মানিকের যুদ্ধ – ২
মানিকের যুদ্ধ – ২
শুনেছি, পাক হানাদার বাহিনী, রাজাকার’রা লবণ সরবরাহে বাধা দিয়ে বেশ দু:স্প্রাপ্য করে তুলেছিল এবং যাও একটু আধটু লবণ পাওয়া যেত তাও নাকি আকাশ ছোঁয়া মূল্যে! যা হোক, লবণের সংকট তথা দুষ্প্রাপ্যতা বা মূল্যবৃদ্ধি কোন কিছুই মানিকদের যুদ্ধ থামাতে পারেনি! আমরা কোন ভাবেই মাথা নোয়াবার জাতি নই – অন্যায় অন্যায়ই, যুগে যুগে কোন পরাশক্তিই রুখতে পারেনি বাংলা ভূখণ্ডের মানুষদেরকে। সামান্য নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে কি, এ জাতিকে নোয়ানো যাবে? যাবে না। পাকি এবং পাকি দোসররা মহা মূল্য দিয়ে তা জেনেছে অনেক পরে। অথবা আদৌ তারা (রাজাকার/নব্য রাজাকার যারা এ দেশে রয়ে গেছে) কিছু জেনেছে কিনা, তার ভার আমার প্রিয় পাঠকের উপরই রইল।
আমারদের বাসা থেকে দু থেকে তিন শ গজের মধ্যে ডাকাতিয়া নদী। যাকে বলে একেবারে কোল ঘেঁসে। আমার যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে তার পাশাপাশি কাছাকাছি থেকে। বাসার পেছনের পুকুরের চাইতেও আমার প্রিয় ছিল ঐ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া। যখন তখন। বিশেষ করে বর্ষা কালে। ঐ সময় দিগুণ হয়ে যেত নদী প্রস্তে। মাঠ ভরা ধান গাছগুলো, ডুবি ডুবি করেও ডুবত না, প্রাণ প্রনে চেষ্টা করত পানির উপর মাথা তুলে রাখতে। কোন কোন বর্ষাকালে ধান গাছগুলো পানির বেড়ে উঠার সাথে কুলাতে পারত না, পানিকে আঁকড়ে ধরে, পানিতেই মুখ লুকাত একসময়। তখন ডাকাতিয়া’র তীরে দাঁড়ালে মনে হত মহা সমুদ্রের তীরে দাড়িয়ে আছি। যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি, কোন বসতী চোখে পড়ে না তখন আর। সে এক অপূর্ব দৃশ্য!
ঝড়ের সময় যখন ডাকাতিয়া ফুসে উঠত – ভয়ংকর ভয়ংকর ঢেউ গুলো তাড়া করত একে অন্যকে, সে সময়ই আমরা (দু’তিন জন বন্ধুরা) ঝাঁপিয়ে পড়তাম নদীতে। খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে যেত সাময়িক ভাবে। দু’একটা গবাদি পশুর আর্ত চিৎকার অথবা মাঝে মাঝে আটকে পড়া কোন খেয়া পারাপার যাত্রীর গগন বিদারী আত্ম চিৎকার ছাড়া অন্য কোন শব্দ – ঝড় বৃষ্টির শব্দে টেরই পাওয়া যেত না। আমরা ক’জন প্রতিযোগিতায় নামতাম, এই বৈরী আবহাওয়াতে, কে কার আগে এক তীর থেকে অন্য তীরে পৌছাতে পারে। কখনো আটকে পড়া পারাপারের যাত্রী, কখনো গবাদি পশু উদ্ধারের মহান কাজে নামতাম আমরা। খেয়া পারাপারের মাঝি খন্দকার নানা প্রায়ই নালিশ করতেন – ওনার খেয়া নৌকা আমরা ভীষণ ঝড়েও এপার ওপার করছি এবং ঐ মহৎ কাজ গুলোর প্রতি মূল্যে পেয়েছি, কখনও বকুনি, কখনও মারধর, কখনও কখনও পুরু ঝড়ের সময় ঘরে আটকে রাখা। আব্বা ভীষণ রাগ করতেন। চোখে চোখে রাখতেন, বিশেষ করে ঝড়ের সময়। যা হোক ফিরে যাই আবার ‘৭১ এর সময়ে।
১৯৭১ এর মার্চ থেকে মে’র মধ্যকার ঘটনাটা। ডাকাতিয়া নদীর ঠিক তীর ঘেঁষে এক বিশাল বটগাছ। এ গাছ থেকেই হাট অর্থাৎ খিলাবাজার শুরু। সেই বট গাছের নিচে আমরা ক’জন বন্ধু মিলে খেলছিলাম। পাশেই একটু দুরে, নুরুল ইসলাম মামা (পাশের বাসার খালুদের কেয়ার টেকার) বড় বড় গাছের ডাল কেটে লাড়কি বানাচ্ছিলেন আপন মনে। হঠাৎ গুলির শব্দ। দুটি। মামাকে দেখলাম সব ফেলে খুড়িয়ে খুড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়চ্ছে বাসার দিকে (উত্তরে)। অচেনা আরেকজনকে দেখলাম নিজের বাম হাতে, ডান হাতের কব্জি চেপে ধরে নদীর পাড় ধরে অন্য দিকে প্রাণপণে দৌড়চ্ছে (দক্ষিণে)। তার পর, বামে ডাকাতিয়ার সাথে যুক্ত খিলার খাল ধরে সোজা পুবের দিকে দৌড়াতে শুরু করল। পরে শুনেছি ওটা রাজাকার, মুক্তিবাহিনীর তাড়া খেয়েই অমন দৌড়চ্ছে। নুরুল ইসলাম মামার পায়ে লেগেছিল রাজাকার বা মুক্তিবাহিনীর ছোড়া গুলি। রাজাকারটাও আহত ছিল মুক্তিবাহিনীর গুলিতে, তবে ততটা গুরতর ভাবে নয়। আমরা যারা খেলছিলাম, ঠিক বুজে উঠতে পারছিলাম না কি করব। আব্বা দ্রুত চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। আমিও বাধ্য ছেলের মত সামনের দরজা দিয়ে ডুকে, কিছুক্ষণ পর পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসলাম বাসা থেকে। কি হয়েছে জানতে হবে!
বাজারে (খিলাবাজার; যে খানে মূল গঠনাটির সূত্র) মুক্তি বাহিনী এসেছে। এটা আর গোপন থাকল না কোথাও। ফরিজউদ্দিনের চায়ের দোকান, ওখানেই তারা বসেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই ফরিজউদ্দিন খুবই নাম করা হা ডু ডু প্লেয়ার ছিলেন। ভাড়ায় খেলতেন বিভিন্ন জেলায়। স্বৈর শাসক ইয়াহিয়াকে খুবই পছন্দ করতেন। যার নামে তার দ্বিতীয় ছেলের নাম রেখেছিলেন ইয়াহিয়া। স্বাধীনতার পক্ষের লোক ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ইয়াহিয়া হয়ে গেল মোহাম্মদিয়া এবং আমার যতটুকু মনে পড়ে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত উনার দোকানে সবসময়ই ঝকঝকে একটা বাংলাদেশের পতাকা উড়ত। মজিব নিহত হবার পর, উনাকে আর কাউকে সাপোর্ট করতে দেখিনি। সেই যাই হোক, আস পাশের সবাই জড় হল মুক্তিবাহিনী দেখার মিছিলে। আমি অনেক চেষ্টা করেও ভিড় ঠেলে কাছে যেতে পারলাম না। দুর থেকে আবছা দেখেই খুশি থাকতে হল। ভয়, উৎকণ্ঠা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস সবই কাজ করছিল সবার মধ্যে। ঐ মুক্তিবাহিনীর লোকজন দেখতে কেমন ছিল, দৃশ্যটা এ মূহুর্তে কিছুতেই মনে পড়ছে না। সে যাই হোক। তবে ওরা যে আমাদের এলাকার ছিল না এটা নিশ্চিত মনে আছে। ঐ দিনই এক পাঞ্জাবী সৈনিককে হাজির করা হল মুক্তিবাহিনীর কাছে, সাথে ছিল তার সদ্য বিবাহিতা বাঙ্গালী স্ত্রী। প্রথমে শোনা গেল ‘জোর করে বিয়ে করেছে সৈনিকটি’। পরে জানলাম এটা প্রেম ঘটিত, পাঞ্জাবী সৈনিকটি পাক বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা সৈনিক। পাশের গ্রামেই মেয়ের বাড়ি। ওখানেই দুজন লুকিয়ে আছে। পরে শুনেছি মুক্তিবাহিনীর লোকজন স্বসন্মানে ওদেরকে ছেড়ে দিয়েছিল এবং অনুরোধ করেছিল ওরা যেন এ উপশহরের কাছ থেকে দুরে কোথাও পালিয়ে যায়। অন্য কোন অজ পাড়া গায়ে, যে খানে সহসা হানাদার বাহিনী যাবার সম্ভাবনা নেই। আমার ভাগ্য হয়নি ঐ দুজনকে দেখার কিন্তু আজও ঐ দিনের মুক্তিবাহিনীরা আমার স্মৃতির সুউচ্চ আসনে, মহান বীরের মতই জ্বল জ্বল করছে। সেলুট তাঁদেরকে।
মুক্তিবাহিনীর লোকজন দুপুরের মধ্যেই বাজার ছেড়ে গেল, অন্য কোথাও, অন্য কোন এলাকার দিকে। প্রতিদিনকার মতই বাজার আবার স্বাভাবিক হয়ে এল কিছুক্ষনের মধ্যে। চোখে পড়ার মত খুব বড় জটলা নেই কোথাও আর। দু’একজন তখনও মুক্তিবাহিনীর কথা বলছিল কিন্তু আগের মত ততটা উত্তেজিত নয়। আমিও চোরা পথে ফিরে এলাম বাসায়।
দুপুরের একটু আগে নাপিত এলো আমার চুল কাটতে (সাধারণত নাপিত আমাদের বাসায় এসে চুল কেটে যেত)। চুল কিছুটা বড়ই হয়েছে। বড় চুল আমার খুবই ভাল লাগে। আব্বা বললেন, ন্যাড়া করে দিতে। আমি পালাতে গিয়ে বড় আপার হাতে ধরা খেলাম, বসতে হল নাপিতের সামনে। মাথার সামনের দিক ন্যাড়া করা হয়েছে, পেছনের দিক বাকি। এমন সময় আব্বা এলেন মহা বিপদের খবর নিয়ে। পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনীরা বাজারের দিকে আসছে, কারণ ওরা খবর পেয়েছে, মুক্তিবাহিনীর লোকজন এখানে আছে। বড়জোর পনর মিনিট লাগবে পৌছাতে। মুহূর্তেই হিন্দু নাপিত হাওয়া হয়ে গেল আমাদের বাসা থেকে। আমি বসে থাকলাম চুল কাটার পিড়িতে। কি করব আমি বা কি করা উচিৎ আমার বুঝতে পারলাম না। কেউ কিছুই বল্লনা আমাকে। আসলে নজর দেবার মত অবস্থাও কারও ছিল না তখন। অর্ধ নেড়া হয়েই বসে থাকলাম পিড়িতে।
(চলবে)
[নতুন কিস্তি প্রত্যেক ইংরেজী মাসের প্রথম সপ্তাহে]
[এ লেখার প্রতিটি চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। বর্তমান সময়ের সাথে এর কোন ঘটনা প্রবাহের কোন রকম বা ধরনের কোন মিল নেই। কোন কাকতালীয় মিল খুঁজে পেলে, ধরে নেবার কোনোও কারণ নেই যে, ওরা আমার লেখা থেকে উৎসাহ পেয়েছে।]