হুমায়ূন আহমেদঃ সাহিত্য ও বিত্তের যাদুকর
কথাসাহিত্যের যাদুকর লেখক হুমায়ূন আহমেদএর লেখালেখির ভুবন যেমন ছিল বিশাল বিসত্মৃত তেমনি তাঁর জনপ্রিয়তাও আকাশচুম্বী৷ হুমায়ূনের সমসাময়িক জনপ্রিয় একের বেশী গুণী লেখক একটা বিষয় দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করেছেন যে বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরত্চহন্দ্রের পর যাঁর লেখা বহুল পঠিত হয়েছে তিনি হুমায়ূন আহমেদ৷ কি এক যাদু ছিল তার লেখনীতে যা হ্যামেলিনের সেই বাঁশীওয়ালার মত পাঠককে আবিষ্ট করে রাখে৷
হুমায়ূন আহমেদ রূপকথার কারিগর ছিলেন না, ছিলেন জীবনকথার যাদুকর৷ অতীতের যাপিত জীবন বা ভবিত্ষ্য তের কল্পিত জীবনচিত্র হুমায়ূন আঁকেননি৷ তার সাহিত্যভাবনা মূলতঃ আবর্তিত বহমান বর্তমানের জীবনকে ঘিরে৷ মধ্যবিত্ত জীবনের অলিগলি, তার বঞ্চনার হতাশা, প্রাপ্তিরতৃপ্তি, কৌতুকবেদনা গভীরভাবে উপলব্ধি করার মন ও পর্যবেক্ষন করার অসাধারন চোখ নিয়ে জন্মেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ৷ তবে বিনয়ের সাথে স্বীকার করছি এইকথাটি তাঁর লেখাবিষয়ে অতি সরলীকৃত একটি বক্তব্য৷ প্রথমতঃ এতো অল্প কথায় সাহিত্য ভাবনার রূপচিত্র তুলে ধরা ধৃষ্ঠতা৷ দ্বিতীয়তঃ হুমায়ূন আহমেদ অতো সহজপাঠ্য নন৷
কোন এক অদৃশ্য শক্তি হুমায়ূনকে দিয়েছিল আনন্দ বিতরনের অলৌকিক ভার তবে তার সৃষ্টির ভুবনে ভ্রমন করলে দেখা যায় সেখানে শুধু আনন্দ নয় রহস্যও অপার৷
কবিতা ছাড়া সৃজনশীলতার সবপথে হুমায়ূন তাঁর বিজয় কেতন উড়িয়েছেন৷ চল্লিশ বছর এক নাগাড়ে তাঁর লেখনীতে তিনশ’এর বেশী বই সৃষ্টি হয়েছে৷ উপন্যাস, গল্প, শিশু-কিশোর সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, আত্মজৈবনিক লেখা, নাটক, সিনেমার স্ক্রিপ্ট, গান কোনটা লিখেন নি৷ হুমায়ূন আহমেদ দুই চরিত্রকে কেন্দ্র করে দু’টি কাহিনি গড়ে তুলেছেন৷ একজন হিমু, অন্যজন মিসির আলি৷ এরা গোয়েন্দা নয়, পরোপকারী ডাকাত-দস্যু নয়৷ তবে এরা কারা? মিসির আলি মনসত্মত্ববিদ যিনি লজিক মেনে রহস্যভেদে নিয়ত ব্যসত্ম৷ অন্যদিকে হিমু এ্যান্টিলজিকে চলে৷ দুজনই রহস্যপ্রিয় লেখকের রহস্যঘেরা চরিত্র৷ মিসির আলির বিষয়ে অনেক পাঠক যেমন আগ্রহী তেমনি হিমুর বিষয়ে বিপুলসংখ্যাক পাঠক আবিষ্ট ৷ তবে নিষ্ঠ পাঠকের দৃষ্টিতে হিমু শুধু হলুদ রং নিয়ে আলাভোলা একজন নয় তারও চেয়ে বেশী কিছু৷ লেখকের ছোটভাই কার্টুনিষ্ট আহসান হাবিব বলেছেন মিসির আলি বা হিমু চরিত্র তাকে তেমন টানে না৷
হুমায়ূন সাহিত্যের প্রচলিত নিয়মের এক ব্যতিক্রম৷ মধ্যবিত্ত জীবনের গল্পই তার সাহিত্যভাবনার কেন্দ্রে৷ এই জীবনের গল্পের কথক উপন্যাস লিখলেন যার পৃষ্ঠা সংখ্যা নিতানত্মই কম৷ তাঁর গল্প বিস্তৃত হয় সংলাপের মাধ্যমে বর্ননায় নয়৷ মাত্র ৬৪পৃষ্ঠার ছোট্ট উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্র্রকাশিত হল৷ তাতেই সাড়া জাগালেন, পুরষ্কার জিতে নিলেন৷ প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’৷ তবে প্রথম লিখিত উপন্যাস ‘শংখনীল কারাগার’ যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ষাট৷ এখানেও মধ্যবিত্তের জীবনই চিত্রিত হয়েছে৷ এই উপন্যাসের কাহিনিই প্রথম চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে ৷ চলচ্চিত্রটির নামও ছিল ‘শংখনীল কারাগার’৷ শিশু কিশোরদের নিয়ে লেখা ‘পুতুল’ নামের উপন্যাসটির কাহিনি নিয়ে ‘দূরত্ব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে৷ এই উপন্যাসের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৩৯৷ লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিজে এই ছবির নির্মাতা নন৷ নির্মাতা ছিলেন মোর্শেদুল ইসলাম৷ এর কাহিনির মাঝে সমাজের দরিদ্র-ধনী দু’দলের কিছু মানুষের জীবনের কিছুটা সময়ের চালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে৷ এখানে দেখা যায় বিত্ত মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে আর দারিদ্র মানুষকে একাত্ম ও সহমর্মী করে৷
এই লেখকের বিশেষত্ব হচ্ছে তাঁর ম্যাজিক৷ এক নাগাড়ে চল্লিশ বছর ধরে অজস্র লিখেছেন, নাটক তৈরী করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন৷ সব শাখায় তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষনীয়৷ বাংলা একাডেমীর ২০০৪সালের তথ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পারি যে তার আগের দুইদশক থেকেই হুমায়ূন রয়েছেন বেস্ট সেলার তালিকার শীর্ষে৷ চল্লিশ বছরে সময় পাল্টেছে, পাঠকও পাল্টেছে কিন্তু হুমায়ূনএর লেখার জনপ্রিয়তা কমেনি বরং দিন দিন বেড়েছে৷ চল্লিশ বছর ধরে তাঁর এই জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে লেখক নিজেই বলেছিলেন ‘এটা একটা ম্যাজিক, কি করে এটা হয় তা জানি না৷’
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ অনেক লিখেছেন৷ ইতিহাস বই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য দিতে পারে বা দেবে আর হুমায়ূনের লেখনীর লালিত্য মুক্তিযুদ্ধের আবেদন ও স্বাধীনতার মর্ম পাঠকের হূদয়ের গভীরে পৌঁছে দেয় ও দিচ্ছে৷ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘জ্যোসনা ও জননীর গল্প’ বইটির কাহিনি বিবৃত হয়েছে ৪৯২পৃষ্ঠা জুড়ে, যদিও বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা সব মিলিয়ে ৫০৫৷
হুমায়ূনের প্রায় বইই অনেক বার মুদ্রিত হয়েছে৷ ষোলতম মুদ্রণও হয়েছে কোন কোন বইয়ের৷
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন আবার জন্ম হলে উনি হিমু হয়ে জন্মাতে চান৷ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় হিমুর চরিত্রের কিছু যেন হুমায়ূন আহমেদএর মাঝেও ছিল৷ হিমুর intuition এমন যে ভবিত্ষ্যনতে কি হবে, কি ঘটবে তা সে জানে, বলেও দেয়৷ লেখকও মনে হয় হিমুর মতোই কি ঘটবে তা আঁচ করতে পারতেন৷ না হলে ২০০৯এ যখন লেখক স্বাস্থ্যসম্পদে ভরপুর আনন্দে আকন্ঠ নিমজ্জিত তখন তাঁর বই ‘বলপয়েন্ট’এর উত্সঘর্গ বয়ান লিখলেন পুত্র নিষাদ হুমায়ূনের উদ্দেশ্যে
‘বাবাকে সে খুব বেশীদিন কাছে পাবে বলে মনে হচ্ছে না৷ যদি কোনো বিষন্ন চৈত্রের দিনে বাবার কথা জানতে ইচ্ছা করে, তখন এই বই সে পড়বে৷ এবং সে নিশ্চয়ই বলবে, আমার বাবা ছিলেন একজন ‘দুঃখী বলপয়েন্ট’৷’
হিমুর মতোই হুমায়ূনের intuition power; অসুখের অসত্মিত্তই যখন জানা ছিল না তখন লেখক মনে মনে জানতেন পুত্র তাঁকে বেশীদিন কাছে পাবে না!
শুধু লেখালেখি করে মানুষ আর কত অর্থবিত্ত অর্জন করতে পারে? সাহিত্য আর বিত্ত একসাথে চলে কি? তবে হুমায়ূন আহমেদ ভাগ্যের বরপুত্র৷ আমি তাঁর একটা বই নিয়ে অংক কষতে বসি৷ হুমায়ূনের দেওয়া তথ্য অনুসরন করে গুণ করতে করতে মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা৷ তাঁর বই ‘মাতাল হাওয়া’ বেছে নিয়েছিলাম৷ বইটি ২০১০এর ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসেই ছয়টি মুদণ হয়েছিল৷ বিক্রয় থেকে অর্জিত অর্থের পরিমাণ কোটি(১,০৫০,০০০০) টাকারও বেশী!
(২০১২তে বাংলা সাহিত্য সংসদ মেলবোর্ন আয়োজিত লেখকের স্মরণসভায় উপস্থাপিত প্রবন্ধ)