নববর্ষে প্রবাসে বাঙালির নবজাগরণের উৎসব
বাংলা নববর্ষের আবাহনে মেতে উঠেছেন প্রবাসী বাঙ্গালীরা, উৎসব আয়োজনে মতোয়ারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। বাঙালির জীবনে এ উৎসব আনন্দ হাজার বছরের পুরনো। পুরাতন বছরকে বিদায় জানানো হয় চৈত্রসংক্রান্তির নানা আয়োজনে। সাড়ম্বরে আসে নতুন বছর- বাংলা নববর্ষ, হাজার বছর ধরেই চলে আসছে, এ পহেলা বৈশাখ… পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে। নতুনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন চলে গ্রামবাংলায়, কখনো সামাজিক, কখনো ধর্মীয়, কখনো বাণিজ্যিক, কখনো বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য প্রচলিত একটি পদ্ধতি ও সময়কাল হলো এ বাংলা বর্ষ পরিক্রমা। সাধারণত দিন, সপ্তাহ , মাস, বছর এর নাম দিয়ে এ বর্ষপুন্জির ধারাবাহিকতা। একেকটি তারিখ, একেকটি পদ্ধতির মধ্যে একক, নির্দিষ্ট দিনের উপাধি, সূর্য বা চাঁদের চক্রের সঙ্গে সুসংগতি রেখে ( যেমন-বছর ও মাস হিসেবে) ক্যালেন্ডারের সময়কাল নির্ধারিত হয়ে আসছে, সাধারণত অনেক সভ্যতা ও সমাজে তাদের নির্দিষ্ট চাহিদা উপযোগী করে তৈরী হয় এ বর্ষপুন্জি।
বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য, খাদ্যাভ্যাস ও ব্যবসায়িক লেনদেন, সবকিছুর সঙ্গেই রয়েছে বৈশাখের যোগসূত্র। খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের অনেকটা দখলে চলে যায় বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের এ বর্ষবরণ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এর পর থেকে সাল-তারিখের অনেক হিসেব এখন খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে গননা করা হয়। তারপর ও ঋতু হিসেবে বাঙালি এখনও বাংলা ক্যালেন্ডারই অনুসরণ করে থাকে। গ্রীস্ম,বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের হিসাব বাংলা মাস ধরেই গুনা হয়ে থাকে। এছাড়াও বাংলা সন-তারিখের সাথে আবহমান সংযোগ রয়েছে আমাদের কৃষি ও জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে ’৫২ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, এবং ’ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সবকিছুই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছে এবং বাংলা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় নববর্ষ উদযাপন এখন গ্রাম আর শহরে সীীমাবদ্ধ থাকেনি, এমনকি সুদূর প্রবাসে ও এর ছোয়া লেগেছে। বর্ষবরণের আনন্দে, জীবনের হালখাতার নবায়নে, নতুন স্বপ্নে সাজানোর এ দিনে প্রবাসে ও নবজাগরণের উৎসবে মেতে উঠবে দলমত নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালী।
নববর্ষের উৎসবকে ঘিরে রয়েছে প্রায় আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতির্হ্য। এ সংস্কৃতির মর্মকথা ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের সাথে অনেকটা সংশ্লিষ্ট। সৃষ্টি ও সংহারে যখন বিশ্বনিখিল আবর্তিত, প্রতিনিয়তই অবশ্যম্ভাবী কিছু পরিবর্তন, তাকে গ্রহণ করে এবং তাকে ঘিরেই শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বর্ষবরণের আনন্দ। দেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক এ সর্বজনীন উৎসবের দিন এ নববর্ষ। যদিও বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্ম তেমন একটা উৎসবমুখর নয় বলে অনেক রক্ষণশীল মানুষ মনে করেন। তা সত্বেও বাঙ্গালীদের বিকাশমান বাঙ্গলা সংস্কৃতির আবাহ দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোড়িত হচ্ছে । ঐতির্হ্যগতভাবেই উদারপন্থী বাংলাদেশের মুসলমানেরা, তারা কখনোই কট্টরপন্থি নয়, বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী ভারতে সনাতন ধর্মাবলম্ভী তথা হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। মুসলমানদের মধ্যে ও এসব উৎসব- আনন্দ উপভোগের প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অনেক বড় পরিসরেই বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষ উৎসব পালিত হয়।
উল্লেখ্য যে, হিন্দু ক্যালেন্ডার আদ্যিকাল থেকে ভারতে ব্যবহৃত যা lunisolar ক্যালেন্ডার বা সৌর ক্যালেন্ডার হিসেবে পরিচিত। এতে কিছু সমষ্টিগত নাম, প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় হিন্দু ক্যালেন্ডারে সন্নেবেশিত হয়ে আছে। যদিও প্রচলিত আছে যে অতীত থেকে বর্তমান সময়ের প্রক্রিয়ার মধ্যে এগুলোতে অনেক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে এবং আরো বিশিষ্টপূর্ণ দিক হলো যে আঞ্চলিক হিন্দু ক্যালেন্ডার যেমনঃ বাংলা ক্যালেন্ডার, নেপালি ক্যালেন্ডার, অসমিয়া ক্যালেন্ডার, মালায়ালম ক্যালেন্ডার, তামিল ক্যালেন্ডার, তেলুগু ক্যালেন্ডার, এবং কন্নড ক্যালেন্ডারে এগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি ও ইতিহাস নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও এর সাথে তেমন কোন সংঘাত নেই অন্য কোন বর্ষপন্জির।
ইংরেজি শব্দ ক্যালেন্ডারে প্রতি মাসের প্রথম দিনের ল্যাটিন নাম , যা ছিল লাতিন শব্দ kalendae থেকে প্রাপ্ত,আর বাংলা ক্যালেন্ডারে মোঘল সম্রাট বাদশাহ আকবরের সময় তার এক ফরমান অনুযায়ী আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী উদ্ভাবিত বাংলা ফসলি সাল বা বাংলা নববর্ষ পরিক্রমা চালু হয়। তবে রাজা গৌড় ও শশাঙ্কের আমল থেকে বাংলা ক্যালেন্ডারের উন্নয়ন ও বিকাশ হয়েছে বলেও মত রয়েছে। সে হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় বা সরকারী ক্যালেন্ডার পশ্চিমী ক্যালেন্ডারের পুন্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল তারিখে পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ ১৪২১ পালিত হবে। বাংলা ক্যালেন্ডার (বাংলা: বঙ্গাব্দ Bônggabdô বা বাংলা সন) উদযাপনে সকল খাজনা আদায়, নববর্ষ (পহেলা বৈশাখ), নতুন হিসেব খোলা বা হালখাতা, ব্যবসায়িক সম্পর্ক পুনর্জীবন দান, ভোক্তাদের সাথে মধুর সম্পর্ক স্থাপনের মতো অনেক রীতিনীতি ও সংস্কৃতিই সাস্কৃতিক আধিপত্যের দাপটে হারিয়ে গেছে বা যেতে বসেছে।
সব অপ্রাপ্তিগুলোকে ভুলে গিয়ে, দেশে বিদেশে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের উষালগ্নে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েই বাঙালি এবার পালন করবে বৈশাখী নবজাগরণের উৎসব…
বাঙালি ঐতিহ্যের অহঙ্কার ও আত্মআবিষ্কারের এ প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছে বাংলাদেশ হেরিটেজ এন্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা (বেসা) সহ উত্তর আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সংগঠন। কানাডায় বেসার অনুষ্ঠান আয়োজক ও সংগঠকদের মধ্যে হাসান, টমাল, আহসান, আনাম, মাজহার, মাসুদ, ডলিন, ফারহাানা, সাবরিনা, আকাশ ও তায়িফদের কর্মপ্রচেষ্টায় এবার মনে হয় শহরবাসী ও অভিববাসী বাঙ্গালীরা মুহুর্তে ভুলে যাবেন প্রবাসজীবনের সকল কষ্ট ও বঞ্চনার কথা, পান্তাভাত, ইলিশমাছ ভাজা, কাচামরিচ, সুটকীভর্তা, ডাল ও রকমারি দেশী পিঠা খাবার লোভকে সামাল দিতে যখন ব্যস্ত এরই মাঝে ফোন পেলাম- শিশুকিশোরদের মনমাতানো নাচ গান আর বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই শুধু নয় এতে থাকবে মঞ্চমাতানো বাউল সঙ্গীত… তাই অধীর অপেক্ষায় রবো আগত নববর্ষের।
শান্তি এবং সহনশীলতার সংস্কৃতি ও এর চর্চা করে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাড়াতে পারে। শান্তি সংস্কৃতি রক্ষায় বৈশ্বিক আন্দোলনে আমাদের ইতিহাস, ঐতির্য্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতিই কেবল উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-
নববর্ষ এল আজি
দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;
আনেনি আশার বাণী,
দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়…
কালবৈশাখীর থাবায় যখন বিপর্যস্থ হয় দেশ তখন কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের শুনিয়েছেন আশার বাণী-
ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর…
গানে গানে আর ফুলে ফুলে, আলোর উদ্ভাসনে নতুনকে স্বাগত, অভ্যর্থনা জানাবে বিশ্বের ২১১ মিলিয়ন বাংলা ভাষাভাষি মানুষ এর পাশাপাশি কানাাডার আলবার্টা নিবাসী প্রবাসী বাঙ্গালীরাও। জীবনের পরিবর্তনে নববর্ষ নিয়ে আসবে সংহতি ও ঐক্যের বিশেষ অনুভূতি। পৃথক পৃথক শোভায় আর ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় নববর্ষ আমাদের মনোরাজ্যে সৃষ্টি করবে সুখের উল্লাস।
শুধু সাংস্কৃতিক উৎসবই নয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণার মূলে ছিল এ বর্ষবরণ এবং অমর একুশে। অতীতে শাসকগোষ্ঠী দিনগুলোকে পালনে যতই বাধা দিয়েছে, যতই বিরূপতা প্রকাশ করেছে, ততই বাঙ্গালী জেগে উঠেছে, ততই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। শেষ অবদি ’৭১ এ স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
নববর্ষের নতুন প্রভাত আলোকে আলোকে আমাদের উদ্ভাসিত করবে, তা যেন আমাদের মনের এবং বাইরের সকল সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতাকে দূর করে দেয়। আমরা যেন প্রকৃতির মতো উদার হতে পারি। আমাদের জীবন যেন সংগীতের মূর্ছনায়, পুষ্পের সৌরভে বিকশিত হয়, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠে নববর্ষের প্রেরণায় । নববর্ষে এই শুভ কামনা।
লেখকঃ দেলোয়ার জাহিদ, সভাপতি, বাংলাদেশ হেরিটেজ এন্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা, সম্পাদক- সমাজকন্ঠ, আলবার্টা ও সাস্কাচুয়ান প্রদেশের কমিশনার অব ওথস, সংবাদপত্রে নিয়মিত প্রবন্ধ, ফিচার ও স্তম্ভ লেখক। এডমোনটন সিটি নিবাসী।