একুশে বইমেলার ডায়েরি থেকে
মনের মধ্যে তখন ছিল সাদাত হোসাইন এর নাম, এবারের বইমেলায় তার তিনটি বই বেরিয়েছে, কিনব বলে বাসা থেকে বের হলাম ৷ দীর্ঘ ১৪ বছর পর বইমেলায় এসেছি, হেলাফেলা করলে চলবেনা জানি ৷ ১৪ বছর আগেও ভিড় ছিলনা, এবারও নেই, মাঝের বছরগুলোতে ছিল বৈকি ৷ এবারের ভীর চোখে পরেনি মেলার ব্যব্স্থনার জন্য, বিশাল সর্বার্দি উদ্যানের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে বলে ধুলা ও লোক সংখ্যা উভই সামাল দেয়া গেছে ৷
বর্ধমান হাউস বা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে একাডেমির নিজস্ব ষ্টল এবং লিটল মাগাজিনের দোকান গুলো পসরা সাজিয়ে বসেছে, অন্যদিকে উদ্যান প্রাঙ্গনে সব প্রকাশক দের দোকান ৷ মেলার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমি সাদাতের প্রকাশক ও তাদের ষ্টলএর নাম ভুলে গেলাম ৷ আমরা প্রায় প্রতিটা ষ্টল এ জিজ্ঞাস করছি, ভাই এখানে সাদাত হোসাইন এর বই আছে, দোকানিরা প্রশ্ন করে কোন সাদাত ? আমি বলি কেন, বিখ্যাত ফিল্মমেকার সাদাত, যার ছবি ‘বোধ‘ সারা দুনিয়া জয় করেছে ৷ তারা কেউ কেউ বলে পাশের ষ্টল এ যান, কেউ বলে এ নামে কাউকে চিনি না ৷ অবশেষে এক ভাই তার হাতে ধরা নকিয়া এ খোজ করে জানালেন, ভাই ভাষা চিত্রে পাবেন ৷ আমরা যখন সেখানে গেলাম তখন তিনি চলে গেছেন, তাই আর কথা বলা হলো না, সুদুর Australia থেকে এক বুক ভালবাসায় সিক্ত হতে পারলাম না ৷
জাদুকর লেখক হুমায়ুন আহমেদ আর নাই, তবুও ভীর কমেনি তার সুপারস্টার প্রকাশক অন্যদিনের ষ্টলএ ৷ অন্যদিন তার বিশাল প্রতিক্কৃতি টাঙ্গিয়েছে ষ্টল এর উপর, তিনি যেন এক কাপ চা হাতে দখিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন ৷ পাঠক ভক্তরা তার বই কিনছে, আর উপরের দিকে তাকিয়ে যেন অটোগ্রাফ না পাবার কষ্ট লুকাচ্ছে ৷ তার শেষ বই আরেক জনপ্রিয় লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর সঙ্গে যুদ্ধদিনের ডায়েরি, প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশ ৷ আরেকটি গল্পগ্রন্থ লীলাবতীর মৃত্যু যেখানে স্থান পেয়েছে তার অসমাপ্ত লেখা ‘নবিজি‘, বের হয়েছে অন্যদিন থেকে ৷
দ্বিতীয় ভীর দেখা গেল প্রথমা প্রকাশনীর ষ্টলএ, সেখানে আনিসুল হক সহ আরো বিখ্যাত কবি, উপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক দের বই ৷
একটা ষ্টল এ এক লেখকের বিশাল পোস্টার, উপন্যাসের নাম ‘কাগজের নৌকা’ আর লেখকের নাম আসিফ এন্তাজ রবি ৷ দোকানি বললেন উনি একজন ফেইসবুক সেলেব্রিটি, তরুণ তরুনীরা তার বই কিনছে গোগ্রাসে ৷ আমি দোকানি কে বললাম, ভাই নম্বর ওয়ান সেলেব্রিটি আরিফ আর হুসেন বা জাভেদ কায়সার বা ফারিনা মাহমুদ বা আতিকুর রহমান (!) এর কোনো বই নেই? দোকানি হয়ত প্রথম তিনজন কে চিনতেন কিন্তু শেষের নামটির কারণে তালগোল পাকিয়ে কিছু বলতে পারলনা, আমিও হাফ ছেড়ে বাচলাম।
পাঠক সমাবেশ ষ্টল বরাবরের মতই খুব শৈল্পিক, এবার তারা ত্রিশ খন্ডে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র বের করেছে, যার দাম ২৫ হাজার টাকা ৷ প্রায় দের হাজার টাকায় বিশাল বই লালন সমগ্র ৷ পাঠক সমাবেশ থেকে কিনলাম আমার প্রিয় সহিদুল জহির, শাহাদুজ্জামান ও আরুজ আলী মাতব্বরের বই ৷
সারা মেলা জুড়ে শুধু বই আর বই ৷ সেখানে আরো আছে নজরুল,জীবনান্দ দাশ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ সামসুল হক, তারাশংকর, আনিসুজ্জামান অনেকে ৷
এবারের বইমেলায় আমার কেন জানি মনে হয়েছে যদি বইয়ের দোকানের ভেতরে আবৃতির ষ্টল গুলো থাকত, পাঠকরা তাদের প্রিয় কবিতা গুলো শুনত, ভরাট কন্ঠে শোনা যেত শিমুল মুস্তফা, মহিদুল ইসলাম, কামরুল হাসান মঞ্জু বা কোনো সুমিষ্ট নারীকণ্ঠ, গান না হোক আবৃত্তি মেলায় থাকতেই পারে !
তাবত মেলায় মানুষের হাতে হাতে বই দেখে আমার মনে হচ্ছিল বাঙালি তার নিত্য সংসার সংগ্রামের মধ্যেও এখনো একটি বই কিনতে ভুল করে না ৷ আর সেজন্যই বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাড়াবে নিশ্চই ৷