বেণুর বিয়ে
গতকাল ছিল বেণুর বিয়ে। মামার বাসায় বড় হওয়া একজন সাধারণ মেয়ের সাদামাটা বিয়ে। বর আর কনে পক্ষের কয়েকজন লোক, বেণুর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কোন হলে নয়, মামার ছোট্ট বাসাতেই ব্যবস্থা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ওর সাথে দেখা, বন্ধুত্ব। আমি গ্রামের ছেলে, সহপাঠীদের ভাষায় ক্ষেত। তর্ক করিনা; গ্রামের দিগন্ত বিস্তারী ক্ষেত থেকে উঠে আসা এক যুবকের নামে যদি ক্ষেতের সিলমোহর যদি লেগেই যায় – মন্দ কি। অর্থ-হীনতায়, আচরণের গ্রাম্যতায় হীনমন্যতায় ভুগি। বিদ্যায়, বুদ্ধিতে এমন কোন রশ্মির চমক নেই, যাতে কাউকে মুগ্ধ করতে পারি। তবু কিছু বন্ধু জুটে যায়। বেণু তাদের একজন। কাট কাট কথায় আমাকে অপদস্থ করার সাথে সাথে আমার প্রতি সহমর্মিতায় তার জুড়ি নেই। মাঝে মাঝে ভাবি, বেণুর কোন রূপটা সত্য। ওর চাহুনিতে মাঝে মাঝে অলৌকিক আলো খেলা করে। আমার হাত নিবিড় করে ধরে বলে, তোর আকাশে আমাকে কি চাঁদ হতে দিবি। আমি হো হো হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলি, সিনেমার ডায়ালগ দিবিনা। মনে মনে নিজের সাংসারিক দীনতার কথা ভাবি। ভাবি, যে আকাশ নিত্য মেঘে ঢাকা, সেখানে চাঁদের স্থান কই? চাঁদ থাকলেই কি আর না থাকলেই কি?
কখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ হয়ে যায়। একটা ছোটখাটো ব্যাঙ্কের অফিসার পদবীর কেরানীর চাকুরী পেয়ে যাই। শুরু হয় গতানুগতিক জীবন। বাবার অসুখের খবরে হঠাৎ করেই গ্রামের বাড়ী যেতে হয়। অজ পাড়া গাঁ। নাই রাস্তা ঘাট, নাই বিদ্যুৎ। এমনকি মোবাইলের আওতারও বাইরে। কি করে দশটা দিন কেটে যায়। বাবাকে কবরে শুইয়ে ফিরে আসতেই মেসের বন্ধুদের কাছে শুনি, একটা মেয়ে এসেছিলো আমার খোঁজে। নাম, ঠিকানা কিছুই বলেনি। ভেবে পাইনা, কে আসতে পারে। কোন মেয়েই আমার মেসের ঠিকানা জানেনা। এক বন্ধুর মুখে বেণুর বিয়ের খবর পাই। মোবাইল খুলে মিলে যায় বেণুর মিসড কলের লম্বা লিস্ট। বিয়েতে দাওয়াত দেবার জন্যেই বোধ হয় বেণুর ফোনের আধিক্য আর সেজন্যেই বোধ হয় আমার মেসে আসা – দুয়ে দুয়ে চার হিসেব মিলে যায়।
মনে মনে একটা বুদ্ধি আঁটি। বেণুকে একটা চমক দিতে হবে। আমার ফিরে আসার খবর ওকে দেবোনা। বন্ধুকেও মানা করে দেই, বেণুকে খবর দিতে। ভাবি, সরাসরি বিয়ের আসরে হাজির হবো।
অফিসের কাজের চাপে মেসে ফিরতে দেরী হয় প্রতিদিন। কি করে দুটো দিন চলে যায়, টের পাইনা। আজ বেণুর বিয়ে। একটু আগেভাগেই বের হই। তবুও যানজটে পড়ে বিয়ের আসরে পৌছাতে ঘণ্টা খানেক দেরী হয়ে যায়। বিয়ে হয়ে গেছে। কাজী সাহেব নব-দম্পতির কল্যাণে দোয়া পড়াচ্ছেন। আমি তড়িঘড়ি করে সামিল হয়ে যাই।
বিয়ে থেকে এসে কোনমতে কাপড়-চোপড় বদলিয়ে সরাসরি বিছানায় চলে গেলাম। গত কয়েকদিনের ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর আর চলতে চাইছেনা। কাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আজ একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে।
বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম থেকে উঠেই টেবিলের উপর নজর পড়লো। হুমায়ুন আহমেদের নীল অপরাজিতা। বইটা বেণুর দেওয়া, গতবার পয়লা বৈশাখে। তখনো ছাত্রী সে। মামার বাসায় অতিকষ্টে থাকে। মামার হাত খরচের টাকা দেবার সামর্থ্য নেই। রক্ষণশীল মামা বাইরে বেরুতে দেননা। দুটো হাইস্কুলের মেয়ে বাসায় এসে পড়ে। তাতে কোনমতে ওর হাত খরচের টাকাটা উঠে। তা থেকে কোনমতে বাঁচিয়ে বইটা কিনে উপহার দিয়েছে। বইটা তো সেলফে রাখা ছিলো। টেবিলে কে নামালো? কবে নামালো? নিশ্চয়ই মেস-মেট কারুর কাজ। কতবার বলেছি আমার অনুপস্থিতিতে আমার বই-পত্রে হাত না দিতে। মেজাজটা খারাপ হয় আমার।
বেণুর কথা বারবার মনে পড়ে। সে এতক্ষণে স্বামীর কর্মস্থল রাজশাহীর পথে। আলতোভাবে বইটা হাতে নেই। অজান্তে শেষ দিকের একটা পাতা খুলি। পাতাটার আন্ডারলাইন করা লাইনগুলোতে চোখ পড়ে।
“মাঝে মাঝে প্রকৃতি কি করে জান? মূল ডিজাইনের দুই অংশকে কাছাকাছি এনে মজা দেখে, আবার সরিয়ে নিয়ে যায়। প্রকৃতি চায়না এরা একত্র হোক।”
লাইনগুলো বেণুর হাতে আন্ডারলাইন করা। আমি বেণুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লাইনগুলো আন্ডারলাইন করলে কেন? বেণু উত্তর দিয়েছিল, সময় এলে বলবো।
বইটা সেলফে রাখতে গিয়ে ভেতর থেকে একটা ভাজ করা কাগজ মেঝেতে ঝরে পড়ে।
কোন সম্বোধন নেই। মাত্র কয়টা শব্দ।
তুমি কোথায়? কাল বিকেল তিনটায় মোহাম্মদপুর কাজী অফিসে কি একটু আসতে পারবে?
উত্তরটা আমি পেয়ে গেছি বেণু। বিড় বিড় করে বলি আমি।
সিডনী, ১৪ মার্চ, ২০১৪