এক অনন্য সঙ্গীত সন্ধ্যা – এজাজ মামুন
তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী
আমি অবাক হয়ে শুনি…
হ্যাঁ, সত্যিই ওরা গুণী। ওদের শ্রুতিমধুর গান মুগ্ধ করেছে আমাকে। বিশ্বাস করি গত ২৪ শে মে তে ক্যানবেরা গ্রিনওয়ে সিনিয়র ক্লাবের মিলনায়তনে সমবেত সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছেন ওদের গান। এই গুণী শিল্পীরা পেশাদার শিল্পী, বাংলাদেশ কিংবা অস্ট্রেলিয়ার অন্য কোন শহর থেকে আমন্ত্রিত হয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করছিলেন না। কৈশোর বা সবে কৈশোর পাড়ি দেয়া আমাদের এই পরিচিত শিল্পীরা হলেন মোনা, সেঁজুতি, পুন্যা আর সামি। ওদের জন্ম/বেড়ে ওঠা ক্যানবেরাতে। মোনা ক্লাস এইটে, সেঁজুতি ও পুন্যা এবার এইচ, এস, সি পরীক্ষা দেবে। সামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
অনুষ্ঠানটি ছিল ঘরোয়া অনাড়ম্বর, যদিও এটিতে ঘাটতি ছিল না একটা সুন্দর গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের কোন অনুষঙ্গের। এটি ছিল জলসা’র তৃতীয় পরিবেশনা । এবারের অনুষ্ঠানটির মূল আয়োজক ছিলেন মোনা, সেঁজুতি, পুন্যা আর সামি’র বাবা মা।
তখন সন্ধ্যা ছ’টা বেজে দু’মিনিট, মিলনায়তনে প্রবেশ করেই মনটা ভরে গেল অন্য এক অনুভূতিতে। ভেসে এলো সুমধুর সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদয় দোলানো কথামালা-
“আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য-সুন্দর
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহা গগন মাঝে,
বিশ্বজগত মণি-ভূষণ বেষ্টিত চরণে ॥”
এই অসাধারণ গান দিয়ে শুরু হল সেদিনের সেই অনন্য সঙ্গীত সন্ধ্যা “এ লগন গান শোনাবার”|আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এতো দরদ আর পারদর্শী গায়কী দিয়ে এমন একটি সুন্দর গান গাইছে, এরা কি সত্যিই আমাদের প্রিয় সামি, মোনা, সেঁজুতি আর পুন্যা? দেখলাম যারা যন্ত্রসংগীত করছিলেন তাঁরা ডুবে গেছেন গানের ভেতরে। যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী সৌরভ, তাপস, রবিন, মিন্টু, নিত্য এবং ভীনু। সবাই যেন তন্ময় হয়ে কণ্ঠ শিল্পীদের সহায়তা করছিলেন। সুর-তাল-লয় সব যেন শতভাগ পূর্ণ করার প্রত্যয় ফুটে তুলেছেন তাঁদের যন্ত্রে। বুঝতে কষ্ট হল না ডঃ রবিন গুডা’র পরিচালনা সঙ্গীতানুষ্ঠানটিতে সামি, মোনা, সেঁজুতি আর পুন্যার গান আর যন্ত্রকে একাত্ম করেছে। তুষার রায়ের সঙ্গীত বিষয়ক প্রাসঙ্গিক তথ্য-সম্বলিত অনবদ্য সঞ্চালনা অনুষ্ঠানটিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, গান, শ্রোতা আর শিল্পীদের মাঝে যোগসূত্র রচনা করেছে।
প্রথম কোরাস শেষ হবার পর একক গান গাইতে এলো মোনা। প্রখ্যাত শিল্পী কৃষ্ণকলির গাওয়া একটি পুরানো বাউল সঙ্গীত। “সান্তাল করেছে ভগবান” গানটি তার কণ্ঠে শুনে মনে হল কৃষ্ণকলি গাইছে গানটি । গানটিতে সাঁওতালদের কষ্ট আর জীবন গাঁথা কে তুলে ধরা হয়েছে।অসাধারণ মোনার গায়কী আর কণ্ঠ । মোনা তার গানে সাঁওতালদের জীবন গাঁথা সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করলো। আসলেই ভাবতে অবাক লাগছিল মোনা এত অল্প সময়ে কেমন করে গানের এতো গভীরে চলে গেল!। মানিক-রওশন দম্পতি অস্ট্রেলিয়াতে প্রিয় বাংলাকে গেঁথে রেখেছেন প্রবাসী বাঙ্গালীদের মাঝে, মোনা সেটার কিছুটা হলেও ফুটিয়ে তুলল তার গানে।
এরপর সেঁজুতি দরাজ গলায় গাইল অতি পরিচিত দেশের গান-
“এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে।
আমার রাখাল মন, গান গেয়ে যায় এ আমার দেশ,
এ আমার প্রেম আনন্দ বেদনায়, মিলন বিরহ সংকটে।।
এই মধুমতী ধানসিঁড়ি নদীর তীরে নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে
এক নীল ঢেউ কবিতার প্রচ্ছদ পটে।।
গান শুনে মনে হচ্ছিল সেঁজুতি আবু জাফরের গানের কথাগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করছে। বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে জন্ম ও বেড়ে উঠা এই কিশোরীটির এমন অনুভব মনটাকে আনন্দে ভরে দিল। সেঁজুতির বাবা ডঃ রুহুল আমীন সরকার বললেন সেঁজুতি নিজেই এই গানটি পছন্দ করেছে আর সে সুন্দর বাংলা লিখতে ও পড়তে জানে। আসলেই এটা প্রশংসা করার মত একটি বিষয়।
এবার পুন্যার পালা। সিলেটের সুনামগঞ্জ অঞ্চলের রাঁধা রমণের বিশ্বব্যাপী মন মাতানো গান
“ভ্রমর কইও গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে
ভ্রমর কইও গিয়া. ভ্রুমর রে …”
গাইল সুললিত কণ্ঠে। সুরের অনেক কারুকাজ গানটিতে। কেমন যেন অপূর্ব ভঙ্গিতে একজন পাকা শিল্পীর সব যোগ্যতা দিয়ে গানটি গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো পুন্যা। মনে হল গুণী পুন্যা শিল্পী বাবা-মা ডঃ রবিন ও শম্পা’র সুরের ধারাটা রপ্ত করেছে অনেক সাবলীলভাবে।
এরপর এলো সামি গাইল বিদ্রোহী ও প্রেমের কবি নজরুলের গান। সে গাইল-
“খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।।
শূন্যে মহা আকাশে তুমি মগ্ন লীলা বিলাসে
ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ক্ষণে ক্ষণে নিরজনে প্রভু নিরজনে।।”
অসম্ভব সুন্দর গানটি গাইবার সময় মনে হল সামি অন্য এক জগতে চলে গেছে। নজরুলের গান পরিবেশনায় যে একটি স্বতন্ত্র ধারা আছে সামি যেন সবগুলোকে সাবলীলভাবে অতিক্রম করলো। এক অনাবিল পরিবেশনা। বাবা ডঃ আবেদ চৌধুরী ও মা টিউলিপ চৌধুরী মূলধারার সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি-ভক্ত। বাবা-মার সংস্কৃতি বা শিল্পকলার সুস্পষ্ট প্রভাব যে সামি’র গানের অনুপ্রেরণা এটা বুঝতে বাকি রইলো না।
নবীন গীতিকার শাহাদাত মানিকের লেখা-
“চোখ নিয়েছে রাঙ্গা চিলে
মরি আমি তিলে তিলে
এবার কি আর
বাচার উপায় নাই
বিধি
আমার কি আর
বাচার উপায় নাই।।“
গানটি গেয়েছিল মোনা। গানটির কথাগুলো ছিল সহজ কিন্তু অর্থবহ। এটির সুর করেছেন রবিন গুডা। অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী সুর। তাকিয়ে দেখলাম শ্রোতারা বেশ উপভোগ করছে গানটি। মনে হল কবি মানিক গীতিকার হিসেবও এই গানে সফল হয়েছেন।
থেমে রইলো না এই চার কিশোর-কিশোরী। একের পর এক গেয়ে চলল। কখনো একক পরিবেশনা, আবার কখনও সমবেত। তারা গাইল জগজিৎ সিং, সলিল চৌধুরী, বাপ্পি লাহিড়ী, শচীন দেব বর্মণ, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, শাহাদাত মানিক সহ নবীন ও প্রবীণদের গান। প্রতিটি গানে নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠা, মেধা, গায়কী ধরন সবকিছু মিলিয়ে শ্রোতাদের দুঘণ্টারও বেশী সময় অন্য এক জগতে নিয়ে গিয়েছিল এই চার জন গুণী শিল্পী। তাদের গান শুনে মুগ্ধ চোখে বারবার দেখেছি তাদেরকে। হৃদয়ের গভীরে বারবার অনুভব করেছি, বারবার কামনা করেছি আর আশায় বুক বেধেছি- এরাই পারবে গর্বিত বাংলাকে, বাংলার সুরকে আর বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে, চির জাগরূক রাখতে।
সামি, পুন্যা, সেঁজুতি আর মোনা এই অসাধারণ উপস্থাপনার জন্য তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। অনেক শুভকামনা তোমাদের জন্য।
এজাজ মামুন