বিশ্ব নাগরিক সৃষ্টিতে একুশ শতকের বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ব নাগরিক সৃষ্টিতে একুশ শতকের বিশ্ববিদ্যালয়

প্রশান্ত – মহাসাগরের অপর পাড়ে বসে যখন এ লেখা লিখছি তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর মত জনদরদী ৩০০ সৎ মানুষ খুঁজছে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। জাতি যেন অভয়ে তাদের হাতে সপে দিতে পারে আগামী দিনের নেতৃত্ব। যখন লিখছি তখন বাংলাদেশের মানুষের মনে ঝড় বইছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড, শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ নিয়ে। নানা কারণে সমগ্র দেশ উদ্বিগ্ন তাদের অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে। তারা ভাবছে কতটুকু নিরাপদ দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে। মানুষ উদ্বিগ্ন, ভীত ও বীতশ্রদ্ধ। একটু শানি- তাদের চাওয়া পাওয়া।

রানা প্লাজায় চাপা পড়ে, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে, আরবদেশের মরভুমিতে, নিঊ ইর্য়ক শহরের ট্যাকসি ক্যাবে, লন্ডনের কিচেনে, ও পোশাক কারখানার আগুনে পুড়ে, মাঠে রোদ ও খরায় ঝলসে তারা কাজ করছে বাঁচার জন্য। এর মাঝে এ সপ্তাহেই দেশের ২০ ভাগ মানুষ দেবে প্রতিমা বিসর্জন। আর ৮০ ভাগ মানুষ ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হতে দেবে লক্ষ পশু কোরবানী। তবুও প্রশ্ন: কেন জাতি এখনও একজন ত্যাগী মানুষ খুঁজছে? ওই বিসর্জন বা কোরবানী কি আমাদেরকে সুনাগরিক, সুশাসক, সুশিক্ষক হতে কোন অবদান রাখছে না। দেশে এখন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলি কি সুনাগিরক সৃষ্টিতে ব্যর্থ? কোথায় আমাদের ভুল? কেন বারবার একই আবর্তে ঘুরপাক খাচছি? কোথায় গেল আমরা সত্যের দিশা পাব? কেন শিক্ষামন্ত্রী তর্জনী উচিয়ে বলেন বর্তমান শিক্ষা বেবশ্তহা দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়? কেন শিক্ষক নেতারা বলেন, আইন করে শিক্ষকদের শাস্তি – দিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ আদায় করা যায় না? কেন উপাচার্য পরিবার নিয়ে গাছ তলায় রাত কাটান? কেন বারবার শিক্ষকদেরকে আন্দোলন করতে হয় ? কেন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কালক্ষেপন করে শিক্ষার্থীদেরকে বঞ্চিত করা হয়? কেন বারবার সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে ওঠে?

৩০ শে সেপ্টেম্বর ২০১৩।

অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ও ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয় একটি সিমপোজিয়াম আয়োজন করেছিল। মেলবোর্ণ শহরের একটি অত্যাধুনিক কনফারেন্স রুমে আমরা ৬৫ জন শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম। নিউজিল্যান্ড থেকে এক বক্তা ইন্টারনেট ভিডিওতে যুক্ত হয়েছিলেন এই আলোচনায়। এখানে মেলবোর্ন ও ভিক্টরিয়ার প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকরা অংশ নিয়েছিলেন। সিম্পজিয়ামের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল: বিশ্ব নাগরিক সৃষ্টিতে কিভাবে আমরা কারিকুলাম প্রণয়ণ করতে পারি এবং কিভাবে মূল্যায়ন করতে পারি যাতে শিক্ষার্থী বিশ্ব নাগরিক হতে পারে। এ আলোচনা থেকে যে বিষয়টি ঊপলব্ধি করেছি তাহল: বিশ্ববিদ্যালয় যদি হয় সুনাগরিক সৃষ্টির স্থান তবে একুশ শতকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির লক্ষ্য হল এমন নাগরিক সৃষ্টি করা যারা দেশ, সমাজ, পরিবার, গোত্র প্রভৃতি আত্মকেন্দ্রিক ক্ষৃদ্র চেতনাকে জয় করে একজন শিক্ষার্থী হবে বিশ্ব মানব। অর্থাৎ বিশ্ব মানব চেতনাকে কারিকুলামে এমনভাবে সংযোজন করতে হবে যাতে একজন চিকিৎসক ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে মানব সেবায় ব্রতী হন। যেন ভিজিট নিয়ে তাকে বিতর্কে জড়াতে না হয়। একজন ব্যাবসায়ী যেন নিজের লাভ লোকসান নিয়ে বেস্ত- না থাকে। সে যেন বিশ্ব ও সমাজ থেকে দারিদ্র বিমোচনে য়থেষ্ট অবদান রাখতে পারে। একজন শিক্ষক যেন নারী পুরুষ সাদা- কালো, ধনী-দরিদ্র ও জাতিভেদ অতিক্রম করে জ্ঞান বিতরণ ও সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে। একজন রাজনীতিবিদ যেন দলীয় সংকীর্ণতা এবং রাষ্ট্রীয় চেতনাকে জয় করে মানবাধিকার রক্ষায় অবদান রাখতে পারেন। এমন মানুষ সৃষ্টিই হচ্ছ একুশ শতকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চ্যালেঞ্জ।

বিশ্ব নাগরিক হতে গেলে সত্য ,সুন্দর ও শুভ পুজারী হতে হবে। আর তাই বিশ্ব নাগরিক ও বিশ্ব নেতা সৃষ্টিতে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিবেদিত । আর এলক্ষ্যেই উপাচার্যরা, ও রাজনীতিবিদরা অবিরত কাজ করছেন। বিতর্ক আছে, প্রতিযোগিতা আছে- তবে উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার অভাব নেই । সুন্দর একটি সিস্টেমে সবাই কাজ করছে- যেখানে সবাই সবাইকে সম্মান করে।

বিশ্ব মানব বা বিশ্ব নাগরিক চেতনার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে আমি নতুন করে আবিষ্কার করলাম সেই ছোট বেলার ইংরেজী পাঠ্যের ডিয়ওজীনীসকে। এই বিদগ্ধ দার্শনিক বিশ্বের জ্ঞানী মানুষদের মাঝে একজন। তিনি খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৪০০ বছর আগে তুরষ্কে জম্মেছিলেন এবং কাকতালীয়ভাবে ৩১২ খৃষ্টাব্দে একই দিনে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের সঙ্গে গ্রীসে তিরোধান করেছিলেন। এই কিংবদন্তী – দার্শনিক বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডারকে, যিনি ছিলেন অপর দার্শনিক এরিষ্টটলের ছাত্র, হার মানিয়েছিলেন নিজের জ্ঞান ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে। গ্রীসের সকল দার্শনিক আলেকজান্ডারের কাছে গিয়েছিলেন কিছু পাওয়ার জন্য। কিন্তু সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যাস এই দার্শনিকই কেবল আলেকজান্ডারের কাছে যাননি। তাই আলেকজান্ডার নিজেই গিয়েছিলেন ডিয়ওজীনীসের কাছে। এশিয়া ও ইউরোপ বিসতৃত সম্রাজ্জের সম্রাট এই সাদাসিধে ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি কি চান? উওরে ডিয়ওজীনীস বলেছিলেন তুমি একটু সরে দাঁড়াও, আমি যাতে একটু আলোর উত্তাপ পাই। এবং তুমি এই আলো যেহেতু দিতে পারোনা তাই তুমি এটি কেড়েও নিতে পারোনা। মুগ্ধ আলেকজান্ডার তার সহকারীকে বলেছিলেন যদি আমি পারতাম তাহলে ডিয়ওজীনীসের জীবন বেছে নিতাম।

এই ডিয়ওজীনীস একদিন দিনের বেলায় একটি হারিকেন জ্বালিয়ে কিছু একটা খুঁজছিলেন। এক পথচারী হতবাক হয়ে বললেন তুমি কি খুঁজছো। উওরে ডিয়ওজীনীস বলেছিলেন: একটি সৎ মানুষ খুঁজছি। এই মহামানবই বিশ্ব নাগরিক ধারণার স্রষ্টা যা আজ একুশ শতকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চ্যালেজ্ঞ। আর এ সব কারণেই বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের কারিকুলাম নতুন করে নির্মাণ করছে যাতে তাদের শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক ও বিশ্বমানব হতে পারে। হয়তো এ কারণেই হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের লক্ষ্য হিসেবে চয়ন করেছে ল্যাটিন শব্দ ভেরিটাস যার বাংলা অর্থ সত্যতা। আবার কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় আলো, সদগুন, আমি এখনও শিখছি, প্রভৃতি বিষয়গুলি মটো হিসেব গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মটো হিসেবে গ্রহণ করেছে শিক্ষাই আলো। সেই আলো কখন সবার ঘরে ঘরে পৌছাবে নির্বাচনের আগে জাতি রাজনীতিবিদদের কাছে জানতে চায়। জাতি জানতে চায় করে তাদের সন্তানরা সুনাগরিক হবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত হবে এবং সুবিচার পাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি, পাঠদান, ও নিয়োগ আজ প্রশ্নবাণে জর্জরিত। জাতি চায় এমন উপাচার্য যিনি হবেন সুশিক্ষক ও ন্যাবিচারক। জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে শিক্ষক সমাজের উপর। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাননীয় উপাচার্য়রা কি বিশ্ব নাগরিক সৃষ্টিতে আগ্রহীন হবেন নাকি সহকর্মীদের নিপীড়ন, নীল-সাদা-গোলাপী বিভাজন প্রসার, ও সততা ও যোগ্যতাকে বিসর্জন দিয়ে একটি অন্ধকার যুগে জাতিকে নিয়ে যেতে সু-শিক্ষক ও মেধাবী শিক্ষাথীকে বিতাড়নে মনোনিবেশ করবেন? প্রশ্নটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় স্থান পাবে কী। আমরা আকেজান্ডার যেমন চাই তেমনি চাই ডিয়ওজীনীসকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই সেনানিবাসে গিয়ে একুশ শতকের সশস্ত্রবাহিনী গড়ার কথা বলেন। প্রশ্নজাগে একুশ শতকের উঁচু মানের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও জাতিসংঘ মিশন রক্ষার রাজনীতি দিয়ে জাতি কতটুকু এগোতে পারবে? কাগুজে বাজেটে বরাবরই শিক্ষা সবার উপরে থাকে। তবুও কেন আমরা এতটা পিছিয়ে? সেনাবাহিনী যদি জাতিসংঘ মিশনে যেতে পারে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেন আনর্-জাতিকমানের হবে না? বিশ্ববদ্যালয়গুলির মান উন্নয়নে রাজনীতিবিদদের তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা জনগণ জানতে চায়।

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment