ড. জাফরের পদত্যাগ আমাদের যে বার্তা দিল

ড. জাফরের পদত্যাগ আমাদের যে বার্তা দিল

সম্প্রতি হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, ককটেল, সর্বোপরি নিরীহ জনগনের মৃত্যুসহ যাবতীয় রাজনৈতিক ডামাডোল দিয়েও যখন সরকার-বিরোধীদলসহ কাউকেই ক্ষমতার লড়াই থেকে একচুল নড়ানো যাচ্ছিল না, তখন যে ঘটনাটি দেশের আপামর জনগণকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তা হল জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল ও তাঁর সহধর্মী ড. ইয়াসমীন হকের পদত্যাগ।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও অন্যায়কারীর অন্যায় আব্দারের কাছে মাথা নত না করে সসম্মানে সরে যাবার উদ্দেশ্যে তাঁরা দুজন পদত্যাগ করেছিলেন। উর্ধ্বতনদের চট-জলদি কার্যকরী পদক্ষেপ ও সেই সাথে শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে ইতোমধ্যে তাঁরা স্ব-পদে ফিরেও এসেছেন। সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হলে হয়তো প্রিয় শাবিপ্রবিও অচল হয়ে যেত। বলতে দ্বিধা নেই, সমস্যাসংকুল এই দেশে নতুন কোনো সমস্যার সৃষ্টি না করে তাঁরা যে দ্রুতই ফিরে এসেছেন তা দেখে স্বস্তি অনুভব করছি।

ড. জাফর “সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি” বাতিল করার অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন আগে তাঁর একটি কলামে এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অবগত হয়েছিলাম। মূলত তাঁদের চিন্তাপ্রসূত ভর্তি পরীক্ষার এই নতুন পদ্ধতি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল বলেই আমরা মনে করি।

এইচ,এস,সি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করার পরও শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের প্রধান চিন্তা হয়ে ওঠে, ভালো কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারা। অনেক শিক্ষার্থীর অনেক ভালো ফলাফল বিফলে চলে যায় শুধুমাত্র ভালো কোথাও ভর্তি হতে না পেরে।

ভর্তি পরীক্ষার সময়ে একসাথে আগে-পিছে প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির তারিখ ঘোষণা করায়, অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্বেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারে না। সময় সাপেক্ষতা সেই সাথে যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার বিশাল খরচসহ নিরাপত্তা এইসবের ঝক্কি-ঝামেলা তো আছেই।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে আমি আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত এলাকার মেধাবী ছাত্রীদের কথা বিশেষভাবে বলতে চাই। আমাদের দেশে ইদানিং মেয়েদের পরীক্ষা পাশের হার ও ভালো ফলাফলের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। গ্রামে-গঞ্জে অনেক মেয়েই অত্যন্ত ভালো ফলাফল করেও বাড়ির নিকটবর্তী কোনো কলেজে ডিগ্রিতে কিংবা কোনো একটি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। কারণ অস্বচ্ছল পিতামাতার পক্ষে তাদের মেধাবী মেয়েটিকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দেবার মত সামর্থ ও সাধ্য কোনটাই থাকে না।

নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি যে, রংপুরের মেয়ে হয়ে আমি রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারিনি। যেহেতু ঐসব জায়গায় কোনো আত্মীয় পরিজন ছিল না, তার উপর আমাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাবার মত পরিবারের কারো তেমন সময় ছিল না জন্য, আমি ইচ্ছে থাকাসত্বেও সেই সব স্থানে পরীক্ষা দিতে পারিনি। ঢাকায় যেহেতু আত্মীয় আছেন, তাই শুধু ঢাকা ও এর আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেবার সুযোগ হয়েছিল।

আমার এখনো মনে আছে ভর্তি ফর্ম, কাগজপত্র ফটোকপি, পোস্টাল খরচ, পরীক্ষাবাবদ যাতায়াত খরচসহ বিশাল খরচের জন্য আমার মধ্যবিত্ত পিতা-মাতাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে দেখেছিলাম। নিজের ইচ্ছেশক্তি ও পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছিলাম জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্র্রেনিতে প্রথম হয়ে শিক্ষক হতে পেরেছি। আজ অস্ট্রেলিয়াতে সাফল্যের সাথে পিএইচডি শেষ করতে পেরেছি।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা থাকা সত্বেও আমার অনেক বান্ধবী যাতায়াত ও ভর্তি পরীক্ষার বিশাল খরচের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগের অভাবে অনেকেই হতাশায় ভালোভাবে পড়াশুনা শেষ করতে পারেনি। আমরা বান্ধবীরা সেদিন আফসোস করে আলোচনা করছিলাম, “ইশ যদি ভার্সিটির পরীক্ষা এখানেই রংপুরে হত, কতই না ভালো হত।”

আমাদের সেদিনের আফসোস থেকে উত্তরণের পথ যেদিন ড. জাফরের কলামে বাস্তবায়িত হবার কথা জানলাম, শিহরিত হয়েছিলাম। অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, সুবিধাবঞ্চিত অনেক মেধাবী পরিবারের ছেলেমেয়েরা ভর্তি পরীক্ষা দেবার সুযোগ পাবে। একবার কোথাও ভর্তি হবার সুযোগ পেলে বাবা-মা ধারদেনা, এমনকি জমি বেঁচে হলেও ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার সুযোগ করে দেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় নিজেদের মেধার যাচাইয়ের সুযোগটা তো আমাদের দিতে হবে!

বিসিএস পরীক্ষা এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নির্বাচনের পরীক্ষা যদি সারাদেশে বিভিন্ন কেন্দ্রগুলোতে হতে পারে, তাহলে ভতি পরীক্ষাই বা নয় কেন?

এই যুগান্তকারী শিক্ষার্থী-বান্ধব সিদ্ধান্তেরও যে বিরোধিতা হতে পারে, তা কল্পনাও করিনি। নোংরা রাজনীতিকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের নোংরা স্বার্থ-সিদ্ধির পক্ষে গান গাওয়ার সাহস পাবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তাদের সেই নোংরা আবদারে সাড়া দেবেন এটা যেন অকল্পনীয়!

আমরা তো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। কোনো রাজনৈতিক নেতাগোছের কারো কাছে আমাদের প্রমোশনের জন্য যেতে হয় না। আমাদের তো কারো লেজুড়বৃত্তি করার প্রয়োজন হয় না। তাহলে স্থানীয় কিছু অশিক্ষিত নেতাদের অন্যায় দাবি মেনে নেয়ার পক্ষে শাবিপ্রবি প্রশাসন কি যুক্তি দেখাবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ-বহির্ভূত কোনো দাবি একটি মেনে নেবেন, তো এরপর আরো একের পর এক অন্যায় দাবি মেনে নিতে হবে। এই নজির সৃষ্টি না করার বিপক্ষে ড. জাফর ও ড. ইয়াসমিন যে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন তা আসলেই নজিরবিহীন।

একজন শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার আগে। তারা দুজন সে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরের এসব রাজনীতিকদের যেন তাদের নোংরা নাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে না গলাতে আসে সে সতর্কবার্তাই তারা পৌছে দিলেন।

অন্যায়ের কাছে মাথা নত আর নয়। যেখানেই অন্যায় সেখানেই প্রতিরোধ। প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে সমগ্র দেশবাসীকে সেই অন্যায়ের কথা চিত্কার করে জানিয়ে দিয়ে পদত্যাগ। দেশবাসিও জানুক কোথায় অন্যায় হচ্ছে, কারা কারা অন্যায় করছে, কারা সেই অন্যায়ের সমর্থন যোগাচ্ছে।

ড. জাফরের দৃঢ়তা আসলেই অত্যন্ত শিক্ষনীয়। মাথা না নুইয়েও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়, ভালো কাজের সমর্থনে সবাই হাতে হাত ধরে পাশে এসে দাঁড়ায়, প্রশাসন নামক মেরুদন্ডহীন আজব প্রতিষ্ঠানকেও যে এভাবে শক্ত হাতে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায় সেই বার্তাই দিয়ে গেলেন প্রিয় জাফর ইকবাল।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment