
যেকোন কারণে একদিন একটা বই সুমন চাইলো নিয়ে যেতে। আমি ওকে বইটি দিলাম। এরপরের দিন সাহেদ জানতে চাইলো আমি গতকাল যে বইটা দিয়েছি সেটা কাকে দিয়েছি। আমি বললাম তাকে সেটাতো সুমনকে দিয়েছি। কিন্তু সাহেদ জানালো সেটা নাকি সুমন নদীর জন্য নিয়েছে। এইকথা শুনে আমার ভিতরে একটা তৃপ্তি কাজ করতে লাগলো। আমার উজ্জ্বল চেহারা দেখে তারা হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে।
আমার অভিব্যক্তি দেখে সাহেদ বললো, ” ভাইয়া কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি। “
আমি বললাম” করো। “
“আপনি কি নদীকে পছন্দ করেন? “
সাহেদের সরাসরি প্রশ্নের কি উত্তর দিব তা ঐ মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যদি এড়িয়ে যায় তবে আমার উদ্দেশ্য সফল হবেনা। আর বলে দিলেও তারা কি মনে করবে। এটাই চিন্তা করতে লাগলাম।
তখনই সুমন হেসে হেসে বললো, “আসলে হয়েছে কি ও আপনার কথা আমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছে। আর কেন করেছে আপনি ভালো করেই জানেন। আপনি যে ওর প্রতি দূর্বল সেটা কিন্তু ও বুঝতে পেরেছে।
সাহেদ বললো, “আপনি যে ওকে চুপিচুপি দেখেন সেটা আমাদের বলল। আমরাও বললাম তাকে যে তোমার মতো মেয়েকে ভাইয়া দেখছে সেটাই তোর সৌভাগ্য।
আমি তাদের কথা শুধু শুনেই যাচ্ছি। আর হালকা হাসছি। কিন্তু আমার ভিতরে কি যাচ্ছে সেটা প্রকাশ করছি না।
এবার সুমন বললো, “ভাইয়া আমরা কিন্তু আপনার ব্যপারে সব বলে দিয়েছি। ও অবশ্য কিছু বলেনি। তবে আপনি সম্মতি দিলে আমরা চেষ্টা করতে পারি।”
সাহেদ বললো, “আপনি ভাইয়া লজ্জ্বা পাবেননা। এইসব ক্ষেত্রে লজ্জ্বা পেলে কিছুই করতে পারবেন না।
এবার আমি হেসেই বললাম, “তোমরা যতটুকু চিন্তা করেছ আমি কিন্তু ততটুকু ভাবিনি। আমি ওকে পছন্দ করতে যাব কোন দুঃখখে।
সাহেদ বলল, “ভাইয়া আপনি হয়তো আমাদের কাছে স্বীকার করতে লজ্জ্বা পাচ্ছেন। আমরা জানি আপনি ওকে পছন্দ করেন। আর পছন্দ না করলে আপনি কেন প্রতিদিন ওর দিকে তাকান?”
“ওর দিকে তাকালেই কি পছন্দ হয়ে যায়? “আবারও হেসে বললাম।
“না, পছন্দ হয়ে যায় না। তবে আপনি নদীকে ভালবাসেন সেটা কিন্তু সত্যি। আর সেটা আপনার চেহারা দেখে বুঝতে পারছি আমরা। “বললো সাহেদ।
সুমনও ওর কথায় সায় দিল। আমি পড়ে গেলাম ফাপরে। শেষ পর্যন্ত ওরা আমার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করেই ছাড়লো। কিন্তু আমি তাদের বললাম তারা যেন এখনই নদীকে কিছু না বলে। আরো কয়েকদিন যাক। আমিই তোমাদের বললো।
এভাবে আরোও কয়েক দিল। সারাদিন একা একা দোকানদারি করতে বোরিং লাগে। যদিও ব্যবসা করার মধ্যে একটা স্বাধীনতা আছে। সেই সাথে মজাও কিন্তু একা বলে কিছুই করতে পারি না। এদিকে ভাইয়া বিদেশে নেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভালো চাকরি পেলেই নিয়ে যাবেন। কেননা লেখাপড়া করে যেমন তেমন ভাবে বিদেশ যাওয়া যায় না। যাইহোক সুমনদের কথাগুলো আমার মনে বেশ লেগেছে। নদী আমার কথা জানতে চেয়েছে। কথাটা সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। তবে তারা আজ যাই করুক কখনো মিথ্যা বলবে না এটা নিশ্চিত ছিলাম।
তাই মনের অজান্তেই বারবার নদীর কথা মনে হচ্ছিল। সারাদিন ব্যবসা শেষে রাতে বাসায় ফিরি।বাসায় ভাইয়া ভাবী আর ছোট ভাইজি ভাতিজা। তারা আমাকে যথেষ্ট ভালবাসেন। প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার সময় দুই ভাইপো ভাতিজির জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যায়। কিন্তু ইদানীং মন যে কোথায় চলে যায় । কারো জন্য কিছুই আনা হয় না। বাসায় ঢুকতেই তারা ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু কয়েকদিন যাবত তারাও আর আসেনা। কেননা তাদের জন্য কিছু আনিনা। আমার এমন অবস্থা দেখে ভাবী জানতে চাইলো আমার কোন সমস্যা কিনা। আমি জানালাম যে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মনের ভিতরে কি চলছে সেটা ভাবী হলেও তাকে বলতে পারছিনা।
ভাইয়া হঠাৎই জানালো যে আমার জন্য একটা ভালো চাকরি পেয়েছে দুবাইয়ে। খুব ভালো সেলারি। আর খুব শীঘ্রই ভিসা হয়ে যাবে। আর ভিসা হয়ে গেলেই দ্রুত চলে যেতে হবে। এতো ভালো চাকরি সহজে পাওয়া যায় না। কোম্পানির নাকি দ্রুত লোক দরকার। তাই ভাইয়া বললো খুব দ্রুত যা যা দরকার কেনাকাটা সেরে ফেলার জন্য। সেইসাথে দোকানের হিসাবও দিতে বললো। কিন্তু আমার এইসব কেন জানি ভালো লাগছিলো না।
ইদানিং ঘুমও একদম হচ্ছে না। প্রতিদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম নামক জিনিসটি মোটেই ধরা দেয়না চোখে। বরঞ্চ বারবার নদীর কথা মনে হতে থাকে। এই বয়সের এটাই একটা দোষ। কিছুতেই তার কথা মন থেকে সরাতে পারি না। তার হাসি, তার চাহনি, তার সবকিছুই আমাকে কেমন যেন মোহিত করে ফেলে প্রতিনিয়ত।
এভাবেই আরো কয়েকদিন যাওয়ার পর সুমন সাহেদরা এব্যাপারে আর কিছুই বললো না। অথচ আমি শুনতে উদগ্রীব ছিলাম। তাদের অনিহা দেখে আমারো সাহস হলোনা কিছু বলার। মনে মনে নদীকে ঐ জায়গায়ই কবর দিয়ে দিলাম। আর নিজের প্রতি নিজেই বিদ্রুপ করতে লাগলাম। কেন ছোট ভাইদের সাহায্য নিলাম না। আর এভাবেই আস্তে আস্তে যখন নদীর নিশানা মুছে ফেলতে চাইলাম ঠিক তখনই একদিন দেখি নদীকে আমার সামনে।
খুবই হাসিমাখা মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার তাকানোর ভঙ্গি এমন, মুখে কিছু না বললেও চোখ ঠিকই কথা বলছে। আমি তো অবাক! আবার চিন্তা করলাম হয়তো প্রয়োজনে এসেছে। আমার ধারণাকে সত্যি করেই ও খুব সুন্দর কন্ঠে পানি খেতে চাইলো। আমিও সাথে সাথে ফ্রিজ থেকে পুরো বোতল তুলে দিলাম হাতে। আমার কান্ড দেখে ও সেই একই রকম হাসি দিয়ে বলল, “কি ভাইয়া বোতল দিয়েই খাব? নাকি গ্লাস দিবেন।”
“ও সরি!” বলেই তাড়াতাড়ি করে গ্লাস ধুয়ে তাকে দিলাম। ও খুব শান্ত ভাবে গ্লাসে পানি ঢেলে পান করল। দেখে মনে হলোনা যে ও তেমন তৃষ্ণার্ত। আমি ওটা চিন্তা করলাম না। আমি চিন্তা করলাম তার সাথে কিভাবে কথা আগানো যায়। তাই বলে ফেললাম, “আজ আপনি পানি নিয়ে আসেননি?”
ও পানি শেষ করে বললো,” না, পানি আনতে ইচ্ছে করেনা। তারপরও মা প্রতিদিন জোর করে বোতল আনার জন্য। কিন্তু আমার মোটেই ভালো লাগেনা বাচ্চাদের মতো প্রতিদিন বোতল নিয়ে আসতে। “
তারপর নিজে নিজেই একটা রহস্যের হাসি দিয়ে বললো, “তাছাড়া বোতলের পানিতো গরম হয়ে যায়। আপনার এখানেতো ঠান্ডা পানিই খেতে পারি। তাই ঠিক করেছি বোতল আর আনব না। “একথা বলেই একটু মুড নিয়ে বললো, “আবার আপনি কিছু মনে করবেন নাতো!”
“আরে না না। এখানে মনে করার কি আছে।কারো উপকার করতে পারছি এটাই অনেক বড় পাওয়া।”
“তাহলে তো ভালোই হল। প্রতিদিন এসে আপনাকে বিরক্ত করব।”
“আপনার এই বিরক্ত করাটা হাসিমুখে মেনে নিব।”
“আচ্ছা আসি তাহলে, গাড়ি চলে এসেছে।” বলেই খুব দ্রুত চলে গেল নদী। আর আমার বুকে বয়ে চলতে লাগল শান্ত শীতল জলধারা। আমি যেন নই এ ভূবনের বাসিন্দা।
হঠাৎই আমার চেনা ভূবন হয়ে গেল অচেনা। মনের ভিতর অহর্নিশ তার কল্পনা। আস্তে আস্তে নদী আরোও সহজ হয়ে এলো। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। বই নিয়ে যায়। পত্রিকা পড়ে। এভাবে চলছিল। আর আমি শুধু মুগ্ধ নয়নে তাকেই দেখে যেতাম। অবশ্য নিজের দূর্বলতাটা তাকে কখনো বুঝতে দেইনি। নদীর সাথে যখন কথা হত বা দোকানে আসত তখন সুমন সাহেদরা একটু তফাতেই থাকতো। হয়তো তারাও বুঝতে পারত। তাই আমাকে সুযোগ দিত।
যখন দেখল আমি মোটামুটি নদীর সাথে ভালোই সময় পার করছি, তখন তারাও বিষয়টা মেনে নিল। এভাবে যখন দিনগুলি চলছিল তখনই একটা ঘটনা ঘটলো।ঐ ঘটনার আগে থেকেই টেকনিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সাথে প্রসাশনের কি একটা বিরোধ চলছিল। এসবের মধ্যে একদিন দুপুরে প্রচন্ড গন্ডগোলের আওয়াজ পেলাম। রাস্তায় যে যেদিকে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। দেখি টেকনিক্যালের ছেলেরা দোকান-পাট যা পাচ্ছে ভাংচুর করছে। তাই আমিও তাড়াতাড়ি দোকানের একপার্ট বন্ধ করলাম। একটা সোকেজ ছিলো সেটাও তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকালাম। যেহেতু দোকান খুবই ছোট। সবকিছু ঢুকিয়ে রাখলে তেমন বিশেষ আর জায়গা থাকে না। আমি একটা অংশ বন্ধ করে আরেকটি অংশ খোলা রেখে দেখতে থাকলাম কি ঘটেছে আসলে। দেখি প্রথমে প্রচুর ছাত্র ফুটপাতের দোকান সহ যা সামনে পাচ্ছে ভাঙা শুরু করছে। শুরু করছে বললে ভুল হবে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতেই এদিকে আসছে। স্টেশনে অনেক লোকজন ছিলো। তারা এই অবস্থা দেখে হালকা হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক ঐ মুহূর্তেই পুলিশ চলে এলো। পুলিশ এসেই এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ। কে ছাত্র কে সাধারণ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। ঠিক ঐ অবস্থায় সবাই পালাচ্ছে। আমিও তাড়াতাড়ি দোকানের যে অংশ খোলা ছিলো তা বন্ধ করে ভিতরে ঢোকব, কিন্তু চেয়ে দেখি হুড়াহুড়ি মধ্যে নদী। সে উদ্ভ্রান্তের মতো আমার দোকানের দিকে ছুটে আসছে। তার দিকে চোখ পড়তেই আমি দোকান বন্ধ করলাম না। অপেক্ষা করলাম তার না আসা পর্যন্ত। এদিকে খুবই হুলুস্থুল চলছে। ও আসামাত্রই ওকে দোকানে ঢুকিয়ে আমিও দোকানে ঢুকলাম। সাথে সাথে সাটার টেনে দোকান বন্ধ করলাম।
এমন পরিস্থিতি আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বিচিত্র টেনশনে আমার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। এদিকে নদীও ভয়ে টেনশনে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। আর তার সমস্ত গরম শ্বাস এসে লাগছে আমার বুকে। কেননা দোকান স্বাভাবিকভাবেই ছোট। সব জিনিস ঢুকিয়ে রাখলে এখানে কোন জায়গায়ই থাকেনা। তার উপর আমরা দুটি মানুষ। তাই একেবারে ল্যাপ্টে না গেলেও যথেষ্ট মুখোমুখি অবস্থান আমাদের। বাইরে অসম্ভব ধরনের ধরপাকড় চলছে। অনেক ছাত্র বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিলো। তাদের বের করে এনে আচ্ছামত ধোলাই দিচ্ছে। এই হুড়াহুড়িতে দোকানের আশপাশে থেকে প্রচুর লাঠিচার্জের শব্দ আসছে।
কিন্তু সবকিছু ভুলে হঠাৎই আমার বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ শুরু হয়ে গেল। নদীর এক একটি শ্বাস আমার হৃদয়ে এক একটি প্রশ্রবন তৈরি হতে লাগল। আমি অন্য এক অজানা রাজ্যে যেন হারিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ওর অস্থির নড়াচড়ায়, ও খুব সহজেই আমার গায়ে লেগে যাচ্ছে।বাইরের এমন পরিস্থিতিতে যখন ভিতরে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন নিজেকে কি বলে শান্ত রাখবো ভেবেই পাচ্ছি না।
একসময় অতিরিক্ত টেনশনের কারণে ও প্রচুর ঘামতে শুরু করে। ওর হিরক বিন্দুর ঘাম গুলো কেমন করে যেন আমার বুকে এসে পড়তে লাগল। ওর ঘামে আমার বুক একেবারেই শীতল হয়ে উঠলো। ওর সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। এভাবে কিছুক্ষণ যেতেই শুরু হলো আবার দৌড়ঝাঁপ। তবে এবার পুলিশ নয়। পুলিশ যখন অন্যদিকে চলে যায় তখন লুকিয়ে থাকা ছাত্ররা শুরু করে আবার ভাংচুর। তাদের থাবা পড়তে থাকে আমার দোকানের সাটারে। এতো প্রচন্ড শব্দ হয় যে কান ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। আর ভয়টা এতো বেশি যে একসময় নদী চলে আমার বুকে। খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আমাকে। আমি বাইরের কিছুই চিন্তা করতে পারছিনা। তখন আমার ভিতরে সাইক্লোন বইছে। ওর শরীর থেকে ঘাম জড়ানো একধরনের নোনতা গন্ধে আমি কোথায় হারিয়ে যায় নিজেই জানি না। শুধু এতটুকু অনুভব করতে পারি দুই জায়গায় হতেই একটি শব্দ হচ্ছে। ধুকপুক ধুকপুক ধুকপুক।
এই ঘটনার পর বেশকয়েকদিন নদী স্কুলে আসেনি। সুমনদের মুখে শুনলাম ওদের টেকনিক্যাল কলেজের প্রচুর ছেলে আহত হয়েছিল ঐদিন। যদিও ওদের কিছু হয়নি কারণ ওদের নিরাপদ দূরত্বে ছিলো মারামারির থেকে। ঐ ঘটনার পর নদীও আসছে না। তারা জানতেই পারেনি কি ঘটেছিল এখানে। তবে সুমন ফোন করেছিল ওর বাসায়। যেহেতু ঘটনার দিন নদীও ছিলো ক্যাম্পাসে। পরে তাদের জানানো হয় নদী ভালো ভাবেই বাসায় ফিরেছে। তবে ঐদিনের পর থেকে কিছুটা অসুস্থ তাই স্কুলে আসছে না। আমিও তেমন কিছুই জানতে চাইনি নদীর ব্যাপারে। কেননা আমি জানি ও ভালো মতো বাসায় পৌঁছেছে। কারণ আমিই ওকে ঐদিকে গাড়িতে তুলে দিই। বাসায় পৌঁছে ফোন করতে বলি। আমার কথা রাখে ও। তাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম ওকে নিয়ে।
তবে একদিকে যেমন নিশ্চিন্ত ছিলাম, অন্যদিকে ততটাই অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলাম ওকে নিয়ে। ও আমার প্রতিদিনের সাধারণ জীবনকে কেমন করে পাল্টে দিল। ওর সাথে থাকা সেই একান্ত সময়গুলো আমাকে বারবার ফ্লাশব্যাকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। ওর শরীরে সেই কিশোরী ছেড়ে নারী হওয়ার গন্ধ এখনো আমার নাকে এসে স্পর্শ করে। তার ঘাম মিশ্রিত পারফিউমের গন্ধটি এখনো আমার শার্টে লেগে আছে। আমি তাকে সযত্নে রেখে দিয়েছি। প্রতিটি রাতে তার সুগন্ধ আমি নিই। তার সেই সুগন্ধময় স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
কিন্তু আজ কয়েকদিন হয়ে গেল তার দেখা নেই। সে কি সত্যি অসুস্থ, নাকি অন্যকিছু? তার জন্য কেন মনটা খাখা করতে থাকে। একদিন সব খরাতপ্ততা মিটিয়ে সে এসে হাজির। তবে আজ স্কুল ছুটির অনেক আগেই চলে এসেছে সে। এসেই সোজা আমার দোকানের সামনে। তার চেহারায় যথেষ্ট লজ্জ্বামাখা লাবন্যতা ধরা পড়ছে। আগের সেই কাটকাট দৃষ্টির চাহনি আর নেই। তার অবয়বে কিছু একটা স্বীকার করার প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করছি।
এসেই ধন্যবাদ জানালো ঐদিনের জন্য। আমিও হাসিমুখে জানায় যে এটা আমার দ্বায়িত্ব ছিলো। আপনার জায়গায় যেকোন কেউ হলেই তাই করতাম।
ও বলল, “কিন্তু অন্য কেউ হলে কি আপনি তাকে আপনার বুকে জায়গায় দিতেন?”
এবার আমার হাত পা হঠাৎই কাঁপতে শুরু করেছে। কি বলছে এই মেয়ে।আমার প্রচুর ঘাম শুরু হয়ে গেল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না তার এই কথার উত্তরে কি বলা যায়। কেননা কখনো কোন মেয়ে এইভাবে সরাসরি এই কথা কাউকে জিজ্ঞাসা করবে না। আর যদিও বলে কতটুকু বিশ্বস্ততা নিয়ে বলতে পারে? আমার মুখ পুরো পানসে হয়ে গেলো। হয়তো সে সেটা বুঝতে পেরেছে।
তাই আমার দিকে না তাকিয়েই বললো, “আপনি যা করছেন অন্য কেউ হলে তা করতো না। আর করলেও সুযোগ নিত। আর যেকোন সুযোগ নেওয়ার যথেষ্ট সময় ও পরিস্থিতি ছিলো।”
আমি কিছুই বলতে পারছি না। শুধু তার কথা শুনে যাচ্ছি। দেখি ও কোথায় গিয়ে শেষ করে। ও বলেই যাচ্ছে, “আমি জানি আপনি আমাকে পছন্দ করেন।”
এইকথা শোনার পর আরতো স্থির থাকা যায় না। আমার মাথা দিয়ে হঠাৎই প্রচন্ড বেগে হাওয়া বের হতে লাগল। কান দুটো গরম হয়ে উঠলো। আমি আর কিছুতেই তার দিকে তাকাতে পারছি না। আমার মনে হলো আমার সবকিছু শেষ। এই মেয়েতো জায়গা বরাবর হাত দিয়ে ফেলেছে। তারপরও অপেক্ষা করতে লাগলাম আমার কিছু বলা লাগে কিনা।
দেখি ও বলেই যাচ্ছে ওর মতো করে, “আপনার হাবভাব দেখেই আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম আপনি আমার প্রতি দূর্বল। তাই সুমনদের কাছে জানতে চাইলাম আপনার সম্পর্কে। তারা আমাকে সব বলেছে।”
আমি মনে মনে বললাম সব বলেও একটা কথা ওরা জানে না। তাহলো আমি কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশ চলে যাচ্ছি।
নদী চোখ নামিয়ে ওর কথা বলছেই, “আপনি আমাকে ঐদিন আপনার একটা নাম্বার দিয়েছিলেন। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এইকয়দিনে। আমি আপনাকে ফোন করে আমার সিদ্ধান্তটা জানবো। আশাকরি সেই পর্যন্ত ভালো থাকবেন। আসি।”
বলেই মেয়েটি দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে গেল। ওদের বাস আসতে অনেক দেরি। কিন্তু ও সাধারণ বাসে উঠে পড়ল। আর আমার সমস্ত মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে ঘুরতে লাগল। আমি নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। ও কি বলে গেল।
এরপর থেকে আমার নাওয়া খাওয়া সব লাটে উঠলো। বাসায় ভাইয়া জিজ্ঞাসা করে আমাকে, “কিরে তোর এই অবস্থা কেন। কেমন উদাস উদাস হয়ে গেছিস। “আমি বলি, “না তেমন কিছু না এমনই।”
ভাবী বলে, “আরে উদাস হবেনা কিছু দিন পরইতো আমাদের ছেড়ে দুবাই চলে যাবে। তাই একটু মন খারাপ।”
“ও হ্যাঁ ভিসা চলে এসেছে। কদিন পরইতো কোরবানির ঈদ। আমি বলেছি একেবারে ঈদের পরে যাবে। ওরাতো চাইছে আরোও আগে যেতে। কিন্তু সামনে একটা ঈদ, আবার কখন এমন ঈদ কাটাতে পারবো। তাই আমি ঈদের পরপরই কনর্ফাম করেছি। তোর ভাবী বলল তোর সব কেনাকাটা শেষ। ভালো হয়েছে। দোকানের হিসাব ও দেখলাম সব ঠিক আছে।আমি একজনের সাথে দোকানের কথা বলেছি। হয়তো খুব দ্রুতই সব হয়ে যাবে। ” গুছিয়ে বললো ভাইয়া।
আমি কিছু না বলে সোজা ঘুমোতে চলে যায়। কিন্তু কোন ভাবেই ঘুম আসেনা। চোখের সামনে সবসময় নদীর স্নিগ্ধ মায়াবী নিষ্পাপ চেহারাটা ভেসে উঠে। আর আমি বিছানার এপাশ ওপাশ করতে থাকি।
নদী শেষ যাওয়ার তিন দিন পর একটা নাম্বার থেকে ফোন করলো আমাকে।
“কেমন আছেন?”
“ভালো।”
“কি করছেন?”
“কি করবো? যা সবসময় করি।”
“আচ্ছা আপনি আমাকে খুব খারাপ ভাবছেন, তাই না?”
“কেন?”
“এইযে ফোন করব বলে এতদিন ফোন করলাম না।”
“আরে না না, এতে খারাপ ভাবার কি আছে। হয়তো সময় করতে পারনি তাই কল করনি।”
“তো স্কুলে আসছ না কেন?”
“এমনি।”
“এমনি মানে?”
“এমনি মানে এমনি। দেখছি যে কেউ চিন্তা করে কিনা।”
“তো কি বুঝলে?”
“বুঝতে চেষ্টা করছি যে আমি কোন সিদ্ধান্ত নিলে ঠকবো কিনা।”
“এখানে ঠকার কি আছে?”
“তারমানে আপনি বলছেন আমি ঠকবো না!”
‘না, তুমি ঠকবে না।’
‘সত্যি!’
‘হ্যাঁ অবশ্যই সত্যি।’
‘তাহলে আপনাকে নিয়ে আমি কি কিছু ভাবতে পারি? ‘
‘অবশ্যই পার।’
‘অনুমতি দিচ্ছেন? ‘
‘আরে অনুমতি নেওয়ার আগেই তো তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ। তাহলে আর বাকি রইলো কি?’
‘তাহলে ……’
লাইনটা হঠাৎ কেটে গেল। আমি সাথে সাথেই কল দিলাম ঐ নাম্বারে। কল দেওয়ার সাথে সাথে নদী রিসিভ করলো।
‘ওহ সরি! মনে হয় ব্যালেন্স শেষ।’
‘আহহা এতে সরি হওয়ার কি আছে।’
‘আচ্ছা আজ আর কথা বললো না। এটা আমার একটা ভাবীর নাম্বার। আপনি এখানে আবার ফোন দিয়েন না। কেননা ভাইয়াটা ভীষণ বদ। যদি কখনো ভাইয়া ধরে ফেলে ভাবীর সমস্যা হবে। আমিই আপনাকে সময় করে ফোন দিব।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ঈদের আগে স্কুলে আসবে ……’
আমার কথা শেষ হবার আগেই লাইনটা কেটে দিল ঐদিক থেকে।
বুক থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। দীর্ঘশ্বাসটা প্রাপ্তির নাকি বিচ্ছেদের সেটা বুঝা গেলনা। কেন জানি বুকটা অনেক হালকা লাগছে। ইচ্ছে করছে দিগন্ত খোলা সবুজ ময়দানে, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে চীৎকার বলি, আজ আমি অনেক খুশি। এমন খুশি সব মানুষের জীবনে আসে কিনা জানিনা। তবে খুব কম সংখ্যক মানুষই এমন খুশি হতে পারে। প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতিটা সত্যিই অন্যরকম। কোন কিছুই এর বিনিময় হতে পারেনা।
আজ ঈদ। সবাই খুব খুশি। দিনটা এদিক ওদিক করেই কাটিয়ে দিলাম। ঐদিনের পর থেকে এখনো নদীর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আমি চাইলেও যোগাযোগ করতে পারছি না। একধরনের অস্থিরতার মধ্যে আমার সময়গুলো চলে যাচ্ছে। এদিকে সন্ধ্যায় ভাইয়া জানালো সবকিছু রেডি হয়ে গেছে দুবাই যাওয়ার। ঈদের দুদিন পরই আমার ফ্লাইট। আমার পুরো মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। জানতাম যেতে হবে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যেতে হবে সেটা কখনোই কল্পনা করিনি। ভাইয়াকে কিছু বলতেও পারবোনা। আমি কোথাও কোন আশা দেখছি না।
শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভুলে চিন্তা করলাম নদীর ভাবীর নম্বরের ফোন দিব। যাই থাকুক কপালে। ফোন দেওয়ার জন্য দোকানের কল করার মোবাইলটা খুঁজতে লাগলাম ড্রয়ারে। কিন্তু দেখি যে কিছুই নেই সেখানে। ভাবীর কাছে জানতে চাইলাম আমার সব মোবাইল কই? তিনি যা জানালেন তাতে মাথা আরোও খারাপ অবস্থা। ঈদের আগেই ভাইয়া আমার কাছথেকে সব হিসাব বুঝে নেয়। আমিও সবকিছু বুঝিয়ে দেই তাকে। কিন্তু উনি যে অন্য কাউকে দোকান দিয়ে দিবেন সেটা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করিনি আমি। ভাইয়া সবকিছু তার বন্ধু দিয়ে দিয়েছেন মাসিক ভাড়ার উপর। আমি তাড়াতাড়ি বাসা থেকে দোকানে যায়। কারণ নদীর ভাবীর নাম্বারটা দোকানের ফোনে সেভ করেছিলাম। দোকানে গিয়েই ভাইয়ার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করি দোকানের মোবাইলটা দেওয়ার জন্য। তিনি জানান যে তার নিজের আলাদা কলের সিম থাকার কারণে আমার সেই সিমটা কোম্পানি ডিসট্রিবিউটরকে দিয়ে দিয়েছেন। আমার মাথায় পড়লো বাজ। আজ ঈদ তাই সবকিছু বন্ধ। সিম এজেন্টের অফিস খুলবে আরো দুইদিন পর। তারমানে আমার আর কোন আশা নেই নদীর সাথে শেষ যোগাযোগের।
একবার চিন্তা করলাম সুমনদের সাথে যোগাযোগ করব। কিন্তু ওদের নাম্বারও ঐ মোবাইলে। এখন কি করা যায়। যাইহোক কাল সকালে গ্রামে যেতে হবে। গ্রামে গিয়েই ওদের সাথে যোগাযোগ করে নদীর খোঁজ নিব। এই চিন্তা করেই রাতে বাসায় ফিরলাম। তখন ভাইয়া বাসায় ছিলো। তিনি জানালেন আরো দুঃখের সংবাদ। আগামীকাল সবাই আসবেন আমার সাথে শেষ দেখা করতে। তাই কাল কোথাও যেতে বারণ করলেন। আর এও বলে দিলেন যে সবকিছু গুছিয়ে নিতে। যেহেতু পরশু ফ্লাইট সেহেতু হাতে সময় নেই বললেই চলে। আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। একদিকে আমার ফ্লাইট অন্যদিকে নদী। কোনটাকে ধরব কোনটাকে ছাড়বো।
বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি আমার আগেই নেওয়া আছে। আমি জানতাম খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে যেতে হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে যে নদীর সাথে কিছু হবে সেটা মোটেই কল্পনা করিনি। ওর ফোন পাওয়ার পর যতটুকু খুশি হয়েছিলাম আজ ওর বিরহে ততটুকুই ব্যথিত আমি।
আমার জীবনে এমন একটা ক্রান্তিকাল আসবে সেটা কখনোই ভাবিনি। কিন্তু আজ সেটাই হলো। গ্রামে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিতে হলো। তারপরও হাল ছাড়লাম না আমি। আমার পরিচিত বন্ধুদের মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম সুমনদের সাথে। কিন্তু ঈদের সময় কাউকেই বাড়িতে পাওয়া গেলো না। সবাই যার যার আত্মীয়র বাড়িতে। তাই কোনমতেই কিছুর কূলকিনারা করতে পারলাম না। এভাবেই আমার যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। যে আমি বিদেশ আসার জন্য এতো উৎফুল্ল ছিলাম। সেই আমি বিমর্ষ মুখে বিদায়