আর কতকাল রক্ষক হবে ভক্ষক!

আর কতকাল রক্ষক হবে ভক্ষক!

ঘটনা ১

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট। ইয়াসমিন নামের ১৪ বছরের এক কিশোরী ধানমন্ডির একটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। বাড়ি দিনাজপুর। আট-নয় মাস কাজ করার পর, মাকে দেখার জন্য ইয়াসমিন গৃহকর্তাদের কাউকে কিছু না জানিয়েই দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁগামী নৈশকোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে উঠে বসে।

কিশোরীটি তখনও জানত না এই বাসটি দিনাজপুর নয়, ঠাকুরগাঁ শহরে যাবে। ভুল বাসে উঠেছে জানার পর কোচের সুপারভাইজার খোরসেদ আলম ও হেলপার সিদ্দিকুর রহমান ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী বাসের জন্য দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ-রংপুরের টার্নিংপয়েন্ট দশমাইল নামক স্থানে নামিয়ে দেয়।

দিনটি ২৪ আগস্ট। ইয়াসমিন যখন দশমাইল নামক স্থানে বাস থেকে নামে তখন কেবল ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু ইয়াসমিন জানত না পৃথিবীতে আলো ফুটলেও তার জীবন হারিয়ে যাবে মৃত্যুর গহীন অন্ধকারে।

দশমাইলে চায়ের দোকানগুলো তখনও সজাগ। কোচের সুপারভাইজার ও হেলপার জোবেদ আলীর চা স্টলের মালিককে অনুরোধ করে যেন ইয়াসমীনকে দিনাজপুরগামী কোনো একটি বাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়।

কোচের সুপারভাইজার ও হেরপার ইয়াসমীনকে দশমাইল নামক জনাকীর্ণ জায়গায় নিরাপদে নামিয়ে দিয়ে চায়ের স্টলের মালিককে ইয়াসমিনকে পরবর্তী বাসে উঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। মনুষত্বের পরিচয় দিয়েছেন। জানা যায়, সেসময় অসহায় মেয়েটিকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনেকেই আগ্রহী ছিলেন। তবুও পান দোকানদার রহিম ও চায়ের স্টলের মালিক নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে অসহায় কিশোরীটিকে অন্যদের সঙ্গে না পাঠিয়ে দিনাজপুরের বাসেই তাকে উঠিয়ে দেবে বলে সবাইকে জানিয়ে দেয়।

এ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক ছিল। গোলমাল বাধে তখনই যখন সেই স্থানে জনগণের জান-মালের হেফাজতের দায়িত্বে থাকার শপথ নেওয়া পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান এসে পৌঁছায়। পিকআপের ড্রাইভার অমৃতলাল, এস আই মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার ইয়াসমিনকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে।

কিশোরীটি তখনও পুলিশের সঙ্গে বাড়ি যেতে ভরসা পায়নি। নিজেই বাড়ি যেতে পারবে জানালেও অতি উত্সাহী, মানবদরদী (?) পুলিশ ধমক দিয়ে তাকে পিকআপে উঠিয়ে নেয়।

ইয়াসমিনের অবচেতন মনই হয়ত চোখের সামনে কিছু অমানুষের অস্তিত্ব তাকে টের পাইয়ে দিয়েছিল! ত‍াই হয়ত পুলিশের সঙ্গে যেতে এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল তার। অসহায় কিশোরীটি দিনাজপুর যাওয়ার সঠিক পথের সন্ধান পেলেও কতগুলো অমানুষের হাত থেকে মুক্তি পাবার কোনো পথ খুঁজে পায়নি।

ভ্যানটি রওয়ানা দেওয়ার আড়াই’শ থেকে তিন’শ গজ দূরত্বের মধ্যেই সাধনা প্রাইমারি স্কুলের কাছে পুলিশের নৃশংসতার শিকার ইয়াসমিন ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে। শিকার ধরা হায়েনার মতোই টর্চের জ্বলজ্বলে আলো দিয়ে খুঁজে রাস্তায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনকে ওরা আবারও ভ্যানে তুলে নেয়।

সকালের স্নিগ্ধ আলোয় এলাকাবাসী স্কুলে যাওয়ার রাস্তার ওপর রক্তের দাগ দেখতে পায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল সস্তায় কেনা ইয়াসমিনের স্যান্ডেল, রুমাল, হাতপাখা আর ভাঙা চুড়ি। ইয়াসমিনের লাশ মেলে গোবিন্দপুর সড়কের ব্র্যাক অফিসের সামনে। পানের পিক ফেলার মতোই ভ্যান থেকে ইয়াসমিনের ক্ষত-বিক্ষত দেহ ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল কিছু মানুষরূপী হায়েনা (পুলিশ)।

ইয়াসমিনের মৃত্যুতে প্রতিবাদমুখর হয়েছিল সাধারণ জনগণ। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল তারা। অসহায় কিশোরীটির জানাজাও হয়নি শেষ পর্যন্ত। জানাজা ছাড়াই তাকে দাফন করা হয়েছিল।

রক্ষকই যে ভক্ষক হয় কথাটা ইয়াসমিন জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিল। মানুষ কখনো কখনো কতোই না অনিরাপদ এইসব পুলিশের কাছে!

ঘটনা ২

২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে ভুল পথে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চলে আসে একটি কিশোরী। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পথহারা অসহায় কিশোরীটি বাসায় ফেরার জন্য রাস্তার পাশে কাঁদছিল।

পুলিশ আবারও প্রমাণ করলো তারা আসলে রক্ষক হয়ে উঠতে পারেনি, ভক্ষকই রয়ে গেছে।

১৯৯৫ সালের ধর্ষিতা ইয়াসমীন আবারও ধর্ষিত হয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। এবারও ধর্ষকের ভূমিকায় পুলিশ। পুলিশের হেফাজতে তিন দিন থানায় আটকে রেখে মেয়েটিকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করা হয়।

না, এবার নির্যাতিত এই কিশোরীটিকে ইয়াসমিনের মতো মরতে হয়নি। এই ইয়াসমিন এখনো জীবিত।

বর্বরোচিত ঘটনার শিকার ছোট্ট এই মেয়েটির এত বড় ক্ষতি করার দায় বাংলাদেশ পুলিশকেই নিতে হবে। মেয়েটিকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা তাদেরই করে দিতে হবে।

যে মেয়েটি পথ হারিয়ে রাস্তায় বসে কাঁদছিল, যে মেয়েটিকে পরম যত্নে, নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারত, সে মেয়েটির জীবনকে সীমাহীন অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য ওই সব নরপশুদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক।

আমরা ইয়াসমিনদের বারবার নির্যাতিত হতে দেখতে চাই না। আমরা চাই দিনাজপুরের ইয়াসমিন শান্তিতে ঘুমিয়ে থাক, আর দেশের আনাচে-কানাচে যত ইয়াসমিন আছে তারা নিরাপদ থাকুক। হায়েনারূপী পুলিশ কিংবা কোনো রক্ষকরূপী ভক্ষক নয়, আমরা চাই সত্যিকারের জনগণের সহযোগী, সহমর্মী পুলিশ। যারা পথহারা ইয়াসমিনদের সঠিক পথের সন্ধান দেবে, নিরাপদে পৌঁছে দেবে মায়ের কোলে।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment