গল্পকনিকা: রুমির রবীন্দ্রে বিরাগ
মানুষ রবীন্দ্র অনুরাগী হয়। রুমির ক্ষেত্রে কথাটা খাটে না। ওর রাগ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের উপর। বহুমুখী প্রতিভা নাকি ভদ্রলোকের। শুনেছে মানবিক সব অনুভূতি ও চরিত্রের সব দিক তার লেখনীতে নাকি প্রকাশিত হয়েছে। রুমি রবীন্দ্রসঙ্গীত যত শুনেছে রবীন্দ্রসাহিত্য ততো পড়েনি। স্কুলে পাঠ্য ছিল বলে ‘ছুটি’ গল্প পড়া। মামাবাড়ীতে আশ্রিত পিতৃহীন ছোট্ট ফটিক অনাদরে অবহেলায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। ফটিকের জন্য খুব দুঃখ হয়েছিল আর ফটিকের মামীর উপর ভীষন রাগ।
এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ শুধু আশ্রিত জনের দুঃখকষ্ট দেখেছেন। তাই সেই চিত্র এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার মত দুঃখী আশ্রয়দাতার সমস্যা, অপমান, বিড়ম্বনার কথাওতো একটু লিখতে পারতেন? কই লিখেন নিতো। কবির সময়ে ওই রকম লাঞ্চিত, কুণ্ঠিত মামা ও তার বিচ্ছু ভাগনী কি ছিল না?
বোন ক্যান্সারে মারা গেল। তখন কিশোরী মেয়েটি মা হারানোর দুঃখে বিষাদগ্রস’, রাগতঃ। আদর, উপহারে ওর মন খুশী রাখার চেষ্টা চলছিল। তখনই মেয়েটির বাবার অনুরোধে ও নিজেরও স্নেহের তাগিদে রম্নমি ওকে বিদেশে আনালো।
রুমির বউ ইতালীয়। সে ভাষ্কর্যশিল্পী। শিল্পশিক্ষানিকেতনে ভাষ্কর্য শেখায়। বউয়েরও সায় ছিল এতে। এসে মামার সাদামাটা বাসস’ান ভাগনীর মনে ধরলো না। ওর ঠোঁট উল্টানো মনত্মব্য শুনে রম্নমি বলেছিল
-শুন মা, বিদেশে সবার বাড়ীঘর রানী এলিজাবেথ আর মাইকেল জ্যাকসনের প্রাসাদের মত নয়।
মেয়েটি সিনেমা-সেলিব্রেটি, জৌলুস সন্ধানী। কোন কাজ তার ধাতে সয়না। নিজে খেয়ে কাপ পিরিচ, বাসন কোসন ফেলে রেখে যেতো। এইদেশে কাজের মানুষ নাই নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। বলে বলে অভ্যাস করাতে হচ্ছে।
শপিংএ গিয়ে ওর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বলা হলো। টয়লেট্রিজ থেকে শুরম্ন করে জুতা যেটাই হাতে নিল সব নামীদামী ব্রান্ডের। স্যুয়েটার কেনার আগেই রুমির একপক্ষের বেতনের টাকা খতম। মা মরা ভাগনীকে বিবেচনা করে চলার কথা বলতেও সংকোচ হল।
ভোলাভালা শিল্পী বউ অতো কিছু খেয়াল করলো না। বউ ভাগনীকে জন্মদিনে রেসেত্মারাতে নিয়ে গেল। ভাগনী দামী খাবার শুধু নয় নানান পদও অর্ডার দিল। খেলো সামান্যই। যখন থালাকাপ ধুয়নি, বাথরুম পানিতে ভাসিয়ে প্লামার ডাকতে বাধ্য করলো তখন নয় আজ রুমি দেখলো বউয়ের চোখে বিস্ময়ের চাহনি। ভিন্দেশী না হয়ে নিজদেশী মামী হলে এতোদিনে ভাগনীর খবর হয়ে যেতো।
অবিবেচক মাতৃহীন ভাগনীকে পর্যুদসত্ম মামাটি দেখছে আর রবীন্দ্রনাথের উপর তার রাগ বাড়ছে, বাড়ছে…
বেচুবাবু
বাজেট এয়ারলাইন্সের লাউঞ্জে বসে ঠান্ডায় কাঁপছিল। চা-কফি নাই। ভেন্ডিং মেশিন দুটোতে আছে চিপস্ আর ড্রিংক। লম্বা ঘরটার একদেয়ালের বা দিকে একটা দরজা অন্য দেয়ালে ডানদিকে আরেকটা দরজা। যাত্রীদের আসা যাওয়াতে অটোম্যাটিক দরজা খুলছে আর হুড়মুড় করে ঠান্ডা হাওয়াও ঢুকছে।
হাওয়ার সাথেই সেও ঢুকলো। পরনে স্যুট। দীর্ঘদেহী শক্তসমর্থ এক তরম্নণ। তার চোখে চোখ পড়লো। পরিচিত হাসি ছড়ালো। ভেন্ডিং মেশিন থেকে জ্যুস কিনে ওর পাশে এসে বসলো।
প্রায় বারো তেরো বছর আগে ছেলেটিকে দেখেছিল।
সদ্য কৈশোর পেরনো তখন তার শৈশবের ননী মাখানো মায়া কাড়া অবয়ব ছিল। তবে বসার ভঙ্গিতে উদ্ধ্যত্ত আর অবজ্ঞা। এমন ভঙ্গি যেন চারফুট দশ ইনিচর কালোপনা মেয়ে জানেই বা কি। সরাসরি তাকিয়ে নয় তবে নীচু গলায় যা বললো ওর কানে ঠিকই পৌঁছেছিল। গভীর কালো চোখের মেয়ে ভাষাটা ধরতে পারলো ঠিকই। তার ভাষা শুধু বই থেকে শেখা নয়। সে মানুষের মুখে শুনা শ্লীল-অশ্লীল শব্দের এক খাতা বানিয়েছে। ডিক্শনারী আর বই থেকে ভাষা শিখে ভাব প্রকাশ করা গেলেও মানুষের অনত্মরের অভিব্যক্তি ধরা কঠিন। সেও গলা উচু করে দৃঢ় ভাবে বললো
-I will understand your four letters expression, cough it out please, cough it out
ওর ভাষা ও বলার ভঙ্গিতে ছেলেটি থতমত খেয়েছিল। তারপর সে সহজ ভাবে তার কাছে এসে খুঁটিনাটি অনেক তথ্য জেনে নিয়েছিল। নেপাল, ভারত, বাংলাদেশে যাচ্ছে মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে। হিমালয় পর্বত থেকে গারো পাহাড়ের পদতলে সুবিধাবঞ্চিত আদিবাসী শিশুদের মাঝে কাজ। ছেলেটির স্বপ্ন ও আনন্দ মানুষের মুখে হাসি ফুটানো।
যেখানেই কাজ করেছে হাসির ঝলক দেখেছে। তবে সবার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এমন কাজ একার পক্ষে বেশীদিন চালানো সম্ভব হয়নি। এবার সে বললো
-এখন কি করছি জানতে চাও? আমি এখন বেচুবাবু। মানুষের অঙ্গ বেচাকেনা করি। জানতো যুদ্ধ একদলকে করেছে শারিরীক ও মানসিকভাবে পঙ্গু আর আরেকদলকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু। গরীবদেশের গরীবমানুষের কিডনী-লিভার এমন কি চোখও ধনীদেশের ধনীমানুষদের কাছে পৌঁছে দেই। দুইদলই খুশী।
ওর চোখে বিতৃষ্ণা ও ভীতি দেখে সে বললো
-দেখ ড্রাগ-আর্মস বেচি না, মেয়ে বা পুরম্নষ কাউকেই পাচার করি না। যার যে অভাব সে অভাব দূর করে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করছি মাত্র!
রুশোর ডিভোর্স
উকিলপারায় উদ্ভ্রানেত্মর মত পৌঁছাল রুশোর আজ সকালেই তাকে ঘুমে রেখে বউ চলে গেছে। মেয়েটি ভাল। মায়ের পছন্দের মেয়েকেই রম্নশো পছন্দ করেছিলো। দু’জন দুই ধাচের মানুষ। মা ভীষন নিয়মনিষ্ঠ। যেদিন নিরামিষ সেদিন নিরামিষই হতে হবে, মুরগী-মাছ অবশ্যই চলবে না। বউ দেখা গেল মাছের দিনে নিরামিষ বা মুরগীর দিনে মাছ করে ফেললো।
মা হাল্কা গড়নের মানুষ। বউ সামান্য পৃথলা। মা স্নেহময়ী তবে প্রকাশে নীরব। বউ আনত্মরিক ও প্রকাশেও সরব।
মা খুব পরিপাটি ও সদা সতর্ক। বউ সামান্য অগোছালো, একটু ভুলোমনা। রান্না আছে জেনেও কাজ থেকে ফেরার পথে চাইনীজ খাবার কিনে নিয়ে আসলো। ড্রাইভারের বেতন ছয় হাজারের জায়গায় ভুলে খামে সাতহাজার দিয়ে দিল। ড্রাইভারটা ভালমানুষ তাই ফেরত দিয়ে দু’শো টাকা বখশিশ পেল। শাশুড়ী বিরক্তিকর নীরবদৃষ্টিতে পুড়িয়েছিলেন পুত্রবধুকে।
শাশুড়ীর নিখুঁতনিটোল থাকা দেখতে দেখতে বউ একসময় ত্যক্তবিরক্ত হয়ে এক কান্ড করলো। এমন এক ফ্রিজ ম্যাগনেট খুঁজেপেতে কিনে আনলো যাতে লেখা Dull women have immaculate houses. এই বানী শাশুড়ীর সদা গোছগাছ, ফিটফাট থাকাকে মাথাশূন্য কাজ হিসাবে গণ্য করলো।
শাশুড়ীও ছাড়বার পাত্রী নন। পুত্রবধুর ভোজনে অনিয়ম ও বৈচিত্র দেখে বিরক্ত। মেয়েটি বিরক্তি গায়ে না মেখে তার ঢলোঢলো স্বাস’্য ও হাসিখুশী মন নিয়ে ভালই দিন কাটাচ্ছিল।
শাশুড়ী এক কান্ড করলেন। এক সূচীকর্ম করিয়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে খাবার ঘরে টাঙ্গালেন। যাতে লেখা ইু By eating less and less
women enhance their buautiness
রুশোর মহা বিপদে। দু’জনই রম্নশোকে দারম্নন ভালবাসে; রম্নশোও ঠিক তাই। সমস্যা হল দুই নারীই তাদের বুদ্ধির তরবারী দিয়ে পরস্পরকে খুঁচিয়েই যাচ্ছে। আর বেচারা রুশো দুই নারীর তরবারীর ঝল্সানিতে ভীত কম্পিত।
সে এসেছে এদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে। সে কাউকে ডিভোর্স দেবে না। সে চায় এরা দুজন যেন রুশোকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়।