Research Paper on Dhaka Transport
ঢাকার যাতায়াত ও অন্যান্য সমস্যার একটি নিশ্চিত সমাধান (প্রথম পর্ব)
ভূমিকাঃ
ঢাকা শহরের যানবাহন সমস্যার সমাধান কি আদৌ সম্ভব ? এ প্রশ্ন এখন সবার, বিশেষতঃ ভুক্তভোগী ঢাকাবাসীর মনে । আমরা মনে করি, একটি সৎ এবং নিবেদিতপ্রান সরকার যদি সঠিক ভাবে চেষ্টা করে তাহলে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে । তবে তেমন সরকার আমরা পাবো কি না সেটাই প্রশ্ন । ঢাকার যানবাহন সমস্যা সমাধানে আগের সরকারগুলি সহ এই সরকার যে সম্পূর্নভাবে ব্যর্থ তা এখন সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত হয়েছে । বর্তমান সরকারের ভূল পরিকল্পনার কারনে আগেকার সরকারগুলির সৃষ্ট এই সমস্যা বেড়ে এখন এমন এক অসহনীয় রূপ নিয়েছে যে এই শহরে বসবাস করাকে এখন অনেকে দোজখে বাস করার সঙ্গে তূলনা করে থাকে।
যে কোন সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে সবার আগে তার কারন সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারনা লাভ করা প্রয়োজন । তবে ঢাকাবাসী এই কারনগুলি খুব ভালভাবে জানেন বলে আমরা আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কারন সংক্ষেপে এবং সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব । আমাদের আলোচনায় থাকবে প্রধানতঃ নীচের ৩টি বিষয়ঃ
(০১) দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য কেমন সরকার প্রয়োজন,
(০২) কেমন করে এই সমস্যার সৃষ্টি হলো এবং
(০৩) বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর একেবারে নিশ্চিত কোন সমাধান আছে কি না ।
(০১) দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য কেমন সরকার প্রয়োজন ঃ
যে কোন দেশের প্রধান প্রধান সমস্যার সমাধান এবং জনগনের মঙ্গল করতে পারে একটি সৎ এবং নিবেদিতপ্রান গনতান্ত্রিক সরকার । আমাদের দেশ গনতান্ত্রিক হলেও আমাদের দেশে সৎ এবং নিবেদিতপ্রান সরকার আছে এমন কথা বলা যায় না । গনতন্ত্রে জনগন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করেন । এদের উপর দায়ীত্ব থাকে, জনগনের সর্বোত্তম মঙ্গল নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে দেশ পরিচালনা করা। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এজন্য রাখা হয়েছে নির্বাহী সরকার এবং পার্লামেন্ট বা আইনপরিষদ । আইনপরিষদের কাজ হলো দেশের জন্য যুগোপযোগী আইন প্রনয়ন করা এবং পুরানো আইন সংশোধন বা বাতিল করা । বাংলাদেশের পার্লামেন্টে সদস্যগনের এই দায়ীত্ব পালন এখন গৌন বিষয় । তার পরিবর্তে সরকার তাদের উপর ন্যস্ত করেন বিভিন্ন আর্থিক প্রকল্প বাস্তুবায়নের কাজ । তাদের এই দায়ীত্বের পরিবর্তন যে একটি সরকারের সামগ্রিক কর্মকান্ডে কি বিরাট পরিবর্তন এনেছে এবং দেশের সার্বিক কল্যানে বিরূপ ভূমিকা রেখেছে তা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ।
আইন প্রনয়নকারী সাংসদ হিসেবে তাদের দায়ীত্ব থাকতে পারতো, ‘প্রত্যেক সদস্যকে দেশের অন্যান্য পেশাজীবিদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ন ভাবে পাওয়া ছুটি বাদে অন্যান্য দিনসমুহে সংসদে উপস্থিত থাকতে হবে । প্রত্যেক সাংসদকে বৎসরে (ধরা যাক) কমপক্ষে একটি নতুন আইন প্রনয়ন অথবা ৫টি পুরানো আইন সংশোধন করতে হবে ।‘- ইত্যাদি । এই নিয়ম প্রচলিত থাকলে বর্তমানে যে ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তারা একাজে আগ্রহী হতেন না । আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ব্যবসায়ীরা প্রধানতঃ নিজেদের স্বার্থে কাজ করায় অভ্যস্ত । জনগনের বা দেশের মঙ্গল তাদের প্রধান বিবেচ্য, একথা এখনও প্রমান হয় নি । আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে সংসদ সদস্যদের যেভাবে আর্থিক প্রকল্প বাস্তুবায়নের কাজে নিয়োজিত করেছেন তা ব্যবসায়ীক মনোভাব সম্পন্ন লোকদের চাওয়া পাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ন । বিগত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্বত্বেও আওয়ামীলীগ সরকার মানুষের মঙ্গল সাধনে ব্যর্থ হবার একটি প্রধান কারন, ‘ব্যবসায়ীদের চাওয়া পাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ন ভাবে সাংসদদের কাজ বিন্যাস করা এবং রাজনৈতিক দল চালানোর জন্য তাদের আর্থিক সাহায্যের উপর নির্ভর করা’ ।
গনতান্ত্রিক দেশে সৎ এবং নিবেদিতপ্রাণ সরকার গড়তে চাইলে সেজন্য প্রয়োজন, নিবেদিতপ্রাণ কর্মী । বর্তমানে আমাদের দেশে যে আর্থসামাজিক অবস্থা করছে তাতে দেশে তেমন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা গড়ে ওঠার কোন সুযোগ নেই ।
এখন যেসব ছাত্র, যুবক এবং পরিণত বয়সের মানুষ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করে তাদের এই কাজের খরচ এবং উপরি আয় তাদের রাজনৈতিক দলটি বহন করে অথবা তার ব্যবস্থা করে দেয়। একেবারে খোলাখুলি ভাবে বলা যায়, জামাতে ইসলামীর মতন ধর্মভিত্তিক দলগুলি একাজের জন্য বিদেশ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকে, বি এন পি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) ও জাতীয় পার্টি সরকারে থাকাকালীন সময়ে সঞ্চিত অর্থ থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করে থাকে, আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন সময়ে সঞ্চিত অর্থ থেকে এবং এখন (অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকাকালে) বিভিন্ন স্থান থেকে নানা উপায়ে তারা যাতে অর্থ পেতে পারে তেমন ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ব্যয় মিটিয়ে থাকে । এর বাইরে, সমাজতন্ত্রের স্বর্নযুগে যে সব নিবেদিতপ্রান ব্যক্তি রাজনীতি করতেন তারা এখনো অন্তরের তাগিদে তা করে থাকেন । তবে তাদের আর্থিক অবস্থা এবং জনসমর্থনের অবস্থা এমন করুন যে অন্যদের কাঁধে ভর না করে তাদের নির্বাচিত হবার উপায় নেই । সঙ্গত কারনেই এ ধরনের নেতা আর নতুন করে সৃষ্টি হবে না । এমন প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ,
(ক) যেহেতূ সংসদে আইন প্রনয়নের মতন গুরুত্বপূর্ন কাজ করার কোন বাধ্য বাধকতা নেই (যে কারনে বিদ্যাবুদ্ধি বা শিক্ষারও তেমন প্রয়োজন নেই),
(খ) বরং আছে লাভজনক প্রকল্পে অংশগ্রহনের সুবিধা,
তাই কম ধী-সম্পন্ন ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ী, যারা দলকে মোটা চাঁদা দেবার ক্ষমতা রাখেন, তারা সংসদ সদস্য হবার ইচ্ছে পোষন করেন এবং রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ইচ্ছা পূরন করে থাকে। সমস্যাটির কথা আর না বলে আমরা বরং এর সমাধানের কথাই বলি ।
এই সমস্যার সমাধান ঃ
সমাজতন্ত্র আর আসবে না । এই তন্ত্রে যে মহৎ উদ্দেশ্য ছিল তাও আর মানুষকে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে গরীবের উপকার করার জন্য প্রান বাজী রাখায় উদবুদ্ধ করবে না । এক্ষেত্রে আমাদেরকে ধনতান্ত্রিক গনতন্ত্রের মধ্য থেকেই ভালো রাজনীতিক তৈরী করার ব্যবস্থা করতে হবে । বর্তমানে “নেতার চামচা হয়ে এবং ফুটপাথ বেঁচে রাজনীতিক” হওয়ার যে পদ্ধতি আমাদের দেশে প্রচলিত আছে তা থেকে কোন নিঃস্বার্থ এবং নিবেদিতপ্রান রাজনীতিক জন্ম নেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই ।
বর্তমানে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মতন ধনতান্ত্রিক গনতান্ত্রিক দেশ সমূহে বড় পুঁজিপতিগন প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলগুলির খরচ বহন করে থাকে । এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিগন পূঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী পরিকল্পনা গ্রহন করতে বাধ্য হয় । আমাদের দেশেও যে এই অংশতঃ এবং কার্য্যতঃ এটাই ঘটছে তা বুদ্ধিমান লোকের না বোঝার কথা নয় ।
নিঃস্বার্থ এবং নিবেদিতপ্রান রাজনীতিক তৈরী করা সম্ভব সম্ভব যদি জনগন আগ্রহী মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলির রাজনীতি চর্চা করার ন্যুনতম খরচ বহন করে । এ কাজটি করতে হবে সরকারের মাধ্যমে । আমাদের দেশে সরকারী কোষাগার থেকে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ করার কথা উঠেছিল । এটি সঠিক পন্থা বলে মনে হয় না । আ বিষয়ে আদর্শ পন্থা হতে পারেঃ
(ক) রাজনৈতিক দল সমুহের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সর্বোচ্চ ৩ বা ৪ টি দলকে সমগ্র দেশে রাজনীতি করার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া, এই অর্থ খরচের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং প্রধান দলগুলিকে পর্য্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান (যেমন, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি) পালনের দায়িত্ব দেয়া ।
(খ) কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের রাজনীতি চর্চা করার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া । এই অর্থ হবে ছাত্রদের দেয়া সংসদ ফি এর অতিরিক্ত বরাদ্দ । ছাত্রদেরকে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একেবারে সম্পর্কশূন্য হয়ে এই রাজনীতি করতে হবে ।
অনেকে মনে করতে পারেন, এভাবে রাজনীতির জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ দেয়া হলে জনগগের আর্থিক ক্ষতি হবে । আসল ব্যাপারটি হল, তা না করায় বরং জনগনের বেশী ক্ষতি হয় । একটি তুলনামূলক চিত্র দিয়ে আমরা ঘটনাটি বলছ ।
যদি রাষ্টীয় কোষাগার থেকে রাজনীতি করার খরচ দেয়া হয়ঃ
ধরা যাক, বাংলাদেশে পাঁচ কোটি পরিবার, তিন কোটি ভোটার এবং এক কোটি আয়কর দাতা আছে । এক্ষেত্রে ভোটার প্রতি (ধরা যাক) দশ টাকা হারে ধরে সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলিকে ত্রিশ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারে । এর ফলে এক কোটি আয়কর দাতার সর্বোমোট ত্রিশ কোটি টাকা খরচ হবে ।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে রাজনীতি করার খরচ দেয়া না হলেঃ
আমাদের জানা আছে, একটি রাজনৈতিক দল ‘ডানো’ গুড়া দুধ কোম্পানীর বাংলাদেশী পরিবেশককে টিন প্রতি তাদেরকে একশ’ টাকা দেবার নির্দেশ দিয়েছিল । এর ফলে এই দুধের দাম রাতারাতি এক শ্’ দশ বা বিশ বেড়ে গিয়েছিল । আরেক সরকার এভাবে বানিজ্য করা ছাড়াও ফুটপাথ বানিজ্য করে, রাস্তা মেরামতের ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে জনগনকে যে কষ্ট দিয়েছে তা আমদের সবার জানা আছে । ক্ষমতাসীন দল যখন তাদের নিজেদের খরচ জিনিসপত্র সরবরাহকারী বা সেবা প্রদানকারী সংস্থা বা সরকারী প্রকল্প থেকে সংগ্রহ করে তখন জিনিসপত্রের অতিরিক্ত মূল্য বাবদ দেশের মানুষকে বিপুল পরিমান টাকা গচ্চা দিতে হয় । বাংলাদেশে এই টাকার পরিমান ভয়াবহ রকমের বেশী । এই ব্যপারটা বোঝার পর যে কোন বাংলাদেশীর উচিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে রাজনীতি করার খরচ দেয়ার ব্যপারে পূর্ন সম্মতি জানানো ।
রাজনীতি করার খরচ এখনকার মতন দলগুলিকে তোলার সুযোগ না দিয়ে সরকার সরাসরি তা দিলে যা হতে পারে তা হলঃ
(ক) জনগনের আর্থিক ক্ষতি ও কষ্ট অনেক কম হবে ।
(খ) রাজনৈতিক দলগুলি স্বচ্ছভাবে টাকা খরচ করতে শিখবে ।
(গ) জনগন রাজনীতিকদের বলতে পারবে, ‘তোমরা আমাদের টাকায় রাজনীতি করছ, তাই দায়ীত্বশীল আচরন কর’ ।
(ঘ) নীতিবান, ভদ্র এবং ভালোমানুষ রাজনীতিতে আসার সুযোগ পাবে । এখন প্রধানতঃ অর্থলোভী ছাত্র বা মানুষ ক্যাডার হতে উৎসাহী হয় ।
(ঙ) যারা রাজনীতি করবে তারা স্বাধীন ভাবে দলের ভেতরে বা বাইরে কথা বলতে বা ব্যবস্থা নিতে পারবে । এখন এদেরকে দলীয় প্রধান (যার মাধ্যমে টাকা পাওয়া যায়) এবং প্রধানের আত্মীয় বা চামচাদের মন রক্ষা করে সবকিছু বলতে বা করতে হয় । তাই তাদের স্বাধীন চিন্তা, চেতনা ও মনোভাব বিকশিত হতে পারে না ।
অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা, স্থাপত্য বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।