Dasht-i-Leili: Translated Afghan Story
আফগান গল্প
দাশত্-ই লাইলি
মূল: মোহাম্মদ হুসেইন মোহাম্মদী
অনুবাদ: ফজল হাসান
লেখক পরিচিতি: গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং সমালোচক মোহাম্মদ হুসেইন মোহাম্মদী ১৯৭৬ সালে আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরীফে জন্মগ্রহণ করেন । সাত বছর বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে ইরানের অভিবাসী হন । সেখানে মাষ্টার ডিগ্রী অর্জণের পর প্রডাকশন ডিরেক্টর হিসেবে ইরানের ব্রডকাষ্টিং ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করেন । ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি ছোটগল্প এবং সাহিত্য সমালোচনা লিখতে শুরু করেন । তার গল্পের মূল বিষয় আফগানিস্তানের যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা, হত্যা, অত্যাচার, সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা এবং মৌলবাদী তালেবানদের আত্মঘাতী বোমা হামলার নিষ্ঠুর কাহিনী । এ পর্যন্ত তার চারটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । ‘দ্য রেড ফিগস্ অব মাজার’ গল্প সংকলনের জন্য তিনি ২০০৪ সালে ইরানের সম্মানিত ‘গলশিরি অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘ইস্পাহান লিটারেরী অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন । এছাড়া ২০০৯ সালে তিনি ‘ওব্লিভিঅ্যান’ গল্প সংকলনের জন্য ‘অ্যাওয়ার্ড অব ক্রিটিকস্ অব দ্য ইরানীয়ান প্রেস’ অর্জণ করেন । তার গল্প ফরাসী এবং ইটালিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে । সম্প্রতি তার প্রথম উপন্যাস ‘স্যাড’ প্রকাশিত হয়েছে । বর্তমানে তিনি জন্মভূমি আফগানিস্তানে ফিরে এসে কাবুলে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ।
গল্পসূত্রঃ ‘দাশত্-ই লাইলি’ গল্পটি মোহাম্মদ হুসেইন মোহাম্মদীর ‘দাশত্-ই লাইলি’ গল্পের অনুবাদ । ‘দারি’ ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন ড. অ্যান্ডার্স উইডমার্ক । ইংরেজীতে গল্পটি ২০১১ সালের মে সংখ্যা ‘ওয়ার্ডস্ উইদআউট বর্ডার্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ।
গল্পের পটভূমিঃ দাশত্-ই লাইলির মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ শুধু আফগানিস্তানের নয়, বিশ্ব ইতিহাসের এক অমানবিক, নৃশংস ও জঘন্য ঘটনা । পাশবিক এই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০১ সালের ডিসেম্বরে, যা পশ্চিমা মিডিয়াতে তেমন করে প্রকাশ পায়নি । মাজার-ই-শরীফের কালা-ই জঙ্গি দূর্গের কাছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক পর্যায়ে তালেবান সৈনিকেরা সাদা পতাকা উড়িয়ে ন্যাটো এবং আমেরিকার দোসর ও কমান্ডার দুর্ধর্ষ আফগান জেনারেল আবদুর রশিদ দুস্তমের কাছে আত্মসমর্পণ করে । আত্মসমর্পণের প্রধান শর্ত ছিল আটককৃত তালেবানদের কোনমতেই শারীরিকভাবে কোন ক্ষতি করা যাবে না । আটককৃত আনুমানিক সাড়ে সাত হাজার তালেবানকে লোহার কন্টেইনারের বন্ধ ট্রাকে করে কুন্দুজ থেকে শেবিরগানের সন্নিকটে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল । তখন কন্টেইনারের ভেতর গাদাগাদির জন্য শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, অনাহারে এবং তৃষ্ণায় অনেক তালেবান মারা যায় । ভাগ্যক্রমে যারা বেঁচেছিল, নর্দান অ্যালায়েন্সের অঙ্গ-সংগঠন জানবিশ-ই মিলি দলের উগ্র সৈনিকেরা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে । পরে দাশত্-ই লাইলির মরুভূমিতে মৃত তালেবানদের গণকবর করে মাটি চাপা দেওয়া হয় । অনূদিত গল্পটি এই পাশবিক হত্যাকান্ডের উপর ভিত্তি করে লেখা । গল্পটিতে লেখক যুদ্ধের উভয় পক্ষের সৈনিকদের অভিজ্ঞতার কাহিনী নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, অনায়াসে যা পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দিতে সক্ষম ।
দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে গম্বুজের মতো লোহার বিশাল কার্গো কন্টেইনারের ভেতর বাঘের মতো হালুম করে লাফিয়ে পড়ল ঘুটঘুটে অন্ধকার । মাথার পাগড়ি দিয়ে ওরা আমাদের হাত ও পা বেঁধে রেখেছে । অন্ধকারে আমরা একজন আরেকজনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি । যদিও বাইরে প্রখর রোদ, কিন্তু বন্ধ কন্টেইনারের ভেতর অন্ধকারে শুধু আমাদের জ্বলজ্বলে চোখের মনি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না । বাইরের তীব্র রোদের উত্তাপে কন্টেইনারের ভেতরের গুমোট হাওয়া ভীষণ উত্তপ্ত ।
*
সারাদিন ওরা আমাদের কিছুই খেতে দেয়নি । তবে যেসব উর্দি পড়া সৈনিক মোটর সাইকেলে চড়ে চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে আমাদের পাহাড়া দিচ্ছিল, বেশ অনেকক্ষণ আগে ওরা রুটি আর পানি দিয়েছিল । উর্দি পড়া সৈনিকেরা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের । এখন আমরা জারগানাগে আছি । গত দু’দিনে রোদের প্রচন্ড তাপ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি । কুন্দুজ শহর ছেড়ে দেয়ার পর আমরা যখন আত্মসমর্পণ করি, তখন ওরা খালি পায়ে উত্তপ্ত বালুর ওপর আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছিল । রশি দিয়ে আমাদের এমন শক্ত করে বেঁধেছিল যে, আমরা একজন আরেকজনের গায়ের সঙ্গে চাপচাপি করে থেকেছি এবং একটুও নড়াচড়া করতে পারিনি । আমাদের মধ্যে যাদের কাছে কাদিফা (হাজীদের রুমাল) ছিল, সেগুলো মাথায় বাঁধার পর রোদের উত্তাপ থেকে নিষ্কৃতি পাই । তখন সূর্যের প্রচন্ড তেজ ছিল । চাপাচাপিতে আমাদের এক জনের দেহ অন্যজনের সঙ্গে লেপ্টে আছে । সবার শরীর থেকে নির্গত গরম ভাপ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । আমরা শুধু কোনমতে বসার মতো একটু জায়গা পেয়েছি । হাত-পা বাঁধা একজন আরেকজনের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি । কিছুক্ষণ বাদে কয়েকটি রাশিয়ান কামাজ ট্রাক এসে পৌঁছে । আমাদের অনেককেই কয়েকটি ট্রাকে তোলে । সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপে কন্টেইনারের ভেতর আমরা রীতিমত সিদ্ধ হচ্ছি । এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কেউ কোন কথা বলে না । তবে কেউ যদি কথা বলত, তবে আমরা কেউ কারোর কথা বুঝতাম না । ধর্মের জন্য শহীদ এবং জান্নাতবাসী হওয়ার বাসনা নিয়ে আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়েছি এবং জিহাদে অংশগ্রহণ করেছি । এর আগে আমি দূর থেকে এসব কালো নর-পিশাচগুলোর একজনকে কুন্দুজে দেখেছি । ওরা অন্য দলে ছিল, আমাদের সঙ্গে ছিল না । রাতের বেলা উল্টোদিকের গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে ঠিকরে পড়েছে আমাদের উপর । রাতের হিম শীতে আমরা হি হি করে কাঁপতে থাকি । কারোর পক্ষে নড়েচড়ে বসার একবিন্দুও জায়গা নেই । আমরা যদি একচুলও নড়ি, তাহলে ওরা গুলি করে । আমরা ভয়ে রীতিমত পাথরের মূর্তি হয়ে যাই । তখন খানিকটা কাঁপুনি থামে ।
দ্বিতীয় দিনে আমাদের পালা । সবাইকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা কন্টেইনার আনা হয় । কয়েকজন সৈনিক ‘সুজবেক-উজবেক’ জাতীয় একধরনের অজানা ভাষায় ধ্বনি তুলতে তুলতে ক্রমশ আমাদের দিকে এগিয়ে আসে । একসময় ওরা আমাদের বাঁধন খুলে দেয় । ফার্সি ভাষায় আমি বললাম যে আমি ওদের দলে ছিলাম না । ওরা উজবেক ভাষায় গালিগালাজ করে আমাকে লাথি মেরেছে এবং রাইফেল দিয়ে বেদম মারধর করেছে । সৈনিকেরা আমাদের কাদিফা, কুর্তা, জুতা এবং পাগড়ি খুলে নেয় । তখন আমাদের পড়নে ছিল শুধু সার্ট এবং প্যান্ট । সবকিছু খুলে নেয়ার সময় কয়েকজন প্রতিবাদ করে কিছু বলেছে । কিন্তু আমি ওর কথার কিছুই বুঝিনি, এমনকি একটা শব্দের অর্থও জানি না । সৈনিকেরা আমাদের মাথার পাগড়ি দিয়ে হাত-পা বাঁধতে শুরু করে । আমাদের দলের সবাইকে প্রথম বাঁধে । তারপর একে একে সব দলের লোকজনকে বাঁধে । সবাইকে বেঁধে ওরা কামাজ ট্রাকে তোলে এবং অন্য কোথাও নিয়ে যায় । সেখানে নেয়ার পর আমি হলাম তৃতীয় ব্যক্তি, যার বাঁধন ওরা খুলে দিয়েছে । বাঁধন খোলার পরে একজন হ্যাঁচকা টানে পাগড়িটা ছিঁড়ে দু’ টুকরো করে । অতঃপর এক টুকরো পাগড়ি দিয়ে আমার হাত বাঁধে এবং অন্য টুকরো দিয়ে পা বেঁধে উত্তপ্ত বালুর উপর ছুড়ে ফেলে । আমি আরেকবার কাকুতি-মিনতি করে বললাম যে আমি ওদের দলে নেই । আমি একজন আফগান । ইচ্ছে করে আমি ফার্সিতে বললাম যেন ওরা বুঝতে পারে । কিন্তু ওরা বোঝেনি । এবার আমি পশতুতে বললাম । ওরা আমার কথা কানে না তুলে অন্যদের হাত-পা বাঁধতে থাকে । উত্তপ্ত বালুর উপর আমি যেভাবে পড়েছিলাম, সেই একই অবস্থায় আছি । আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমার মতো অন্যদেরও হাত-পা বেঁধে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে গরম বালুর উপর । তবে বিপুল দেহের কালো চামড়ার একজন হাত-পা বাঁধার সময় প্রতিহত করতে চাইছিল । আমার ধারণা, সে পবিত্র কোরান পাঠ করছিল । সৈনিকেরা লোকটার ওপর চড়াও হয়ে এলোপাথারি লাথি দিচ্ছিল এবং রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করছিল । জোর জবরদস্তি ওরা লোকটার হাত পেছনে নিয়ে ওর নিজের পাগড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে । তখনও লোকটা হাত-পা ছুড়ে বাঁধা দিচ্ছিল । তারপর সৈনিকেরা ট্রাক থেকে ধাক্কা দিয়ে আমার ঠিক পাশেই বালুর ওপর ফেলে দেয় । আঘাতের ফলে রক্তে ওর হাত এবং মুখ ভিজে গেছে । সে আগের মতোই চিৎকারের সুরে একটা কিছু বলছে । বোধহয় সে কোরান পাঠ করছে । সৈনিকেরা পরস্পরের সঙ্গে অচেনা সুজবেক-উজবেক ভাষায় কথা বলছে এবং বাদবাকি লোকগুলোর হাত পেছনের দিকে নিয়ে বাঁধছে । কন্টেইনারের লাল রঙের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা একে অপরের দিকে তাকাই এবং পরমুহূর্তে আমাদের ভয়ার্ত দৃষ্টি সৈনিকদের মুখের উপর আটকে যায় । পাঁজাকোলা করে ওরা আমাদের এক একজনকে কন্টেইনারের ভেতর সজোরে ছুড়ে ফেলে । আমাকে কন্টেইনারের মেঝেতে ছুড়ে ফেলার পর আমি নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে এক কোণায় চলে যাই এবং লোহার দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসি । রোদের তাপে দেয়াল গরম । তবে এমন গরম নয় যে আমার পিঠ পুড়ে যাচ্ছে । প্রত্যেকেই বাঁধা হাত-পা নিয়ে নড়েচড়ে বসার জায়গা করে নিচ্ছে । কিন্তু আমরা এত মানুষ যে একে অপরের উপর স্তুপ হয়ে আছি । আমার ছড়ানো পা দু’জন লোকের দেহের নিচে চাপা পড়েছে । আমি কিছুতেই পা ছাড়িয়ে আনতে পারছি না । যে লোকটাকে ওরা মেরেছে, সে আমার শরীরের উপর । আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি পা দু’টি ছাড়াতে, কিন্তু পারছি না । আমি ওদের ধাক্কা দিই । লোক দু’জন আমার দিকে কটমট চোখে তাকায়, কিন্তু মুখে কিছু বলে না । একটু বাদে ওরা এমনভাবে নড়েচড়ে উঠল যেন দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে । এই ফাঁকে আমি ওদের শরীরের নিচ থেকে কোনরকমে পা দু’টি টেনে বের করি । তারপর পা ভেঙে হাঁটু বুকের কাছে এনে দু’হাতে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরি ।
*
দরজা বন্ধ করার পর কন্টেইনারের ভেতর ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার । সেই অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখতে পারছি না । শুধু একে অপরের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি । কোন মতে আমি বাঁধা হাত পাগড়ির গিঁটের উপর রাখি, যেটা পায়ের গোড়ালিতে বেড়ির মতো বাঁধা ছিল, এবং সেটা খোলার চেষ্টা করি । এক মুহূর্তের জন্য মনে হল গিঁটটা খুলে যাচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা শরীরে একধরনের বিদ্যুত তরঙ্গ খেলে যায় । যে লোকটা এতক্ষণ ইতস্ততঃ পায়চারি করছিল, তার দিকে আমি পলকহীন তাকিয়ে থাকি । সে এখন আমার পাশেই । তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, এমনকি আমার পায়ের সঙ্গে লেগে থাকা তার বুকের স্পর্শও অনুভব করছি । নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে লোকটর বুক উপরে-নিচে ওঠানামা করছে । সে হয়তো কোন কিছুর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে । লোকটি যেদিকে তাকিয়ে আছে, আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি দেয়ালে একটা অতি সূক্ষ ফাটল গলিয়ে বাইরের এক চিলতে অস্পষ্ট আলো এসে ঠিকরে পড়েছে কন্টেইনারের ভেতর । সেই অস্পষ্ট আলোয় আমি চারপাশে, এমনকি উপরে-নিচে তাকাই । হঠাৎ দেখি আমার মাথার উপরে এক ইঞ্চিরও ছোট একটা ছিদ্র, যা হয়তো বুলেটের জন্য হয়েছে । আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না । দেয়ালের সঙ্গে আমার পিঠ লেগে আছে । উত্তপ্ত দেয়ালের উত্তাপে আমি রীতিমত ঘামছি এবং বন্ধ কন্টেইনারের গুমোট হাওয়ায় আমার নিঃশ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে । সবাই নিশ্চুপ । কারোর মুখে কোন টুঁ শব্দটি নেই । ঘামের দুর্গন্ধে কন্টেইনারের ভেতর ফাঁকা জায়গা ভরে আছে । অনেকদিন ধরে কেউ গোসল করতে পারেনি । ক্রমশ ভেতরের হাওয়া ভারী হয়ে আসে এবং আমি অনেক কষ্টে নিঃশ্বাস নিতে পারছি । কিছুক্ষণ বাদে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আরো গাঢ় হয় এবং আমি অনুভব করতে পারি, নিঃশ্বাসের অদৃশ্য ধোঁয়া গিয়ে আছড়ে পড়ছে কন্টেইনারের দেয়ালে । যে কোন উপায়ে সবাই দেয়ালের গায়ে আঘাত করার চেষ্টা করছে, এমনকি মাথা দিয়ে সজোরে আঘাত করছে । প্রত্যেকেই উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করছে এবং ঘনঘন আঘাতের আওয়াজ আরো বেশি জোরে হয়ে চারপাশে প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে । বন্ধ কন্টেইনারের ভেতর নিঃশ্বাস টানতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে । আমি আর্তচিৎকার করি । আমি জোরে জোরে দেয়ালে মাথা ঠোকাই, ব্যাং … ব্যাং । সবাই চিৎকার করছে । ওরাও হাত-পা এবং মাথা দিয়ে দেয়ালে এলোপাথারি ধাক্কা দিচ্ছে ।
*
ওরা গনগনে সূর্যের নিচে কন্টেইনারের ভেতর আর আমরা বাইরে দেয়ালের আড়ালে সরু ছায়ায় । আমাদের নজর কন্টেইনারের দিকে । ভেতরে ওরা চিল্লাচিল্লি করছে এবং দেয়ালে হয়তো মাথা দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করছে । আমরা যখন মাজার-ই শরীফ দখল করি, তখন ভয়ে এলাকার সবাই পালিয়ে গেয়েছিল । শহরের রাস্তা-ঘাটে কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না । অন্যান্য শহর দখলের পর আমাদের ভয়ে যেমন মানুষেরা ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকত, ঠিক তেমনই এ শহরের লোকজন ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে আছে । যদিও সময়টা ছিল গ্রীষ্মের শুরু, তবুও তখন অসহ্য গরম ছিল । আমি মাজার-ই শরীফের গরম উপলব্ধি করেছি । ওখানের গরম হলমান্দ এবং নিমরুজের চেয়েও ভয়াবহ । যারাই রাস্তায় বের হয়েছিল কিংবা যাদের জোর করে ঘর থেকে রাস্তায় আনা হয়েছিল, সবাইকে লোহার কন্টেইনারের ভেতর ঢুকিয়েছিলাম । প্রচন্ড গরমে তারা সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল এবং চিৎকার করে অনুরোধ করেছিল যেন কন্টেইনারের দরজা খুলে দেওয়া হয় । সে সময় আমরা দেয়ালের আড়ালে ছায়ায় বসেছিলাম । তবুও প্রচন্ড গরমে আমাদের শরীর থেকে রীতিমত ঘাম ঝরেছিল । রাস্তায় যাকেই পেয়েছি, সবাইকে জোর করে কন্টেইনারের ভেতর ঢুকিয়েছি । মাজার-ই শরীফের গনগনে সূর্য তখন আমাদের মাথার ওপরে । সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছিল, সূর্যও ততই নিস্তেজ হয়ে পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ছিল এবং ক্রমশ দেয়ালের ছায়াও মিইয়ে গিয়েছিল । এক পলকা বাতাস উড়ে এসে আমাদের ঘর্মাক্ত শরীরে একধরনের শীতল পরশ মেখে দিয়েছিল । একই জায়গায় বসে আমরা কন্টেইনারের ভেতরের লোকদের চেঁচামেচি শুনছিলাম । আমার সহযোদ্ধারা কেউ ভালো ফার্সি জানে না । তাই তারা নির্বোধের মতো ওদের কথাবার্তা শুনছিল । প্রত্যেকেই নিজের কাজে ব্যস্ত । একসময় আমার পাশের লোকটি তেলাওয়াত করার জন্য পবিত্র কোরান শরীফ খোলে । তেলাওয়াতের মধ্যে সে মাঝেমাঝে কোরান শরীফের পৃষ্ঠা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে আশেপাশে ইতিউতি তাকায়, এমনকি হাতের আঙুল দিয়ে দীর্ঘ দাড়িতে আলতো করে পরশ বুলায় । পুনরায় তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করার আগে সে বেশ কিছুক্ষণ কন্টেইনারের দেয়ালের দিকে দিকে তাকিয়ে থাকে । সেখানে আমিই একমাত্র উপস্থিত ব্যক্তি যে ওদের কথা বোঝে । ওরা বলছে, ‘তোরা নিষ্ঠুর, পাষাণ । দরজা খুলে দে । ভেতরে আমরা গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি, শরীর পুড়ে যাচ্ছে ।’ আমার পাশে যে লোকটি কোরান তেলাওয়াত করছিল, সে একবার মাথা তুলে তাকায় । আগের মতোই দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘ওরা এখনো বেঁচে আছে ।’ বলেই সে পুনরায় কোরান শরীফ তেলাওয়াতে মগ্ন হয় । তখনও অন্য লোকগুলো চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল ।
*
আমরা জোরে চিৎকার করছি । যদিও কন্টেইনারের ভেতর এখনও আমরা পুরোপুরি সিদ্ধ হইনি, তবুও চিৎকার করে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য আকুলভাবে অনুরোধ করি । আমাদের সবার কন্ঠস্বর সপ্তমে । আমি কিছুতেই ওদের কথাবার্তা বুঝতে পারিনি । একমাত্র আল্লাহ্ মালুম, ওরা কোন ভাষায় কথা বলছে । আমি ওদের ভাষা জানি না । আমার মনে হল, কেউ যেন কোরান তেলাওয়াত করছে । হয়তো আমার শোনার ভুল হতে পারে । প্রত্যেকে কন্টেইনারের দেয়ালে সজোরে আঘাত করছে । আঘাতের শব্দ শুনে মনে হল ওরা হয়তো জোরে মাথা ঠুকছে । একসময় নিঃশ্বাস নিতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল । তবুও আমিও ওদের মতো দেয়ালে মাথা ঠুকতে শুরু করি । তখন অনবরত আঘাতের শব্দ আমার মস্তিস্কের ভেতর অনুরণিত হতে থাকে । জোরে জোরে মাথা ঠোকার জন্য আমার মাথা ফেটে রক্ত বেরোয় । সঙ্গে সঙ্গে আমি দেয়ালে আঘাত করা বন্ধ করি । আঙুলের ডগায় রক্ত নিয়ে আমি রক্তের উষ্ণ এবং লবনাক্তার স্বাদ নিই এবং পরমুহূর্তে তা টুপ করে গিলে ফেলি । মাথা ফেটে চুঁইয়ে পড়া রক্ত আমার ঠোঁট ভিজিয়ে দিয়েছে । আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চাটি । যেই মাত্র আমার গলা রক্তে ভিজে গেছে, তখন মনে হল আমি আরো বেশি জোরে চিৎকার করতে পারব । আমি চিৎকার করি … চিৎকার করি … চিৎকার করি … এবং ভীষণ জোরে চিৎকার করি … । একসময় আমার দম ফুরিয়ে এলে আমি শান্ত হই । তখন অন্যদের কন্ঠস্বরও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে । অন্ধকারে আমি চারপাশে তাকাই । সেই লোকটা এখনও কোরান তেলাওয়াত করছে । এটা একমাত্র ভাষা, যা আমি বুঝতে পারি । কিন্তু আমি স্মরণ করতে পারছি না, সে কোন সূরা তেলাওয়াত করছে । যে আমার পায়ের উপর পড়েছিল, তার শরীর নিস্তেজ । তবে আমি বুঝতে পারছি, অন্ধকারে তার ফাঁকা দৃষ্টি একটা নির্দিষ্ট কিছুর উপর স্থির হয়ে আছে । হঠাৎ আমার মনে পড়ে আলোর বিচ্ছুরণরেখা এবং দেয়ালের ফাটল । সে যেদিকে তাকিয়ে আছে, আমিও সেদিকে তাকাই । এখনো কন্টেইনারের ভেতর গুমোট হাওয়ায় সেই বিকীর্ণ আলোর রশ্মি কাঁপছে । তৎক্ষণাৎ আমার মনের মধ্যে এক চিলতে আশার রঙিন আলো জ্বলে ওঠে । কালক্ষেপণ না করে আমি উপরের দিকে তাকাই । তখন কিছুতেই মনে হচ্ছিল না যে উত্তপ্ত দেয়ালের তাপে আমার পিঠ পুড়ে যাচ্ছে, এমনকি সে সময় আমি তৃষ্ণার কথাও বেমালুম ভুলে যাই । কোনমতেই আমার স্মরণে আসছিল না কতক্ষণ এই অন্ধকারে বন্ধ কন্টেইনারের ভেতর আটকে আছি । নিঃশ্বাস নিতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে । পলকে ভাবলাম, হয়তো কোনরকমে মাথাটা উপরের দিকে তুলে ফাটলের কাছে মুখ নিয়ে বাইরের খোলা বাতাস টেনে নিতে পারি । যদি মাথা তুলে দাঁড়াই, তাহলে পুনরায় বসার মতো বিন্দুমাত্র শক্তি নেই আমার শরীরে । যাহোক, এমন কোন সুবিধামতো জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না, যেখানে আমি অনায়াসে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারি । ওরা সেই কখন আমাদের কন্টেইনারের ভেতর ঢুকিয়েছে … কতক্ষণ হবে ? সত্যি, আমি জানি না, এমনকি আমার মনেও নেই কখন ঢুকেছি । হয়তো এখন সকাল, হয়তো বা বিকেল । ঠিক জানি না । তবে বাইরে ভীষণ গরম । যে সব সৈনিকেরা আমাদের চারপাশে কড়া পাহাড়া দিয়েছিল, ওদের তিন চাকার মোটর সাইকেলের শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি । ওদের দু’জনের পড়নে ছিল ছদ্মবেশী পোষাক । আমরা যাদের কাছে আত্মসর্পণ করেছি, ওরা ছাড়া আর কোন সৈনিক আসেনি । আমি বাঁধা হাত দিয়ে বেড়ি পড়া পা বুকের কাছে টেনে আনি । আমার আঙুলে কোন বোধশক্তি নেই । তবুও আমি পা বাঁধা পাগড়ির গিঁট স্পর্শ করি । কিন্তু অবশ আঙুল আমি নাড়াতে পারি না । হাতটা জোরে ঝাঁকি দিই, যাতে আবার রক্ত সঞ্চালন হয় । আরেকবার আমি মাথার উপরের ফাটলের দিকে তাকাই । হয়তো পাশের লোকটা এখনও সে দিকেই তাকিয়ে আছে । এখন আমি তার ভারী নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি । আমি দাঁড়াতে চাই । নিজেকে একটু উপরের দিকে তুলি । মনে হয় আমি ফাটলের কাছে মুখ নিয়ে সহজভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারব । হয়তো বাইরের
বাতাস … । কিন্তু কিছুতেই আমি বাইরের বাতাস টানতে পারছি না । বরং একই জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি এবং অনেক কষ্ট করে দুর্গন্ধময় বাতাস টেনে নিচ্ছি । এ অবস্থায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেওয়া কোনমতেই সম্ভব নয় । কেননা সবার ঘর্মাক্ত শরীরের দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে গেছে । শব্দ করে সবাই ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে এবং নিঃশ্বাসের শব্দ কন্টেইনারের ভেতর অক্সিজেনবিহীন ফাঁকা জায়গায় ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে । প্রত্যেকের হাত বাঁধা এবং আমাদের সবার পায়ে বেড়ি । কেউ একচুলও নড়াচড়া করতে পারছি না । কারোর এমন কোন উৎসাহ কিংবা শক্তি নেই যে সে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে একটু সরিয়ে নেয় । আমার হাত যদি বাঁধা না থাকত, তাহলে আমি একটু নড়েচড়ে বসতাম । আমি যখন আঙুল দিয়ে হাতের গিঁট স্পর্শ করি, তখন আমার মনে হল আমি গিঁট খুলতে পারব । একটু একটু করে গিঁট আলগা করতে থাকি । অই বেজন্মাগুলো এমন শক্ত করে বেঁধেছে যে কিছুতেই গিঁট খোলা যাচ্ছে না । আমার পা দু’টিও শক্ত করে বাঁধা এবং আমি পায়ে কোন বোধশক্তি পাচ্ছি না । কন্টেইনারের মেঝেতে পায়ের তালু লেগে আছে । প্রচন্ড গরমে পা পুড়ে যাচ্ছে । দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে আমি আর বসে থাকতে পারছি না । দেয়াল থেকে পিঠ সরাতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না । আশেপাশে নড়াচড়া করার মতো এক বিন্দুও খালি জায়গা নেই । মাথা ও মুখমন্ডল থেকে রীতিমত ঘাম ঝরছে এবং নিঃশ্বাসের বাতাসও ভীষণ উত্তপ্ত । বুঝতে পারছি যেখানে হাতের আস্তিন ছিঁড়ে গেছে, সেখানে আমার হাত কেউ জিহ্বা দিয়ে চাটছে । আমি তাকিয়ে দেখি পাশের লোকটা জিহ্বা দিয়ে আমার হাতের নোনা ঘাম চেটে নিচ্ছে । মুহূর্তে আমিও ভীষণ তেষ্টা অনুভব করি । হাত চাটা বন্ধ করে সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় । কিন্তু আমি তার চোখের মনিতে কৃতজ্ঞতার উজ্জ্বল আলো দেখতে পেলাম । মুখে কিছু বললাম না । পুনরায় সে জিহ্বা দিয়ে আমার হাত চাটতে থাকে । আমি মুখের ভেতর চারপাশে একবার জিহ্বা ঘুরিয়ে আনি । আমার মুখ শুস্ক এবং খড়খড়ে । আমি আরো বেশি তৃষ্ণায় কাতর হই । কেননা আমার শুকনো মুখের ভেতর জিহ্বা আটকে গেছে । আমি লোকটার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনি । তখন সেই এক চিলতে আলোর রেখা আমার দৃষ্টিগোচর হয় । আবারও আমি পায়ের গিঁট খোলার চেষ্টা করি । ক্রমশ গিঁটটা আলগা হচ্ছে এবং আমি পা দু’টি সামাণ্য এদিক-ওদিক নড়াতে পারছি । আস্তে আস্তে গিঁটটা আরো বেশি আলগা করি এবং একসময় সেটা সম্পূর্ণ খুলে যায় । চটজলদি আমি পা থেকে মোড়ানো পাগড়ি খুলে ফেলি । এখন অনায়াসে দাঁড়াতে পারি । ভাঁজ করে পাগড়িটা পাছার নিচে রাখি । তখন আমি একটু আরাম বোধ করি । তারপর ঘুরে পাগড়ির ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসি এবং এক পর্যায়ে হাঁটুর ওপর ভর করে উঠে দাঁড়াই । কন্টেইনারের দেয়ালের ফাটলে মুখ স্পর্শ করি এবং হা করে ফাটলের ওপর ঠোঁট রাখি । উত্তপ্ত দেয়ালের স্পর্শে আমার ঠোঁট পুড়ে যাচ্ছে । তৎক্ষণাৎ আমি ঠোঁট সরিয়ে নিই । তখনও নিঃশ্বাস টানতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল । যাক না ঠোঁট পুড়ে – তবুও আমি আবার দেয়ালের ফাটলে ঠোঁট রাখি এবং ফুসফুসের ভেতর খানিকটা বাইরের হাওয়া টেনে নিই । তাতে আমার শরীর জুড়িয়ে যায় । আমি দেহের ভেতর একটুখানি শীতলতার স্পর্শ অনুভব করি । একসময় কন্টেইনার চলতে শুরু করে । কন্টেইনারের দুলুনিতে হঠাৎ লোহার দেয়ালের সঙ্গে আমার মাথা ধাক্কা খায় । যখন পুনরায় ফাটলে ঠোঁট রাখতে যাই, তখন আবারও প্রচন্ড জোরে ধাক্কা লাগে । এবার আমি নাকে ও মুখে ব্যথা পাই । মনে হল দাঁতগুলো সব ভেঙে গেছে । আমার মুখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় । আমি টুপ করে মুখের ভেতরের রক্ত গিলে ফেলি এবং জিহ্বা দিয়ে দাঁত স্পর্শ করি । তারপর থু করে ভাঙা দাঁতের টুকরোগুলো নিচে ফেলে দিই । এ সময় আমি আরেকবার জিহ্বায় উষ্ণ এবং লবনাক্ত রক্তের স্বাদ অনুভব করি । পুনরায় আমার কন্ঠনালী শক্তি ফিরে পায় ।
যদিও কন্টেইনারের ভেতর অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে, তবুও আমি তাকিয়ে দেখি সবাই রীতিমত হাঁফাচ্ছে । মনে হয় তারা একে অন্যের ঘাম চেটে নিচ্ছে । হঠাৎ একজন তার ভারী শরীরটাকে আমার পায়ের ওপর টেনে আনে । তখন আমার পা কন্টেইনারের মেঝের সঙ্গে চাপ লাগে । আমি হাঁটুতে ভীষণ ব্যথা অনুভব করি । মাথা ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখতে চাইলাম । বিশাল দেহের লোকটা কাত হয়ে আমার পায়ের ওপর শুয়ে পড়েছে । আমি তাকে সরে যেতে বললাম । অন্ধকারে তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল । সে আমার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করল না । বরং বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । একসময় সে কিছু একটা বলল, কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি । কেননা সে পশতু ভাষায় বলেনি । আল্লাহ্ মালুম, লোকটা কোথা থেকে এসেছে । মনে হল আমার পা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে । লোকটার বুকের সঙ্গে আমার পা লেগে আছে । সে একটু নড়ে ওঠল । আমি মুক্ত হতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না । তার বিশাল শরীরের চাপে আমার হাঁটুতে ব্যথা করছে এবং কন্টেইনারের দেয়ালের সঙ্গে আমার উরু ভীষণভাবে চেপে আছে । ঘামে ভেজা প্যান্ট থেকে দুর্গন্ধ পাচ্ছি । আমি মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাই । যে লোকটার গায়ের ওপর এতক্ষণ বসেছিলাম, সে পাশে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন সেই জায়গাটা দখল করে নেয় । লোকটা পেছনে সরে যেতে পারছে না । কন্টেইনারের দুলুনিতে আমরা একবার সামনে যাচ্ছি, আরেকবার পেছনে আসছি । সবাই জোরে জোরে হাঁফাচ্ছি । সবার শ্বাস-প্রশ্বাসের ভারী শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি । গরমে পুড়ে যাওয়া ঠোঁট ফাঁক করে আমি ফুসফুসের ভেতর ঘর্মাক্ত বাতাস টেনে নিই । কিন্তু তখনও শ্বাস নিতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল । আমি হাঁটু গেড়ে বসি এবং কন্টেইনারের উত্তপ্ত দেয়ালের সঙ্গে বুক ঠেকাই । তখন দেয়ালের সঙ্গে ঘর্মাক্ত সার্টের সংযোগের ফলে সার্ট থেকে বাস্প বের হয় । আমি বুঝতে পারি বাস্প ক্রমশ জোরে নির্গত হচ্ছে । আমার পায়ে কোন বোধশক্তি নেই । যে লোকটার ওপর বসে আছি, তার কোন নড়াচড়া টের পাচ্ছি না । আমার পা নাড়াতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না । কন্টেইনারের প্রতিটি দুলুনির তালে তালে লোকটার শরীর আমার পায়ে চাপ দিচ্ছিল । ব্যথায় আমি কাতরাতে থাকি । একসময় বাঁধা হাত নিয়ে লোকটাকে সজোরে কয়েকটা ঘুষি দিই । মাথাটা সে সামাণ্য সরিয়ে আর্তনাদ করে কিছু একটা বলল । কিন্তু আমি তার ভাষা বুঝি না । আমার হাত প্রচন্ড ব্যথা করছে । তাই আমি তাকে ঘুষি দেয়া বন্ধ করি । জোরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য পুনরায় আমি ফাটলের কাছে মুখ এনে ফুটোর সঙ্গে ঠোঁট রাখি । ঘুষি খেয়ে লোকটার সারা মুখ রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে । সে একটু সরে বসে । আরেকবার কন্টেইনারের দেয়ালের সঙ্গে আমার মুখ, নাক আর চিবুক ধাক্কা খায় । সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুত তরঙ্গের মতো একটা তীব্র ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে । আমি শ্বাস নিই এবং মুখের ভেতরের রক্ত গিলে ফেলি । আবার ফুটোর কাছে মুখ রাখি । নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাইরের ধূলোবালি ঢুকে আমার ফুসফুস ভরিয়ে দেয় । আমি কাশতে শুরু করি । পায়ের রক্ত এতক্ষণে নিশ্চয় জমাট বেঁধে গেছে । কেননা আমি পায়ে কোন ব্যথা টের পাচ্ছি না । ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে গেছে । আমি বুঝতে পারছি, যে লোকটার পেছনে হাত বাঁধা, সে জিহ্বা দিয়ে আমার পিঠের ওপর ঘর্মাক্ত সার্ট চাটছে । আরেকবার আমি ফুটোতে মুখ রেখে নিঃশ্বাস নিই । ধূলোবালিতে আমার কন্ঠনালী ভরে গেছে । সঙ্গে সঙ্গে আমি ফুটো থেকে মুখ সরিয়ে এনে কাশতে থাকি । আমার মুখের ভেতর মিহি বালুকনা । এ মুহূর্তে এটা কোন ব্যাপার নয় । প্রয়োজন হলে বালুকনা গিলে ফেলব । কিন্তু আমার ফুসফুস জ্বলে যাচ্ছে ।
*
নিঃসন্দেহে এটা সুখবর যে এখন শরৎকাল এসেছে । কিন্তু তখন মাজার-ই শরীফে ছিল গ্রীষ্মকাল এবং আমরা ছায়ায় বসে থাকতাম । আসলে গরম আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে । তবে এখন আর কন্টেইনারের ভেতর গরম অনূভব করার বোধশক্তি নেই । অনেকক্ষণ আগে আমাদের কন্টেইনারের ভেতর ঢুকিয়েছে । আমি কন্টেইনারের দেয়াল স্পর্শ করি । সঙ্গে সঙ্গে গরমে আমার হাত পুড়ে যায় । যারা দেয়ালের ছায়ায় বসেছে, আমি তাদের দিকে এক নজর তাকাই । তারা পাগড়ি দিয়ে বাতাস করছে । আগে যে লোকটি কোরান তেলাওয়াত করছিল, সে এখন দাড়িতে হাত বুলাচ্ছে । একসময় সে জানতে চাইল, সবাই এখনো বেঁচে আছে কি না ।
*
এখনো আমরা বেঁচে আছি । হয়তো শরৎকাল আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে । আমার নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে । কন্টেইনারের ভেতর গোঙানির শব্দ ক্রমশ থিতিয়ে আসছে । যে লোকটা আমার পায়ের ওপর পড়ে গিয়েছিল এবং আমি তার বুকের ওপর বসেছিলাম, তার হৃদস্পন্দনের কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না । বোধহয় সে আর নিঃশ্বাস টানতে পারছে না । পাশের যে লোকটা একসময় আমার শরীরের ঘাম চেটেছিল, আমি তার কাঁধে হাত রাখি । তারপর তার হাত ধরি । সে একবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নিয়ে পড়ে যায় । যার বুকের ওপর আমি বসেছিলাম, তাকে শক্ত করে ধরি । আমি আর পারছি না । আমার শ্বাস টানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে । যেহেতু লোকটার নিঃশ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে গেছে, তাই তার নিথর দেহটা প্রচন্ড ভারী লাগছে । আমার হাঁটু কন্টেইনারের দেয়ালের সঙ্গে চেপে আছে । ফলে আমি একটুও নড়াতে পারছি না । ক্রমশ শ্বাস নেয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে । একসময় শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমি উঠে দাঁড়াই । ফোসকা পড়া ঠোঁট আবার সেই ফুটোতে রেখে বাইরের গরম এবং ধূলোবালি ভর্তি বাতাস ফুসফসের ভেতর টেনে নিই । আবার সেই কাশি । আমি অনবরত কাশতে থাকি । কন্টেইনারের ভেতর দুর্গন্ধময় বাতাসে ঘূর্ণায়মান কাশির শব্দ শুনতে পাচ্ছি । একটু বাদে কাশি কমে এলে পুনরায় আমি শ্বাস নেয়ার জন্য ফুটোতে মুখ রাখি । যে করেই হোক, আমাকে বাঁচতে হবে । অন্যদের মতো আমি কিছুতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে পারি না । অবশ্যই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে । আমি বাঁচতে চাই । কন্টেইনারের ভেতর এক ফোঁটাও বাতাস নেই । ফুটোতে মুখ রেখে আমাকে শ্বাস নিতে হবে । কিন্তু আমার ফোসকা পড়া ঠোঁট শুকিয়ে গেছে । হায় আল্লাহ্, আমি এখন কি করব ? আমার ঠোঁট জ্বলে যাচ্ছে । মুখ শুকিয়ে কারবালা । যদি আমার মুখের ভেতর এক ফোটাও থুতু থাকত, যদি আগের মতো মুখের ভেতর রক্ত থাকত, যদি … । আমি হাত এবং মুখ দিয়ে কন্টেইনারের উত্তপ্ত দেয়াল চেপে ধরি । তাতে গরমে চুলের ভেতর মাথায় ঘামের ফোঁটা জমে । একসময় সেই ঘাম কপাল বেয়ে চুঁইয়ে পড়ে চোখের ভেতর । উত্তপ্ত নোনা ঘামে চোখ ভীষণ জ্বালা করছে । হায় আল্লাহ্ ! আমার চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে । ইচ্ছা করছে জোরে দেয়ালে আঘাত করে অনুনয়-বিনয় করে সৈনিকদের দরজাটা খুলে দেয়ার জন্য বলি । সবাই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে আছে । শীঘ্রই আমারও একই অবস্থা হবে এবং আমিও ওদের মতো চিরদিনের জন্য নিস