আহা! যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল!

আহা! যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল!

ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতার মেয়াদ যতই ঘনিয়ে আসছে, বেশ কিছু রাজনীতিকদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা কর্মকান্ড কারণে-অকারণে সংবাদের শিরোনামে পরিনত হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকের কর্মকান্ডে হাস্যরস ও কৌতুহলের সৃষ্টি হলেও ইদানিং দুজন ব্যক্তির কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করছি কিছুটা ইচ্ছায়, অনেকটাই অনিচ্ছায়। মিডিয়াতে তাদের উপস্থিতি এত বেশি যে, ইচ্ছে না হলেও তাদের কর্মকান্ডে বাধ্য হয়েই চোখ রাখতে হয়।

আমি সময়ের দুই আলোচিত রাজনীতিক জনাব মওদুদ আহমেদ ও জনাব আন্দালিব পার্থের কথাই বলতে চাইছি। দুজনের মধ্যে রয়েছে অদ্ভূত রকমের সাদৃশ্য। কি ব্যক্তি জীবনে, কি তাদের কর্মজীবনে। ইদানিং দুজনের আচরণে-কথাবার্তায় আশ্চর্য সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে-যেন একজন আরেকজনের কার্বন কপি!!

মওদুদ ও পার্থ দুজনেই রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। দুজনেই বাংলাদেশে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। ক্যাটাগরির দিক থেকে দুজনেই বেশ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। দুজনেই ক্ষমতাসীন দলের বাহিরে রয়েছেন। অর্থ্যাত বিরোধীদলে আছেন।

দুজনেই নামের পূর্বে “ব্যারিস্টার” ডেজিগনেশন ব্যবহার করেন। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে জনাব মওদুদ ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে থেকে সম্মান পাশ করে লন্ডনের লিঙ্কনস ইন থেকে বার-এ্যাট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডনে পড়াশুনা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে জানা যায়। অর্থ্যাত তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

অন্যদিকে পার্থ, মওদুদের মত একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ্যাত লন্ডনের লিঙ্কনস ইন থেকে ১৯৯৭ সালে বার-অ্যাট-ল’ সম্পন্ন করেন বলে জানা যায়। যদিও তিনি আদৌ বার-অ্যাট-ল’ পাশ করেছিলেন কি না এ নিয়ে জোর বিতর্ক বাজারে চালু আছে। তবে মওদুদ আহমেদের মত পার্থও লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং দেশে ফিরে চার বছর কাজ করেন প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে। বর্তমানে তিনিও একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে এই দুজন ব্যক্তিকে সব থেকে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি বলা চলে। সব দলের সাথে তাদের দুজনের সখ্যতা সত্যি যে কারও জন্যই ঈর্ষনীয়। মওদুদ আহমেদ বাংলাদেশের সব বড় দলে থেকেই ক্ষমতার মধু চেখে দেখেছেন। বিনপির নাজমুল হুদাসহ রাজনীতিক মহলের অনেক নেতাই তাকে প্রকাশ্যেই “ডিগবাজি মওদুদ” বলে সম্বোধন করেছেন। কারণ মওদুদ আহমেদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও ঘনঘন দলবদল একমাত্র তার একসময়ের রাজনৈতিক সহচর জনাব এরশাদের “ঘন ঘন মত বদল” চরিত্রের সাথেই তুলনীয়।

১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মওদুদ আহমেদ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে ছিলেন বলে জানা যায়। অর্থ্যাত তিনি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য পেয়েছিলেন।

এরপর তিনি ১৯৭৭-৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি সেই স্বৈরাচার সরকারের একান্ত ঘনিষ্ট সহচর হয়ে তার মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, পরে তার প্রধানমন্ত্রী ও সবশেষে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এরশাদ আমলের পূর্বের দুর্নীতির জন্য ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়েও কি এক দুর্লভ প্রতিভার গুনে তিনি ক্ষমতার উচ্চপদে সর্বদাই আসীন ছিলেন।

এরপর তার ঘনিষ্ঠ সহচর এরশাদের পতন হলে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালে মওদুদ আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি এরশাদের জাতীয় পার্টি ছেড়ে ১৯৯৬ সালে আবার বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে ২০০১-২০০৬ সালে তিনি আইনমন্ত্রী ছিলেন।

সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের ফাঁস করা বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তারবার্তায় তত্কালীন আইনমন্ত্রী মওদূদ আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘আউটার সার্কেলের’ মানুষ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়। মওদুদ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে এতে লেখা হয়, “সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এই সুবিধাবাদী রাজনীতিকের উপর নির্ভর করা যায়!”

বর্তমানে তিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ সরগরম করে রাখছেন। অথচ এই মওদুদ আহমেদের লেখা একটি বইয়ের রেফারেন্সকে উধৃত করে সম্প্রতি কর্নেল তাহেরের হত্যার বিচার কার্যে জিয়াউর রহমানকে দায়ী করা হয়।

মওদুদ আহমেদ একদা বলেছিলেন ”বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা নন, আমার পিতা।” অতপর বলেছিলেন, ”আমাদের রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের ন্যায় সফল রাষ্ট-নায়ক পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।” এখন বলেন, ”আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ত্রানকর্ত্রী।”

এতকিছুর পরেও মওদুদ আহমেদ বেশ বহাল তবিয়তেই আছেন বিএনপিতে!! আসলেই এমন রাজনৈতিক ভাগ্য কয়জনের হয়?

তবে জনাব মওদুদের মত রাজনৈতিক ভাগ্য রয়েছে আরেকজনের, তিনি হলেন জনাব পার্থ। যিনি কি না বয়সে মাঝবয়সী হলেও তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক প্রতিনিধি বলে সুপরিচিত। টকশো ও সংসদে তিনি প্রায়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে “ডিগবাজি মওদুদের” ন্যায় ইতোমধ্যে কিছু কিছু মিডিয়ার দেয়া “মি. পপুলার” খেতাবও জুটিয়ে নিয়েছেন। নিন্দুকেরা অবশ্য তার সেইসব জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে প্রায়ই বলে থাকেন “আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?”

মওদুদ আহমেদের মত পার্থও সব বড় দলের সুবিধাভোগী। পার্থের পিতা জনাব নাজিউর রহমান মঞ্জুর স্বৈরাচারী এরশাদের দুর্নীতির খাজাঞ্চি বলে পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে বিজেপি নামের ব্যক্তি মালিকানাধীন রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান পদে আজীবনের জন্যই অধিষ্ঠিত হয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশ, তেজগাঁও শিল্প এলাকার বিশাল জমিতে প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক প্রিন্টিং প্রেসসহ অনেক সম্পদের মালিক তিনি। নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ব্যানারে ভোলা-১ আসন থেকে প্রথমবারের মতো জয়ী হন আন্দালিব।

আওয়ামীলীগের সাথে পার্থের রয়েছে আত্মিক সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলালের মেয়ে শেখ সায়রা রহমান আন্দালিব রহমানের স্ত্রী। তিনি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভাগ্নে।

ইদানিং হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় নানা ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য ও বক্তৃতা দিয়ে পার্থ জামায়াতি ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের সমর্থনকারীদের নিকট ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে পরিলক্ষিত হয়।

মওদুদের মত পার্থ কারাগারের থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। যদিও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য কারাগার মানে অনেকটা “৩ তারা” হোটেলের মতই আরামের জায়গা বলে অনেকেই উল্লেখ করে থাকেন। তবে শক্ত লবিং এর কারণে “মওদুদীয় স্টাইলে” খুব সহজেই তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন।

আন্দালিব কড়া ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে বাহবা কুড়িয়েছেন তার পেছনেও রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সাথে পারিবারিক সুসম্পর্কের যোগসূত্র। পার্থ যখন তার নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে দাবি করে বলেন যে, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেবার পর তার মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যকে ডাণ্ডাবেড়ি পরাতে হবে!” তখন কিন্তু তিনি তার খালা শেখ হাসিনাকে ডাণ্ডাবেড়ি পড়ানোর কথা বলেন না। তাইত তত্কালীন স্পিকার আবদুল হামিদ একদা সংসদে সহাস্যে আন্দালিবকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “দুষ্টু লোকেরা বলে, আপনি দুই নেত্রীরই স্নেহভাজন।”

আমরা দুষ্টু জনগনেরা যখন সুরম্য প্রাসাদে থাকা, দামী গাড়িতে চড়ে, দামী স্যুটে সুসজ্জিত সব দলের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী সুদর্শন এই দুই ব্যরিস্টার-শিক্ষক-রাজনীতিবিদের “দেশ-দুর্নীতি-উন্নয়ন-আদর্শ” নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে দেখি, তখন বলি, আহা!যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment