গর্ভবতী মায়ের খাদ্যাভাস ও অটিষ্টিক বেবি
অটিজম শব্দের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। অটিজম হল অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASD) যা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে অকেজো করে এবং নিউরনগুলোকে সিগনাল প্রেরণে বাধা প্রদান করে স্বাভাবিক কর্মকান্ডে। অটিজম সাধারণতঃ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশী দেখা যায় যার বেশিরভাগই জন্মগত। এসব অটিষ্টিক বাচ্চার মানসিক ও শারীরিক গ্রোথ স্বভাবিক বাচ্চার থেকে ভিন্ন এবং আচার-আচরণ অনেকটা অস্বাভাবিক বা বিকারগ্রস্ত। বয়সের সাথে সাথে অটিষ্টিক বাচ্চারা বাড়তে থাকলেও বিশাল গ্যাপ দেখা যায় (মন ও মননে) সমবয়সের স্বাভাবিক বাচ্চার তুলনায়। পরিণত বয়সে বা যৌবনে অটিষ্টিক বাচ্চারা কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বন্ধু সংঘে তারা অনেক সময় বেমানান এবং পিছনের কাতারে। এ ছাড়াও অনেকক্ষেত্রে বার্ধক্যে অটিজম আবার ফিরতে দেখা যায় অনেকের ক্ষেত্রে।
এ রোগের প্রতিকার অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এই টেকনোলজির যুগে অর্থের পিছে তাড়া করতে করতে কারো সময় নাই অটিষ্টিক বাচ্চার দেখভাল করার। অনেকে আবার হাল ছেড়ে দেয় বাচ্চার অটিজম ভাল হবে না ভেবে যা রুপ নেয় পার্মানেন্ট ডিসাবিলিটি’তে। এ নিয়ে বিস্তর রিচার্য হয়েছে ও হচ্ছে এবং অনেকে এ রোগের কারণ খুজে পেয়েছে বলে চেচামেচি করছে। দুংখের বিষয় হল, এসব রিচার্য হালে পানি পাচ্ছে না আজোব্ধি। শুনে অবাক হবেন যে, অষ্ট্রেলিয়ার মত উন্নত দেশেও অটিষ্টিক বাচ্চার সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২০-২৫ ভাগ। এ কথার অর্থ হল, প্রতি ৪/৫ জন বাচ্চার মধ্যে ১ জন অটিষ্টিক বেবি [Australian Bureau of Statistics; Autism Spectra Australia]। অপেক্ষাকৃত কম হলেও অনুন্নত দেশেও এর ব্যাপক বিস্তৃতি আছে উন্নত দেশের তুলনায়, কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে না কারণ তারা সমাজের অগোচরে থাকে। উন্নত দেশে অটিষ্টিক বাচ্চার শিক্ষার ব্যবস্থা থাকায় তারা আলোয় আসে এবং দেরীতে হলেও তারা সমাজে স্থান করে নেয়ার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা করে।
অনেকের মতে এ রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করা উত্তম। কিন্তু প্রতিরোধ করাটা যে অত্যন্ত জঠিল ও কঠিন তাতে কোন সন্দেহ নেই কারণ প্রতিরোধের সঠিক কোন ব্যাকরণ কারো জানা নেই। তবে ইদানিং অটিষ্টিক বাচ্চার জন্মদান প্রতিরোধে কিছু রিচার্য হচ্ছে এবং কিছু ব্যাকরণ খুজে পাওয়া গেছে যার মধ্যে গর্ভবতী মায়ের খাদ্যাভাস বিশাল ভুমিকা রাখে [WHO, UNEP]। অতিসম্প্রতি আমি একজন গর্ভবতী মায়ের দেহে কি পরিমাণ মারকারি/পারদ (Hg) থাকলে অটিষ্টি বাচ্চার জন্ম হতে পারে তা নিয়ে কিছু কাজ করছিলাম যা এখানে তুলে ধরছি পাঠকদের জন্য।
টেবিল ১|| Hg যেসব অর্গানকে ক্ষতি করে |
|
বহুরূপী Hg |
Target organ |
এলিমেন্টাল Hg০ |
ব্রেন, কিডনি, ফুসফুস |
ডায়ভালেন্ট Hg2+ |
কিডনি |
CH3Hg |
ব্রেন, ফেটাল ব্রেন |
জঠিল অটিষ্টিক রোগ মুক্তির ব্যাকরণ যখন অজানা, তখন গর্ভকালীন সময়ে মায়েরা খাবারের মেনু কন্ট্রোল করলে অটিষ্টিক বাচ্চা জন্মদান থেকে রেহাই পেতে পারে! আমরা জানি যে, আমাদের দৈনন্দিন খাবারের মধ্যে অনেক রকমের মিনারেল আছে যা আসে সরাসরি মাছ ও মাংশ থেকে (প্রোটিনযুক্ত খাবার ও মিনারেল থেকে) যেমন Zn, Mg, Ca, F, Fe, Hg (মারকারি/পারদ), ইত্যাদি। এগুলো আমাদের শারীরিক গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; বিশেষ করে হাড় ও মাসলস গঠনে – যা আমাদের গ্রোথ কন্ট্রোল করে। কিন্তু এ গুলোর মাত্রা বেশী হলে বিপরীতে হীত হত, দেখা দিতে পারে মরন ব্যাধি। মিনারেল ও মাল্টিভিটামিন নিয়ে আমি আগেও একটা লেখা লিখেছিলাম যার রেফারেন্স এখানে দেয়া গেল। অনেকগুলা মিনারেল আছে যারা শরীরের ক্ষতি সাধন করে অধিক মাত্রায় খেলে। কিন্তু অধিক মাত্রায় Hg (পারদ) মিনারেল দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কারণ এটা বিশেষতঃ বিশ যা আমাদের অনেকগুলা অরগ্যানকে অকেজো করে ফেলতে পারে। টেবিল ১ এ পারদের (Hg) প্রভাবে মানব দেহের সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত অরগ্যানগুলো দেখানো হল। বলা বাহুল্য, পারদ বা Hg হল নিউরোটক্সিন যা ক্যান্সার সেল তৈরী করে এনিমেল কোষে, ডিএনএ ড্যামেজ করে, এবং সর্বোপরি বাচ্চার ডেভোল্পমেন্ট কমপ্লেক্স তৈরী করে যার অপর নাম হল অটিজম। এ লেখাতে আমি শুধু Hg নিয়ে আলোচনা করবো যা অটিষ্টিক বাচ্চার জন্মের জন্য অনেকটা দায়ী বলে ধারণা করা হয় [Autism Recovery Centre]।
টেবিল ২ |
|
মাছের নাম |
CH3Hg পরিমাণ (ppm) |
সার্ক |
0.৯৯৮ |
সোর্ড |
0.৯৭৬ |
টুনা |
0.৬৩৯ |
বাসাফ্লেট |
0.৩৮৬ |
হ্যালিবাট |
0.২৫২ |
সাল্মন |
0.০১৪ |
তেলাপিয়া |
0.০১ |
লবষ্টার |
0.৩১ |
আমাদের চারিপাশে অসংখ্য উপাদান আছে যাতে Hg ব্যবহার করা হয় যেমন ইলেক্ট্রিক বাল্ব (বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব), দাতের যন্ত্রপাতি, থার্মোমিটার, ইন্ডাস্ট্রি বর্জ, ইত্যাদি। উদাহরণস্বরুপ, এনার্জি সেভিংস বাল্ব ব্যবহার শেষে যেখানে-সেখানে ফেলে দিলে তা ভেঙ্গে Hg বিষ নির্গত হতে থাকে। এটি খুব সহজেই বায়ু ও পানিতে মিশে যায়, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এ ছাড়াও Hg কন্টামিনেশনের বিশাল একটা অংশ আসে ইন্ডাষ্ট্রি বর্জ থেকে যেখানে ২৪/৭ নানারকম কেমিক্যাল তৈরী হচ্ছে। দুংখের বিষয় হল এগুলো ডাম্প করা হয় বা দ্রবীভূত করা হয় পানিতে বা মাটিতে। ফলে অতি সহজেই এগুলো আমাদের নদনদী বা সমুদ্রের তলদেশে চলে যায়; মিশে যায় আমাদের ফুড চেনে (পারদ -> পানি/মাটি -> মাছ/পশু-পাখি -> মানুষ)। সমুদ্রের বা নদীর তলদেশে ব্যাকটেরিয়ার আধিক্যের ফলে এলিমেন্টাল Hg মিথাইল মারকারিতে (CH3Hg) রূপান্তরিত হয় যা টোটালি বিষ। নদনদীর বা সমুদ্রের বড় বড় মাছ এ বিষ (CH3Hg) খেয়ে জীবন ধারণ করে। আজকাল মিঠাপানির মাছ না থাকায় সব দেশেই এখন বড়বড় নদনদী বা সমুদ্রের মাছ আহরণ করা হচ্ছে; সাপ্লাই দেয়া হচ্ছে বাজারে রকমারি সাজে। ক্রেতার মান যাচায়ের কোন সুযোগ না থাকায় এগুলা ক্রয় করে হরহামেশা খাচ্ছে যেখানে বিষের আধিক্স বেশী। এখানে একটা নমুনা দেয়া গেল টেবিল ২ কোন মাছে কি পরিমাণ CH3Hg আছে (প্রতি কেজি মাছে) যা সচরাচর আমরা খায়।
আমরা যারা মাছ খাই তাদের জানা দরকার মাছে খদ্যমান অনুযায়ী কি পরিমাণ Hg থাকা উচিত। অন্য কথায়, কি পরিমাণ মাছ আমরা খেতে পারি প্রতিদিন যাতে বিষ মেশানো আছে। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকায় কি পরিমাণ সামুদ্রিক মাছ প্রতি সপ্তাহে থাকা উচিত তা জানা জরুরী যা অটিষ্টিক বাচ্চার জন্য দায়ী। উল্লেখ্য, অতি মাত্রায় Hg সেবন শুধুমাত্র অটিজমের জন্য দায়ী নয়, এটি Attention Deficit Hyper Disorder (ADHD) রোগেরও কারন। Low-level prenatal Hg exposure is associated with a greater risk of ADHD-related behaviours. Live viral vaccines contain as much as 25 g (per 0.5 mL) of Hg (as Thimerosal) per dose. The “per 0.5 mL” was added to Goldman’s statement in accordance with data provided by the Institute for Vaccine Safety (IVS), which shows that many vaccines actually contain the equivalent of 50 g of Hg per mL of vaccine. In vaccines that contain added Thimerosal, which include multi-dose vials of flu vaccine, levels of Hg are as much as 50 times higher than the 1 g/mL. এগুলা ফলোআপ করে টেবিল ৩ এ দেশ অনুযায়ী একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতি সপ্তাহে কি পরিমাণ CH3Hg এ্যাফেক্টেড মাছ গ্রহণ করতে পারে তার একটা নমুনা দেয়া গেল।
টেবিল ৩ |
|||
দেশ |
মাছের নাম |
মাছে CH3Hg পরিমাণ |
গর্ভবতী মা খেতে পারে (প্রতিসপ্তাহে) |
অষ্ট্রেলিয়া |
সোর্ড, টুনা, বারমুন্ডি, সার্ক |
1.0 Hg/kg |
2.8 mg Hg/Kg* |
কানাডা |
সার্ক, সোর্ড, টুনা |
0.2~0.5 ppm Hg |
0.47 mg Hg/Kg |
জাপান |
সামুদ্রিক মাছ |
0.3~0.4 mg Hg/Kg |
0.17 mg Hg/Kg |
আমেরিকা |
সার্ক, সোর্ড, টুনা, পাইক |
o.5~1.o mg Hg/Kg |
0.1 pg Hg/Kg |
বাংলাদেশ |
কোন ডাটা নাই। |
*2.8 g Hg/Kg মানে 2.8 g মাছ খাওয়া যাবে প্রতি সপ্তাহে যেখানে CH3Hg আছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো দেহের ওজন ১ কেজি হয়, তবে সে প্রতিসপ্তাহে 2.8 মাইক্রোগ্রাম টুনা খেতে পারবে।
WHO এবং UNEP অতিসম্প্রতি কিছু CH3Hg এ্যাফেক্টেড মাছের ডাটা রিলিজ করেছে। তাদের স্টাডি অনুযায়ী, একজন গর্ভবতী মা প্রতিদিন 0.১ g/Kg মাছ খেতে পারে যেগুলো CH3Hg ধারণ করে (নীচের গ্রাফে দেখানো হল)। বলা বাহুল্য, ২০০৬ সালের এক রিচার্য থেকে দেখা গেছে যে, ৮৫% অটিষ্টিক বাচ্চার দেহে অধিক পরিমাণ CH3Hg আছে (400 g/Kg)। এ থেকে আরো প্রমানিত হয়েছে যে, CH3Hg পরিমাণ/মাত্রা কমলে অটিষ্টিক বাচ্চার অটিজম ন্যাচার কমে যায়। রিচার্যের ভাষায়ঃ The data suggests a strong link between the level of Hg and autism. While Hg is not the only factor, it appears to be the major factor. Although fish is a healthy food, it is unfortunate that because of ocean and river pollution, high level of Hg in fish has become a serious problem, especially for children with autism [Autism Recovery Centre].
আমরা যারা মাছে-ভাতে বাঙালী তারা মিঠা পানির মাছের স্বাদ ভুলে এখন সমুদ্রের মাছের প্রতি অশক্ত হয়েছি। বিশেষ করে আমরা যারা বিদেশে বাস করছি তারা প্রতিনিয়ত সমুদ্রের তলদেশের মাছ খেয়ে থাকি যাতে CH3Hg মাত্রা অধিক। ফলে গর্ভকালীন সময়ে আমাদের খ্যাদ্যাভাস পরিবর্তন করা না গেলে পরবর্তী বংশধর সুস্থ্য ও সবল না হয়ে অটিষ্টিক হতে পারে। WHO ও UNEP এর মতে একজন গর্ভবতী মা 0.১ g/Kg/Day Hg উর্বর মাছ খেতে পারে। এ কথার অর্থ হল যে, প্রতি ৫০ কেজি ওজনের একজন গর্ভকালীন মা প্রতিদিন সর্বোচ্চ 0.000৫ গ্রাম Hg এ্যাফেক্টেড মাছ খেতে পারে। অন্য কথায়, ৫০ কেজি ওজনের একজন গর্ভকালীন মা প্রতি সপ্তাহে 0.0035 গ্রাম সামুদ্রিক মাছ খেতে পারে। ফলে খাবারের মাত্রার দিকে নজর দিলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, একজন গর্ভকালীন মা Hg এ্যাফেক্টেড মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে তার বাচ্চার সুস্থ্যতার জন্য।
লেখকঃ আমলামুন আশরাফী
রিচার্য সাইন্টিন্স ও প্রাবন্ধিক