বাংলাদেশের কাটা মন্ডু আর ভয়ঙ্কর অসুস্থ আমরা
অনেক আগে কোথায় যেনো পড়েছিলাম এক এক্সপেরিমেন্টে নাকি দেখা গেছে যে একটা ব্যাঙকে যদি একটা পানি ভর্তি পাত্রে রেখে খুবই আস্তে আস্তে পানির তাপমাত্রা বাড়ানো হয় (স্লো- বয়েল), সে নাকি সেদ্ধ হয়ে মরে না যাওয়া পর্যন্ত নিজের বিপদ বুঝতে পারে না, তাপমাত্রা বৃদ্ধিটা আস্তে আস্তে সয়ে নিতে থাকে।
আমাদেরও কি ওই ব্যাঙের মত অবস্থা? আমরাও কি চরম অবক্ষয়ি চরম নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক সামাজিক আর শাসনিক পরিবেশের স্লো বয়েলের শিকার?
যে পরিবেশে ধিরে ধিরে আমাদের সয়ে যাচ্ছে সব ভয়ঙ্কর বিচারহিন অপরাধ, সাগর চুরির মত দুর্নিতি আর সত্য মিথ্যা আর ডিলিউশেনাল ফ্যান্টাসির ফারাক। আমাদের কাছে এসবই এমন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে যে আমরা এগুলোকেই নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবেই দেখছি; এবং এগুলোর যে কোনোদিন কোনো প্রতিকার বা বিচার বা শাস্তি হবে না, সেটাও কেমন করে জানি আমরা ধিরে ধিরে সব মেনে নিচ্ছি। কদিন একটু কাগজে লেখালেখি, কিছু মন্তব্য প্রতিমন্তব্য, একটা দুটা প্রতিবাদ – তারপর সব ঠান্ডা, তারপর যে যার মত সব ম্যানেজ করে ফেলে – আর আমরাও সব সয়ে সব মেনে নেই, যেন এটাই স্বাভাবিক, এক অস্বাভাবিক স্বাভাবিক।
আমরা যে জাতিগত ভাবে অসুস্থ আর অমানব হয়ে যাচ্ছি তাও কি আমরা বুঝতে পারছি না? আমরা যে আর কিছুদিন পরে মানব সমাজ থাকবো না, তাও কি আমরা বুঝতে পারছি না?
এইতো কদিন আগে দুই কিশোর খেলার ছলে “চল খুন করি” বলে, তাদের এক পরিচিতা আন্টিকে তার দেয়া নাস্তা খেয়ে তারপর, তাকে খুন কোরলো – এ যেনো এক জেনারেশন আগের কিশোরদের দুষ্টুমি করে প্রতিবেশির বাগানের আম চুরির প্ল্যানের মত। আর বিশ্বজিতের খুনি যুবকেরা নাকি তাকে খুন করার পরে রক্তমাখা হাত মুখ খানিকটা ধুয়ে কি না ধুয়ে তাদের নেতার জন্মদিনের পার্টি করেছে, অতন্ত স্বাভাবিক, স্বাভাবিক ভাবে।
আমরা বোধহয় এই নৈরাজ্যকর পরিবেশের স্লো বয়েলের প্রভাবে সবাই ধিরে ধিরে মাফিয়াদের মতো বিবেকহিন অনুভিতিহিন নৃশংস খুনি আর ক্রিমিনাল হয়ে উঠছি। সবাই কটা মাফিয়া সিন্ডিকেটে ভাগ হয়ে খুন গুম আর চুরির মহোৎসবে মেতে উঠেছি। আমাদের একমাত্র বিবেচনা – তুই আমার পক্ষ না বিপক্ষ; আর একমাত্র দন্ধ – তুই খাবি না, আমি খামু।
এগুলো কোন ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর এক অস্বাভাবিক স্বাভাবিক সমাজের আলাআমত আর অশনি সঙ্কেত?
বহু বছর আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধের উপর। তখন সবে মাত্র খেমার রুজদের উত্থান শুরু হয়েছে, কম্বোডিয়ার ক্ষমতায় তখন আমেরিকার আশির্বাদ নিয়ে স্বৈরশাসক জেনারেল লন নল। ওই আর্টিকেলে লন নল বাহিনির সাথে খেমাররুজদের একটা খন্ড যুদ্ধের পরে তোলা এক লন নল সেনার একটা ছবি ছিল – ছবিতে সেই লন নল সেনা স্মিত হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার ডান হাতে ঝুলছে এক খেমার সৈনিকের কাটা মন্ডু, যা থেকে তখনো চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়ছে। ছিবিটির নিচে ক্যাপশন ছিলঃ
“The most chilling thing in the photograph is not the blood dripping severed head, but the smile on the Lon Nol soilder’s face!” অর্থাৎ, “রক্ত চোয়ানো কাটা মুন্ডুটা নয়, রক্ত, সৈনিকের স্মিত হাসিটাই (স্বাভাবিক) সবচেয়ে রক্ত হিম করা বিষয়”
সেই রক্ত হিম করা স্মিত হাসি দিয়ে আর আল্লার নাম করতে করতে নির্বিকার চুরি আর লুচ্যামিতে আমাদের অভস্ত্য করে ফেলেছিলেন স্বৈরশাস্বক।
তারপর আসলো গনতন্ত্র। এখন বাংলাদেশের কাটা মন্ডুটা নিয়ে আমদের নেতা নেত্রীরা স্মিত হাস্যে খেলেই চলেছেন মিউসিকাল চেয়ার, আর স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের আর না হয় নতুন বাংলাদেশের।
সবই আমাদের সয়ে গেছে, সবই বড়ই অস্বাভাবিক স্বাভাবিক। কিছুতেই আমাদের রক্ত হিম হয় না – না বাংলাদেশের কাটা মন্ডুতে, না ভয়ঙ্কর স্মিত হাসিতে।
নির্বোধ
২০ জানুয়ারি ২০১৩