আমার বর্ষবরণ
পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ বলতে রমনার বটমূল বা ঢাকার জাঁকজমক পূর্ণ বর্ষবরণ আমাকে বেশী চমকিত করে না । সব কিছুই মনে হয় বাণিজ্যিক কেমন একটা দেখানো দেখানো ভাব। আমি তোমাকে তুমি আমাকে। পহেলা বৈশাখ বলতে আমার মনে দাগ কেটে আছে লাল শালু দিয়ে মুড়ানো ছোট,বড়,মাঝারি বিভিন্ন সাইজের হালখাতার সাথে বিশাল বিশাল হাড়ি ভর্তি মিষ্টি। হালখাতার সাথে মিষ্টির একটা অবিছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যেন দুজন দুজনার। পহেলা বৈশাখের আগের দিন রাতে আম পাতায় সিঁদুর লাগিয়ে লম্বা দড়ি দিয়ে মালা বানানো হত সেই গুলি টানানো হত সব ঘড়ের দরজার সামনে। সবাইর বাড়িতে কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব । চৈত্র সংক্রান্তি পরের দিন পহেলা বৈশাখ। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই স্নান শেষে নুতন কাপড় পরে পূজার ঘরে সবাইর সাথে পূজার কাজে বেস্ত হয়ে পড়া । ফুলের মালা গেঁথে দেবতার গলায় পরিয়ে দেওয়া। রান্নাঘরে সেই রকম বেস্ততা। জোড়া ইলিশ। সর্ষে বাটা। বছরের প্রথম দিন ভালো খেলে নাকি সারা বছর ভালো ভালো সুস্বাদু খাবার খাওয়া যাবে। এই ভেবে সেই দিন যত পার রান্না কর।
বিকালে মেলা। সারাদিন এত খাবারের পর মেলায় সাজানো নিমকি,গজা,বাতাসা নকুলদানা, আঙ্গুরি দেখার পর মনে হত এইগুলি না খেতে পারলে জীবনই বৃথা। সব কিছুই একটা ঘোর লাগানো ভালো লাগা। একটা হুইসেল মার্কা বাঁশি, প্লাস্টিকের একটা চশমা , একটা ঘড়ি কিনা চাই ই চাই। টিনের বাক্সে চোখ রেখে কবরি ,রাজ্জাক দেখা উফফ কিযে লাগত মনে হত আস্ত একটা সিনেমা দেখে ফেলছি। নাম ছিল তার বায়স্কোপ। মেলায় এসে নাগরদোলায় চড়ব না তাকি হয়? সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক ভালো লাগা। ক্রমশ সন্ধ্য ঘনিয়ে আসছে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু মন চায় না ফিরে যেতে। ফিরার সময় হাত ভর্তি মাটীর হাঁড়িপাতিল , বিরনিধানের খই, ঢোল ,বেলুন,চুরি নানান জিনিষ নিয়ে বাড়ি ফেরা সবাইর সাথে হেঁটে হেঁটে । তখন টাকা ছিল না। অনেক কিছু না কিনতে পারার সুপ্ত একটা ঢেউ জাগানিয়া দুঃখ। আবার মনের মত কিছু কিনতে পারার আকাশ সমান উছলে পড়া আনন্দ। ভাললাগা ,সুখ , ঢেউয়ের মত হাসির দমক। তখন উচ্ছাস ছিল , আবেগ ছিল, ভাললাগা ছিল, স্বপ্ন ছিল। এখন টাকা আছে কিনতে পারি, কিন্তু ইচ্ছে করে না। ইচ্ছেরা সব পালিয়ে গেছে। আর বাকী সব আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। সময় যেন সব চুরি করে নিয়ে গেছে।