বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরাই কি ছাত্র অপরাজনীতির জন্য দায়ী নয়?
১.
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে একজন ছাত্র-ছাত্রীকে মেধা ও যোগ্যতা সবকিছু থাকার পরেও শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার জন্য আরও একটি বিশেষ যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, আর তাহল তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা।
শিক্ষক হবার জন্য যে কয়জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী আবেদন করেন, প্রথমেই খোঁজ নেয়া হয়, ছাত্র অবস্থায় সে কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিল কি না। যদি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত না থাকেন, তবে প্রতিযোগিতা থেকে অটোমেটিক সেই প্রার্থী ছিটকে পড়েন। যতই ভালো রেজাল্ট থাকুক না কেন, সেই ছাত্র-ছাত্রী এই আমলে কোনো শিক্ষক হবার কোনো চান্স নেই জেনে চুপচাপ অন্য চাকুরীর চেষ্টা করেন কিংবা নিজের সমর্থিত দল ক্ষমতায় এলে শিক্ষক হবেন সেই আশায় দিন গুনেন।
সেইসব প্রার্থী যারা ছাত্রাবস্থায় ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন করে শিক্ষক হবার প্রতিযোগিতায় টিকে যান, তাদের মধ্যেও দেখা হয় কার তদবিরের খুঁটির জোর কত। অনেক প্রার্থী ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের পছন্দে শিক্ষক হন, কিংবা উপরমহল থেকে শক্ত সুপারিশ এলে মাঝারিমানের রেজাল্ট নিয়েও শিক্ষকতার চাকুরী নামক সোনার হরিনের সন্ধান পেয়ে যান।
তবে একথাও ঠিক যে, নির্ভেজাল দলীয় নিয়োগের প্রার্থী যদি মেধা তালিকার কিছুটা পিছনের দিক থেকে নিয়োগ পেয়ে থাকেন, তবে ব্যালান্স করার জন্য রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাহীন সব থেকে মেধাবী প্রার্থীকেও নিয়োগ দেয়ার ঘটনা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তবে অলিখিত শর্ত হিসেবে যেই শিক্ষকেরা যে আমলে নিয়োগ পান, সেই দলের রং এর ছাতার নিচেই তাকে অবস্থান করতে হয়।
এভাবেই দিনের পর দিন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের মাঝে চলছে রংয়ের খেলা। কেউ নীল দল, কেউ সাদা বা সোনালী দল।
২.
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব কমন একটা বিষয় “হল দখল”। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের ছাত্রসংগঠনটি হেরে যাওয়া দলের সব ছাত্রদের হল থেকে বের করে দিয়ে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। রক্তপাতের আশংকায় অবশ্য হেরে যাওয়া দলের ছাত্ররা এমনিতেই হল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। প্রায় সময়ই সেই আমলের মার্কামারা নেতারা যারা একসময়ের ক্যাম্পাসের ত্রাস ছিল, তারা ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষিত থাকে। অনেকে পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়ার জন্য ক্যাম্পাসে আসতে পারে না। ফলে এরা পড়াশুনা শেষ না করেই ৫ বছর ধরে নিজেদের দলের ক্ষমতায় ফেরার প্রতিক্ষায় থাকে। আর এর ফলেই আমরা পরবর্তিতে চুল-দাড়ি পেকে যাওয়া স্কুলে পড়ুয়া সন্তানের পিতাকেও ছাত্রনেতা হিসেবে দেখতে পারি।
ওপরদিকে ছাত্রদের চর দখলের মত হল দখলগুলো এতই স্বাভাবিক একটি বিষয়ে দাঁড়িয়েছে যে, শিক্ষকেরা এসব নিয়ে মোটেও তেমন চিন্তিত হন না। সদ্য হেরে যাওয়া রাজনৈতিক দলের ভিসি ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত শিক্ষকেরা ভালো করেই জানেন তাদের দিন শেষ, ক্ষমতা ছেড়ে দেবার সময় এসেছে। তাই, কোনরকম দ্বিরুক্তি ছাড়াই তারা পদ ছেড়ে ডিপার্টমেন্ট এ পুনরায় শিক্ষকতা ও গবেষনার কাজে মন দেন। মাঝে মাঝে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন ও নিজেদের স্বার্থবিরোধী বা স্বার্থের জন্য নড়ে চড়ে উঠেন!!
আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একই রংয়ের শিক্ষকদের মাঝেও থাকে গ্রুপিং। সব গ্রুপের কিছু নেতাগোছের শিক্ষকদের লক্ষ্য থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরে প্রশাসনের অন্যান্য লোভনীয় পদ।
কেউ কেউ আবার লবিং করে থাকেন আরো উপরের কোনো পদ, যেমন ইউজিসির চেয়ারম্যান বা মেম্বার, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান-মেম্বার, প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার, বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার বা অন্যান্য বড় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদস্থ পদে ৫ বছরের জন্য লিয়েন নিয়ে যেতে।
ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকেরা সর্বোচ্চ পদ পাবার আশায় ছাত্রদের নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করে থাকেন। নিজেদের স্বার্থেই ছাত্র সংগঠনের নেতাদের অন্যায়-আবদার মেনে নিয়ে তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। আবার অনেক সময়, সারা বছর ক্লাস, টিউটরিয়াল কোনো কিছুতেই অংশগ্রহণ না করেও এসব ছাত্রদের নাম মাত্র পরীক্ষা দিয়ে পাশ করিয়ে দেবার নজিরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুরি ভুরি দেখা যায়।
ভালো ছাত্রদের অনেককেই দেখা যায় রাজনৈতিক “পাওয়ার ফুল” শিক্ষকদের পিছনে মোসাহেবের মত ঘুরতে যাতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া যায়। কেউ কেউ ছাত্রনেতাদের খেলার পুতুল হয়ে যায়, অনেকেই মোটা অংকের টাকা ছাত্রনেতাদের কাছে ঘুষ হিসেবে দিয়ে থাকে শিক্ষক হবার জন্য।
মূলত কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী, উচ্চাভিলাষী শিক্ষকেরাই ছাত্রদের অপরাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকেন। তাদের ছত্রছায়ায় ছাত্ররাজনীতি ডালপালা মেলে একসময় এত ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, নিয়ন্ত্রনের বাহিরে যাওয়া এই সব ছাত্রনেতাকে “ম্যানেজ” করা তাদের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে যায়। ফলে ছাত্রদের হাতে শিক্ষক লাঞ্চিত হবার মতো অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো আজকাল প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠছে।
ছাত্রদের রাজনীতিতে সহয়তা করে তারা কি ছাত্রদের উপকার করছেন? নাকি সেই সব ছাত্রদের সীমাহীন বিপদের মুখে নিপতিত করছেন? যেখান থেকে ফেরার পথ অনেকেরই চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেশের প্রত্যেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রক্তের দাগ লেগে আছে শুধুই ছাত্র অপরাজনীতির কারণেই।
৩.
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অবশ্যই রাজনৈতিক সচেতন হবেন, কিন্তু দলীয় শিক্ষক হিসেবে কেন তাদের পরিচয় শিক্ষকতার পরিচয়কে ছাপিয়ে যাবে? কেন একজন শিক্ষক “ব্লু/হোয়াইট” স্যার কিংবা ম্যাডাম বলে পরিচিত হবেন? কেন এক দল ক্ষমতায় এলে অন্য দলের ছাত্রদের ক্যাম্পাস থেকে বিতারিত হতে হবে? কেন ছাত্ররা পড়াশুনা না করে
টেন্ডারবাজি করবে? কেন শিক্ষকেরা ছাত্রনেতাদের টেন্ডারবাজি করার মত কাজে প্রশ্রয় ও পরোক্ষভাবে উদ্বুদ্ধ করবেন? কেন অস্ত্রবাজি করছে জেনেও সেই ছাত্রকে পড়াশুনায় না ফিরিয়ে অস্ত্রবাজি করার সুযোগ দেবেন? কেন শিক্ষক হবার জন্য মেধার চেয়েও বড় হবে একজন মেধাবীর রাজনৈতিক পরিচয় ও দলীয় সুপারিশ?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাজ কি শুধুই পাঠ্যবই থেকে শিক্ষা দান? নাকি সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাও দায়িত্বের মাঝে পড়ে? কেন তাদের নৈতিক অধপতন ঠেকানোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কোনো রকম ভূমিকা পালন করবে না? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিভিন্ন রংয়ের মোড়কে রাজনীতি করতে হবে কেন?
স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হবার কারণে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় তো সিন্ডিকেট মেম্বারদের মিলেই আদায় করে করে নেয়া যায়। প্রমোশনের জন্য তো কারও কাছে ধর্না দিতে হয় না। স্বাধীন এই বাংলাদেশে এমন কোনো কঠিন দাবি-দাওয়া নেই যে শিক্ষকদের রাজনৈতিক দল করে সরকারকে চাপ দিয়ে তা আদায় করে নিতে হবে। তাহলে কেন শিক্ষকেরা শিক্ষাদান ও গবেষনার বাহিরে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই মূলত এগিয়ে আসতে পারে ছাত্রদের অপরাজনীতি বন্ধ করতে। আমরাই পারি সুষ্ঠু ও নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করতে। আমরাই পারি দল-মত নির্বিশেষে সকল ছাত্রদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে।
আর এ জন্য দরকার নিজেদের সংশোধন। আর সে সংশোধনের মূল ও একমাত্র পথ হলো নিজেদের মধ্যেই রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া। বিভিন্ন রংয়ের রঙিন ছাতার নিচে বিভক্ত না হয়ে বর্ণহীন একটি মাত্র ছাতার নিচে থাকা। যার মূল মন্ত্রই হবে, ভবিষ্যত প্রজন্মকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।