পুরুষ বন্ধু' রা আমার …
….শিরোনাম টা নিজের কাছেই বড় বেমানান ঠেকছে! বন্ধু বন্ধুই, তার আবার ছেলে মেয়ে কি! কিন্তু উপায়অন্ত না দেখে এমন একটা শিরোনাম দিতে হলো, লৈঙ্গিক পরিচয় টানতে হলো সম্বোধনে। শিক্ষাজীবনের সবটুকু অথবা কোনো এক বা একাধিক পর্যায়ে সহশিক্ষা মাধ্যমে আমরা সবাই পড়েছি কম বেশি। খুব অবাক হয়ে আজকাল লক্ষ্য করি নারী নির্যাতন বিষয়ে একসময়ের ক্লাস নোট্, সাজেশন থেকে শুরু করে আড্ডায় হাসি আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া কিছু পুরুষ বন্ধু/সহপাঠী আহত হবার মত মতামত দেয়! এদের একটা অংশ হলো (সবাই না) যারা একটা বিশেষ বয়সে এসে (মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পরবর্তী খন্ডকালীন বেকার জীবনে এবং কেউ কেউ প্রেমঘটিত বিষয়ের ফলাফল স্বরূপ) আচমকা ধর্মের প্রতি অতিমাত্রায় মনোনিবেশ শুরু করে এবং নারী নির্যাতনের ঘটনায় নারীদের দিকে সবার আগে আঙ্গুল তোলে। জীবন যাপনে ও বিশ্বাসে খুব একটা ধর্মের ধার ধরে না, এমন অনেক পুরুষও এই একটা বয়ানে তাদের সাথে কন্ঠ মেলায় ! ধার্মিক, সে যেই কারণেই হোক, তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, ভালো পথে বদলে যাওয়া ভালো, তবে চিরতরে আলো আটকে যায় এমন পর্দা নিজের ঘরে দিও না, ঘরে জীবানু জন্মাবে আর একদিন কুরে কুরে খাবে তোমাকে। সব দোষ মেয়েদের ঘাড়ে চাপানো সেই সব পুরুষ দের জন্যই এই লেখা টা …
তোমার জন্ম হওয়ার জন্য একজন বাবা ও একজন মা এর দরকার ছিল । আমার ও তাই । তুমি ৯ মাস মায়ের জঠরে ছিলে, আমিও । তোমার মতই আমারও জীবনের প্রথম খাদ্য মাতৃদুগ্ধ । যে সূর্যের আলোয় হাত পা ছুড়ে খেলেছ তুমি, আমাকে প্রকৃতি বঞ্চিত করেনি তা থেকে মোটেও । যে বিকেল তোমার দুরন্ত শৈশবে ফুটবল কে করেছিল তোমার সবচেয়ে আপনজন, যে গোধুলী তোমার কিশোর মনে অজানা স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল, সেই শৈশব কৈশোরের স্বাদ আমিও নিয়েছি কানামাছি, সাত চারা খেলে, ঘাস ফড়িং এর পেছনে ছুটে । তুমি স্কুল এ গেছ, আমিও। তুমি সহপাঠীর সাথে ঝগড়া করেছ, আমিও কম করিনি কিছু । তুমি যখন ক্লাস হবে না জেনে দেয়াল টপকে আইসক্রিম খেতে গিয়েছ, আচমকা রিপ্লেসমেন্ট টিচার এসে পড়লে তোমার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম আমি, স্যার ও তো অসুস্থ্য, একটু ম্যাডিকেল রুম এ গেছে । বিনিময়ে চকলেট এর ভাগ দিয়েছিলে তুমি আমাকে ! বলেছিলে থ্যাংস দোস্ত, ধরা খেলে খবর ছিল !
আমরা তো এভাবেই বড় হয়েছিলাম । স্মৃতি হাতড়ে দেখো তো, ব্যতিক্রম কিছু পাও কি না ?
জন্মগত ভাবে দু টি লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে আমরা জন্মেছি, তুমি ছেলে আর আমি মেয়ে । এই দুটো পরিচয় এর নিজস্ব অর্থবহতা আছে । দুটো পরিচয় ই আপন মহিমায় উজ্জল, দুটো পরিচয়ের সম্মিলন ই হাজার বছরের সৌন্দর্য, দুটো পরিচয়ের ভিন্নতাই এর স্বার্থকতা । “তোমার মত আমি” বা “আমার মত তুমি” হওয়া সম্ভব বা উচিত না সব ক্ষেত্রে । প্রকৃতি কিছু ভিন্নতা দিয়ে দেয় যাকে সম্মান করতে হয়, তাকে ধারণ করতে হয় আর এই “সম্মানজনক ধারনেই” আত্মগৌরব । যেমন ধর, সাধারণত (আবার ও বলছি সাধারণত) রাস্তায় গাড়ি টি খারাপ হয়ে গেলে তুমি ই এগিয়ে আসবে ঠেলতে , কেন না উপযুক্ত প্রশিক্ষণ / অনুশীলন ছাড়া একটা ভারী জিনিসে বল প্রয়োগ করা একটি মেয়ের শরীরে স্থায়ী ক্ষতি টেনে আনতে পারে, পুরুষের ক্ষেত্রে তার মাত্রা অনেক কম, তাছাড়া শক্তি তে তুমি ই এগিয়ে । আবার ধর, তুমি মাথা খুটে মরলেও মা হতে পারবে না কোনো দিন, তাই তোমার রক্তের অংশীদার পৃথিবীতে আনতে তোমার পাশে চাই একজন নারী ।
প্রকৃতি বৈচিত্র্য পছন্দ করে । প্রকৃতি এই ভিন্নতা দিয়ে রেখেছে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য। লৈঙ্গিক পরিচয় টি তোমার বা আমার অন্য সব পরিচয়ের মতই একটি পরিচয়। এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো – তুমিও মানুষ, আমিও । তুমি কারো সন্তান, কারো ভাই, আমারও জন্ম -বেড়ে ওঠা তোমার মতই একটি পরিবারে । তুমিও অ আ ক খ পড়েছ, আমিও । তোমার ও ক্লাস এ একটা রোল নম্বর ছিল, কিছু বন্ধু ছিল, আমার ও । তোমার আর আমার পরীক্ষার সিলেবাস প্রশ্নপত্র একই ছিল, তুমিও একটি একটি করে ধাপ পার হয়েছ, আমিও । ক্যান্টিনে তুমুল আড্ডা দিয়েছ তুমি, আমিও কম দেইনি কিছু। বিতর্কের মঞ্চ কাঁপিয়েছি প্রবল যুক্তির দাপটে, একই দলে …
বন্ধুরা আমার, সেই তোমাদের ই কেউ কেউ যখন আজকে পত্রিকায় ধর্ষণ এর খবর পড়ে বলে ওঠো – মেয়েদের উচিত অন্ধকার নামলে বের না হওয়া, ওই মেয়েটির পোশাক আশাক ঠিক ছিল না অথবা বোরখা কিংবা হিজাব ই পারে মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে … শুধু তাই না তোমরা কেউ কেউ নিজেদের সঠিক প্রমান করার জন্য বানোযাট পরিসংখ্যান নিয়ে হাজির হও .. মুসলিম রাষ্ট্র গুলোতে নাকি ধর্ষণ এর সংখ্যা সবচেয়ে কম … আমার তখন তোমাদের বলতে ইচ্ছে করে – Don’t teach me What to wear, When to travel, Whom to go along with or How to live my life … instead just teach your BROTHERS / FRIENDS not to RAPE!!!
আমার শুধু মনে হয়, অত্যাচারিত কে আরেকবার দলগত ভাবে আক্রমন কর তোমরা, তোমাদের নিকৃষ্ট ব্যভিচারী অন্তর্গত সত্বা দিয়ে । তোমাদের কে আমার কিছুমাত্র কম অপরাধী মনে হয় না । প্রসঙ্গত, নিহত ডাক্তার সাজিয়া রহমান ইভা হিজাব পরতেন, এশার নামাজ শেষ করার পর তার দরজার কড়া নাড়ে ঘাতক । কি ? তোমাদের ক্রিমিনাল সত্ত্বার সেল্ফ ডিফেন্সিভ যুক্তির দু গালে দুটো চড় পড়েছে ?? কি বলছ! আমি যে শব্দ শুনলাম !!
তার অর্থ এই না আমি অশালীনতা কে সমর্থন করি । উগ্র জীবন যাপন , সে পুরুষ কিংবা নারী সবার জন্যই সমান ধিকৃত হওয়া উচিত । সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা ও রুচিবোধের মানদন্ডে হিন্দি সিনেমার নায়িকার মত আংশিক বসন পরে ঢাকার রাস্তায় হাটা যে বেমানান তা তুমি যেমন বোঝো, আমিও বুঝি। তুমি তা অপছন্দ করতে পার, তাই বলে কারো পোশাকের দোহাই দিয়ে কেউ আক্রমন করলে তুমি তাকে সমর্থন করতে পার না। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ যা, তা হলো ঘটনা, পরিস্থিতি না জেনে না বুঝে তোমরা কেউ কেউ যখন ঢালাওভাবে মেয়েদের উচিত অনুচিত নিয়ে একপেশে লেকচার দাও। তোমাদের জন্য আমার তখন বড় করুনা হয়। তোমরা শিক্ষিত হয়েছ, মানুষ হও নি ।
এই দিন , এই রাত , এই আকাশ .. তোমার ও … আমার ও । তুমি সীমা নির্ধারণ করতে পার না আমার চলাচলের, আমার ঠিক-ভুল এর বিধাতাও তুমি নও। প্রকৃতি আমাকে এতটুকু বঞ্চিত করেনি তার রূপ রস বর্ণ থেকে … তোমার এত বড় আস্পর্ধা হয় কি করে, লজ্জায় মাথা নত না করে উল্টা নর্দমার আবর্জনাসম যুক্তি নিয়ে আস ধর্ষকের পক্ষে ? কোনো বিবেচনায় .. কো – নো বিশ্লেষণেই কি ধর্ষণ সমর্থনযোগ্য ?
বন্ধু, শুধু শিক্ষিত হলেই হয় না … মানুষ হতে হয় । মানুষ হও প্লিজ !