Kemone Bolibo Ami
কেমনে বলিব আমি
গত বছর ২৪ জুন এক রক্তপাতহীন ক্যু’র মাধ্যমে তত্কালীন নির্বাচিত অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডকে সরিয়ে দলের ডেপুটি লিডার জুলিয়া গিলার্ড প্রথম মহিলা এবং সে দেশের সাতাশতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন । দুপুরের পর মিডিয়াতে খবরটা চাউর হবার কিছুক্ষণ বাদে আমি চোখেমুখে গাম্ভীর্যের হালকা প্রলেপ মেখে অফিসে আমার প্রাক্তন ম্যানেজার ডেভিডকে বললাম, ‘আমার এখন তিনজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী ।’
উল্লেখ্য, ডেভিড জানে আমি বাংলাদেশ এবং অষ্ট্রেলিয়ার যৌথ নাগরিক। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা, এমনকি বিরোধী দলের প্রধানও একজন মহিলা । ইতিমধ্যে ডেভিড জুলিয়া গিলার্ডের খবরও জেনে গেছে । আমার মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে একসময় বিস্ফোরিত চোখে নরম গলায় প্রশ্ন করে, ‘দু’জন বুঝলাম, কিন্তু তৃতীয় জন কে ?’
কোনরকম ভণিতা না করে আমি কণ্ঠস্বরে হতাশার খানিকটা বরফকুচি মিশিয়ে বললাম, ‘আমার স্ত্রী ।’
আমার কথা শুনে ডেভিড হো হো করে হেসে ওঠে। চেয়ারে ওর বিশাল শরীরটা দুলে উঠে। একসময় হাসি থামিয়ে আমাকে সতর্ক করার মতো করে বললো, ‘নাউ ইউ আর ইন ট্রাবল্ ।’
কোনরকম ভণিতা না করে আমি তত্ক্ষণাত্ বললাম, ‘তাই তো দেখছি । আমার অবস্থা ত্রিশঙ্কু ।’
দুই.
আমার সামনে-পিছে এবং ডানে-বাঁয়ে বিভিন্ন ধরনের মহিলা । খোলসা করে বললেই বোঝা যাবে আমি কিসের মধ্যে আছি । আগেই উল্লেখ করেছি, আমি বাংলাদেশ এবং অষ্ট্রেলিয়ার যৌথ নাগরিক। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা। বিরোধী দলের প্রধানও একজন মহিলা । আমি এখন যে দেশে বসবাস করছি, সেই অষ্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান বৃটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। বলা বাহুল্য, তিনি একজন মহিলা । সাত-সমুদ্র তের নদীর ওপাড় থেকে তাঁর পক্ষে অষ্ট্রেলিয়ার দেখভাল করার মতো পরিস্থিতি নেই । তাই তাঁর একজন প্রতিনিধি আছে। রানীর সেই প্রতিনিধি, অর্থাত্ গভর্নর জেনারেল, কুইনটিন ব্রাইস একজন মহিলা । প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি । আমি অষ্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটেল টেরিটরীতে বসবাস করি এবং এই টেরিটরীর মুখ্যমন্ত্রী (চীফ মিনিস্টার) কেটি গ্যালাগার একজন মহিলা । এখানেই শেষ নয় । আরো আছে । বর্তমানে অফিসে আমার ইমিডিয়েট সুপারভাইজার একজন মহিলা এবং আমাদের টিমের অন্য সহকর্মীও মহিলা । ঘরের বসের কথা কি আর বলবো । তিনি তো শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সব সময় আমার সঙ্গে আছেন ।
তিন.
সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারী জাতির পক্ষে বিধাতার কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার?’ তবে নারীরা এখন আর ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ’ নয়, এমনকি ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ তাকানোর মতো তাদের ফুরসত্ নেই । বরং তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার তীব্র বাসনা । কাজী নজরুল ইসলাম নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এই পৃথিবীতে যা কিছু কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর ।’ এছাড়া ইসলাম ধর্মে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে । তাইতো এখন চারদিকে শোনা যায় নারীদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
শংকরের ‘একদিন হঠাত্’ উপন্যাসের উত্সর্গের কথাগুলো তিরিশ বছর বাদে আজ হুবহু মনে নেই । তবে যতদূর মনে পড়ে এক জায়গায় আছে, ‘নারীরা অগ্নি হইতে জল এবং জল হইতে অগ্নি সৃজন করিতে পারে ।’ তাই বোধহয় নারীরা পারে না, এমন কোন কাজ নেই । অতীতে তাদের একজন বৃটেনের রাজাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে এনেছে । আরেকজনের জন্য ধ্বংস হয়েছে ট্রয় নগরী । বর্তমান সময়ে গুপ্তচর কিংবা মহাশূন্যচারিণী থেকে শুরু করে রাজনীতির মতো জটিল-কুটিল পরিবেশে নারীদের অবাধ পদচারণা । এ প্রসঙ্গে আন্ডা-বাচ্চা ক্ষেত্রের কথা বাদই দিলাম । সামপ্রতিক কালে নারীর ক্ষমতার কয়েকটা উদাহরন তুলে দিচ্ছি।
সম্প্রতি অষ্ট্রেলিয়ার মাইনিং কোম্পানী এবং বিরোধী দলের প্রচন্ড বাধা এবং সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী সে দেশের জাতীয় সংসদে ‘কার্বন ট্যাক্স বিল’ পাশ করিয়েছেন ।
প্রধানমন্ত্রীদের ব্যপার-স্যাপার আলাদা । তাদের রাজনৈতিক দল আছে এবং দলের সমর্থন আছে । তবে সাধারণ নারীরাও কম যান না । কিছুদিন আগে বাংলাদেশে যৌতুকলোভী স্বামীর যৌতুকের দাবির বিরোধিতা করে বিয়ের দশ মিনিটের মধ্যেই আনকোরা স্বামীকে তালাক দেওয়ার অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন সাহসিকা একজন নারী ।
চার.
যে দিকে আমার দু’চোখ যায়, সে দিকেই নারীর মেলা । তাই কোন সাহসে এবং ‘কেমনে বলিব আমি’, নারীর স্বাধীনতা নেই, নারী অবলা । বরং নারীরা এখন পুরুষকে পেছনে ফেলে আধুনিকতার সিঁড়ি বেয়ে দুমদাম শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে।