মদিনা সনদ ও হযরত ওমর (রা.)র সেকুলারইজম এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ভেবেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি ও প্রবাসী বাঙালী চেতনা নিয়ে এবার লিখবো। সুন্দর হেমন্তে আমরা যারা বিদেশে আছি তাঁরা কতটা বাঙালী চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে নববর্ষকে বরণ করি তা দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরবো। আমরা দেশটাকে নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন সেটাও লিখবো। এখানে কিভাবে বিরোধীদল হরতাল-ধংসজ¹ ছাড়া রাজনীতি করছে সেই কথা লিখবো। কিন্তু হলো না। কারণ, পত্রিকার পাতায় কেবই উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা! দেশ বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিতে সবাই অকৃপণ!
সবাই প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিচ্ছেন, তিনি যেন দেশ বাঁচাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন করে সংবিধানে সংযোজন করেন। তিনি যখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, তখন এর যৌক্তিকতা প্রমাণে অসংখ্য যুক্তি তিনি দিয়েছেন। আর আজকের উপদেষ্টারাসহ বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ তখন নাকচ করে চলেছেন। এক পর্যায়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, বেগম খালেদা জিয়ার কোন অসুবিধা হবে না যেমনটি লেজেহোমো এরশাদের হয়েছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করেছিলাম (১০ই নভেম্বর ১৯৯৫ রাত আনুমানিক ৯ টায় সুগন্ধায় শিক্ষকদের সঙ্গে এক বৈঠকে) তিনি যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেন। তিনি ও উপস্থিত সকলে সেদিন আমার উপর রুষ্ট হয়েছিলেন। আজও তিনি আমার প্রতি রুষ্ট হবেন। কিন্তু আমি সেদিন বাস্তবতাকে ঊপলব্ধি করে দেশের ও দশের স্বার্থেই বলেছিলাম দাবীটি মেনে নেওয়ার জন্য। আজও আমি একই ঊপলব্ধি থেকে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে বলছি অপেক্ষা করুন। হয়তো এবারও তিনি রুষ্ট হবেন। কিন্তু এঁটাই এখন উপযুক্ত।
আমার মতে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাঝে তেমন কোন গুণগত পার্থক্য থাকবে না নির্বাচনকালীন সময়ে। বর্তমান সংবিধানই মহামান্য রাষ্ট্রপতি, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দায়, সুযোগ ও বাধ্যবাধকতা দিয়ে রেখেছে। কোন নতুন ধারা সংযোজন না করেই চিরায়ত পদ্ধতিতে একটি সুষ্ঠ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, জাতির জনকের কন্যা এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক। তিনি আমাদেরকে কোন বিপদে ফেলবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।
বর্তমান বিরোদীদলীয় নেত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেনেছিলেন টানা ৩৫ দিন অসহযোগ আন্দোলন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে। এর পরেও তিনি ১২১ সিট নিয়ে নির্বাচনে জিতে ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি আবার যখন ক্ষমতায় আসলেন তখন তিনি বিচারপতি কেএম হাসানকে প্রধানবিচারপতি করে আরেকটি ভুল করলেন। ভুল করলেন রাজাকারদেরকে মন্ত্রী বানিয়ে এবং সংখ্যালঘুদের আক্রমণ সহ আরোও সব নেতিবাচক কর্মকান্ডর অংশীদার হয়ে। ১/১১-র সৃষ্টির মূল কারণ এটি। ১/১১- সৃষ্টির জন্য রাজনীতিবিদরা দায়ী হলেও শাস্তি পেতে হয়েছে সামরিক বাহিনীকে। তাঁরা হারিয়েছে তাজা প্রাণ। আমরা জেনেছি ১৫ আগষ্ট, ৩রা নভেম্বর, ৭ই নভেম্বর, ২৪শে মার্চ, ১৯শে মে সৃষ্টিতেও বর্তমান বিরোধী রাজনীতিবিদদের অনন্য ভুমিকা ছিল। ২৫শে ফেব্র“য়ারীর ভয়াবহ হত্যাকান্ডের দায় নিয়ে আজ ঐ দলের নেতারা জেলে। সেই দল ও তাঁদের বুদ্ধিজীবী সমাজ আজ আবার তাঁদেরকে সেই বিপদের দিকে ঠেলে দিচেছন সামরিক হস্তক্ষেপ কামনা করে । কেঊ একটি বারও বলছেন না বেগম জিয়া আপনি থামুন। বরং, সরকারের কোটে বল ঠেলে দিচেছন।
আগেই বলেছি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার আস্থা আছে। তিনি কেবল প্রধানমন্ত্রীই নন জাতির জনকের কন্যা। তিনি তথাকথিত তল্টাবধায়ক সরকার দিতে চান না কারণ তিনি সবাইকে নিরাপদে রাখতে চান। তিনি চান না কোন একটি পক্ষ উড়ে এসে জুড়ে বসে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকদেরকে হয়রানি করে। তিনি চান সেনাবাহিনী যেন বিতর্কিত না হয়। সেনাবাহিনী যদি নির্বাচন পরিচালনা করে তবে যে জিতবে সে বাহবা দেবে আর যে হারবে সে প্রতিশোধ নেবে। এভাবে আমাদের সেনাবাহিনী বারবার কেন প্রতিশোধই পাবে? তাঁরা কি আমাদের জন্য নয়? তাঁরা কি বহিরাগত দখলদার? আজ আমরা সবাই কেন ভাবছি যত কিছু ক্ষতি দেশের হচ্ছে তা কেবল প্রধানমন্ত্রীর জন্য? হরতাল ও তান্ডব কি বিরোধীদল করছে না?
সরকার ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। বিএনপি ১৯৯১-১৯৯৬ এই পাঁচ বছর ও ২০০১ থেকে ২০০৬ ক্ষমতায় ছিল। বর্তমান সরকারের পক্ষ আওয়ামী জোট ওই ১০ বছরের মাঝে ছোট খাটো হরতাল দিয়েছে। তবে তারা এভাবে নাশকতা বা তান্ডব চালায়নি। সরকার ৫ বছর পর দায়িত্ব শেষে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া পর আমরা অপেক্ষা করি। দেখি তিনি কিভাবে চলেন। তিনিতো সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে সমাধান দিতে পারেন। আমরা কেন এত অধৈর্য হচ্ছি? তিনি সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সকলের পরামর্শ নিয়েই কাজ করবেন। যদি আমরা দেখি তিনি ও নির্বাচন কমিশন বা সরকারের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী সেই প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করছে তাহলেই আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে পারি। আমি কোন একটি দলের সমর্থক হলেও বিবেকহীন হয়ে যাইনি। আমি চাইবো না কোন দল অবৈধ্য প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতায় আসুক। আমার মত জনগণই এদেশে বেশী। তাদের প্রতি সকলকে আস্থা রাখতে হবে।
প্রয়োজনে আমিও আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইবো। প্রতিশ্র“তি দিতে হবে কোন প্রকার প্রতিশোধ জনগণের উপর যেন না আসে। কারণ দেশের মালিক কেবল রাজনীতিবিদরা নন। মুক্তিযুদ্ধে মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর-আল শামস কেবল বিরোধীতা করেছিল। জনগণ, সামরিক বাহিনী, সরকারী কর্মকর্তাদের উপর যে প্রতিশোধ নেওয়া হয় তা বন্দ করে হাসিমুখে নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি চালু করতে হবে।
হাজারোও র্দূনীতির অভিযোগ আসলেও গণজাগরণ মঞ্চের মধ্যদিয়ে সরকারকে জনগণ সমর্থন দিয়েছে। তার প্রতি বিরোধীদলকে শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। আজ প্রতিটি ঘরে ঘরে একটি মোবাইল ফোন আছে। প্রয়োজনে তাদেরকে এসএমএস করতে বলুন। জেনে নিন তারা কি চায়? মানুষের জানমাল নিয়ে যেন আর ছিনিমিনি না খেলা হয়। জনগণই রায় দেবে সময় হলে।
আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদ বাস্তবায়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এতে করে যে আবহ হযরত ওমর(রা) জেরুজালেমে প্রবর্তন করেছিলেন সেই ইসলামী সেকুৃলারইজম আবহ দেশে বিরাজ করবে এবং এঁটি হবে আমাদের রাষ্ট্রের নতুন ভিত্তি। আর মদিনা সনদ অনুযায়ী সরকার সব সময়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদ গ্রহন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী ও হেফাজত ইসলামের মূলদাবীগুলি মেনে নিয়েছেন। কারণ তিনি শান্তি চান। প্রগতি চান ও মানুষের কল্যাণ করতে দৃঢ়চিত্ত। নবীজি ও খলিফারা মানব দরদী ন্যায়বান সত্যপ্রিয় তত্ত্বাবধায়ক শাসক ছিলেন। আমি মনে করি সরকার সকল রাজনীতিবিদকে অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে মানবদরদী, ন্যায়বান ও আন্তরিক প্রমাণ রাখবেন। প্রমাণ করবেন তাঁরা সব সময় জনকল্যাণে কাজ করেন এবং সব সময়ই তাঁরা কেবল তত্ত্বাবধায়ক শাসক। যাদেরকে জেলে নেওয়া হয়েছে তারা যেন বুঝতে চেষ্টা করেন কোথায় তাঁদের ভুল ছিল।
ক্ষমতা ও লুটপাট নয় জনকল্যাণ হোক আমাদের রাজনীতির লক্ষ্য। আমরা জনগণ অবশ্যই অতীতের মত আবারও ছুঁড়ে ফেলে দেব সকল দলের লুটাপাটকারীদেরকে আগামী নির্বাচনে। কারোও হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়বে না। এখন কেবল প্রতীক্ষার সময়। মাননীয় বিরোদীদলীয় নেত্রী আজ আপনি হরতাল দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধংস করে দিচ্ছেন। অথচ নিজের নাতনীকে বিদেশে সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ঊঠতে দিচ্ছেন। এটা কি অনৈতিক নয়? আসুন আমরা সবাই বিবেকবর্জিত কাজ বর্জন করি।
-ফরিদ আহমেদ, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ণ থেকে।