আর ইউ নট এ লাকি চাইল্ড?
আপনার বাবা কি ছিলেন?
আমি বললাম, ‘পেশায় ড্রাইভার, তবে তিনি যা ছিলেন, এখনও তাই আছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বাবা’।
আমার সাহসের (!) তারিফ করে নানা মন্তব্য, সেই মন্তব্যের ভিড়ে একজন লিখলেন, ‘ইউ আর অ্যা লাকি চাইল্ড’। আমার বোধগম্য হল না, কেন আমি লাকি চাইল্ড! কারও বাবা মানুষের বাড়িতে গাড়ি চালাত, এতে সৌভাগ্যবান সন্তান হবার কি আছে আমার সত্যিই তা বোধগম্য হল না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন আমি লাকি চাইল্ড?’
সে বলল, ‘আপনি বলেছেন আপনার বাবা আপনাকে এতো ভালবাসত, যে আপনি অকপটে বলতে পেরেছেন, তিনি পেশায় ড্রাইভার, তবে তিনি যা ছিলেন, এখনও তাই আছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বাবা। আমরাতো এভাবে বলতে পারি না, কারণ আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা নন! আপনার মত করে আমাদের বাবা আমাদের ভালো বাসেন নি, দায়িত্ব পালন করেন নি, আগলে রাখেন নি’।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম, তারপর বললাম, ‘আমি যখন ক্লাস থ্রীতে পড়ি, হঠাৎ করে আমার বাবা উধাও হয়ে গেলেন, সেকালে মোবাইল নেই, ইন্টারনেট নেই। ভরসা বলতে চিঠি, আব্বা দীর্ঘ ৩ মাস উধাও। কোন খোঁজ নেই, খবর নেই। বাড়ীতে আমি, ছোট ভাই, মা আর দাদী। কি খাই আমরা? ঘরে চাল নেই, নুন নেই, কেরোসিন নেই, তেল নেই’। আমাদের বিশাল উঠোনের মাচা ভর্তি লাউ হয়েছে, আমরা ৩ বেলা সেই লাউ খাই। আমরা ভাতের গন্ধ ভুলে গেছি, ভুলে গেছি চালের গন্ধ, মাড়ের গন্ধ, নুন, তেল, মরিচে মাখান ঝোলের গন্ধ!
সেই বাবা ৩ মাস পরে বাড়িতে ফিরলেন। কি কি সব সমস্যার ফিরিস্তি দিলেন। তাই বলে একটা চিঠি অবধি দিবেন না!! এ কেমন কথা!!
আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি, ঈদ চলে আসছে। রোজ ফজরের আজানের সময় ঘুম ভাঙে, লঞ্চের হুইস্যালে! ওই বুঝি আব্বা এলো, লাল রঙের জামা, ধবধবে সাদা জুতো, ওই বুঝি এলো! ঈদের আর মাত্র দুটো দিন বাকী! মাত্র দুটো! সবাই নতুন জামা কিনেছে! নতুন জুতো! আমরা? আব্বা এলেন ঈদের দিন ভোরে। আমরা দৌড়ে আব্বার কাছে গেলাম, তার কাঁধ থেকে ব্যাগ নিয়ে খুললাম, সেই ব্যাগভরতি আব্বার পুরান লুঙ্গী, জামা, গামছা! আমরা দুই ভাই পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য, সবচেয়ে দুঃখী, সবচেয়ে তীব্র কান্না চোখে তাকিয়ে রইলাম। আব্বা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘এই ঈদ আমাগো না, আমাগো ঈদ সামনে!!’ আমরা দুই ভাই, ৮/১০ বছরের দুটি বালক! সেই শৈশব! সেই ঈদ, সেই অপেক্ষা, কে আমাদের ফিরিয়ে দেবে, কার সাধ্য? কার? একজন রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে যাবতীয় দোষ তার ছিল! অজস্র দোষ!! তিনি খুব সাধারণ একজন মানুষ, লোভ, পাপ, কাম, হিংসা আর, আর বাকীসব রিপু তাড়িত খুব সাধারণ একজন মানুষ! তিনি ফেরেস্তা ছিলেন না, ছিলেন খুব সাধারণ! অতি সাধারণ!! আর ১০ জন মানুষের যা থাকে, তার সব, সব ছিল তার!
তারপরও আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বাবা। কেন?
ক্লাস টুতে পড়ি। আম্মা রাগ করে নানু বাড়ি চলে গেছেন। হাঁটা পথে ৫ মাইল দূরত্ব। বিকেল বেলা আব্বা আমার হাত ধরে নানুবাড়ির পথ ধরেছেন। আমি তার পেছনে। তিনি সামনে। রাস্তার ধারে ভাঙা টুকরো কাঠের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে আছে বিশাল জংধরা এক পেরেক। আমার মাথায় কি খেয়াল চাপল, কে জানে? আমি ডান পায়ে চাপ দিয়ে বার দুই সেই পেরেক বাঁকা করার চেষ্টা করলাম। হল না। রোখ চেপে গেল। পা উপরে তুলে সজোরে পায়ের গোড়ালির তালুর অংশ দিয়ে পাড়া দিলাম। সজোরে। ঘ্যাচ করে স্যান্ডেল ছিদ্র করে সেই পেরেক ঢুকে গেল গোড়ালির ভেতর! তীব্র চিৎকারে আমি গড়িয়ে পড়লাম ধুলোয়। আব্বা দৌড়ে এসে আমায় কোলে নিলেন। রক্তে ভিজে যাচ্ছে মাটি, আব্বার হাত, কুনুই, লুঙ্গি। এখন? অন্ধকার নেমে আসছে, এখন নানু বাড়ি যাওয়ার চিন্তা বাদ। আমাকে কোলে আব্বা ফিরে এলেন বাড়ি। কি করবেন আব্বা? সকাল না হলে কোন উপায় নেই! ডাক্তার নেই আশেপাশে ১০গ্রামে! তাহলে? আব্বা আমাকে বুকের সাথে জাপটে ধরে বিশাল উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশ অবধি হাঁটছেন। আমি তীব্র ব্যাথায় কুঁকড়ে মিশে আছি তার বুকের ভেতর। ক্লান্ত আব্বা খানিক থামলেই আমি ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠি। তিনি হাঁটলে, হাঁটার তালে তালে একটা ছন্দ তৈরি হয়, সেই ছন্দময় কাঁপুনিতে পায়ে একটা চাপ’ তৈরি হয়। তখন ব্যাথাটা অনেক কম লাগে! আব্বা বসলে কিংবা না হেঁটে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলে ব্যথাটা আবার ফিরে আসে। সাথে সাথে আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠি। আব্বা হাঁটেন। আমি তন্দ্রায় ডুবে থাকি। আব্বা মুহূর্তের জন্য থামলেও আমি চিৎকারে আকাশ ফাটাই। আব্বা হাঁটেন। মাগরিব শেষ হয়, এশার শেষ হয়, রাত গভীর হয়, গভীর থেকে গভীর, মধ্যরাত, উঠোনের পাশের ঝুপড়ি ক্লান্ত হয়, দূর্বাঘাসের গাঁয়ে শিশির জমে, দূরে কোথাও শেয়াল ডাকে, বাদুরেরা ডানা ঝাঁপটায়, নিশাচর পাখিরা উড়ে চলে যায়, আব্বা হাঁটেন। চক্রাকারে উঠানের চারপাশে হাঁটেন। হাঁটতেই থাকেন। আমি আব্বার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাই। ঘুমাই। আব্বা হাঁটেন। সারা রাত হাঁটেন, সারা রাত। পুবাকাশ ফর্সা হয়, দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসে, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম;। ভোরের আলো ফুটে দিন হয়। আমি ঘুমাই, আব্বা হাঁটেন। হাঁটতেই থাকেন। ভোরের আলোয় হেঁটে হেঁটে চলে যান দূরের গঞ্জে। সেখানে ডাক্তার। আমি ঘুমাই। আব্বার পাহাড়ের মতন বিশাল বুকের ভেতর ছোট্ট পাখির মতন ডুবে থাকি ওমে। ডুবে থাকি অন্য কোন জগতে। সেখানে ভাবনা নেই, ক্লান্তি নেই, দুঃখ নেই, ভয় নেই। আমি বুঁদ হয়ে ডুবে থাকি আর ডুবে থাকি।
আমি জানি, অজস্র মুহূর্ত না, পাওয়া না পাওয়ার অজস্র হিসেব না, মাত্র ওই একটা, মাত্র ওই একটা রাতের জন্য হলেও আমি আমার সারাজীবনের না পাওয়া ভুলে যেতে রাজি আছি, সারা শৈশবের অপ্রাপ্তি ভুলে যেতে রাজি আছি। একজন রক্ত মাংসের মানুষের অজস্র ‘ভুল’ ”অন্যায়’ ভুলে যেতে রাজি আছি, অজস্র অপ্রাপ্তি ভুলে যেতে রাজি আছি।
বলতে রাজি আছি, ‘তিনি আগেও যা ছিলেন, এখনও তাই আছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বাবা’।
আমাকে ‘লাকি চাইল্ড’ বলা সেই মানুষটাকে আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, এমন মাত্র একটা, মাত্র একটা মুহূর্তও কি নেই আপনার? আসলেই কি নেই?
সত্যিই নেই?