Ajoy Kar's Article on Geoengineering
পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং -এর প্রয়োগঃ সমাধান নাকি সমস্যা?
পৃথিবীর তাপমাত্রা ২-১ ডিগ্রি বাড়লে রাশিয়ার ক্ষতি না হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বাড়বে চীন আর ভারত সহ পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলের দেশগুলিতে। বাংলাদেশ সহ বদ্বীপ রাষ্ট্রগুলির অধিকাংশই তলিয়ে যাবে জলের তলে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে জলবায়ুর যে পরিবর্তন- তার প্রভাব একেক দেশের কাছে একেক রকম ভাবে অনুভূত হয়। এছাড়া পৃথিবীর প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন। আর সম্ভবত সে কারণেই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকে কমিয়ে এনে পৃথিবীর তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। গ্রহণযোগ্য কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি না থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কোন দেশ হয়তো ধৈর্য হাড়িয়ে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। বায়ুস্তরে জমে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড সরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটস্ফিয়ার স্তরে সালফার ডাই অক্সাইড স্প্রে করে সোলার রেডিয়েশনকে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে না দিয়ে তাপমাত্রা কমানোই জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং মুল লক্ষ। জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং একটি সহজ আর সস্তা কারিগরি প্রযুক্তি। আর তাই, পৃথিবীর যে কোন একটি দেশের পক্ষেই একক ভাবে এই পদ্ধতিটির প্রয়োগ করে সারা পৃথিবীর তাপমাত্রাকে কমিয়ে আনা সম্ভব।
যদিও এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর কোন দেশই এই প্লানেটারী ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগের ব্যাপারে সরাসরি কোন অনুমতি দেয়নি, তবে সংকীর্ণমনা চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, বৈজ্ঞানিক সংগঠন আর ধনিক ব্যবসায়ী শ্রেণীর মধ্যে থেকে এই প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্ভাব্য প্রতিযোগী দেশের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ, চীন, জাপান, ভারত, আর রাশিয়া।
জেফ গুডেল তার ‘হাঊ টু কুল দি প্লানেট’ প্রতিবেদনে বলেছেন যে, ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা’র বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা জন হোল্ড্রেন, তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন যে, হোয়াইট হাউস জরুরী ভিত্তিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং -এর কথা অতি গুরুত্ব সহকারে ভাবছে। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা ইঊরী ইসরায়েল হেলিকপ্টার থেকে সোলার রেডিয়েশনের উপর এরোসল স্প্রে করে সফলতা অর্জনের পর এখন ব্যাপক আকারে পূর্ণ মাত্রায় এরোসল স্প্রের কথা ভাবছেন।
ওজোন স্তরের গর্ত নিয়ে গবেষণার জন্যে রসায়ন বিদ্যায় ২০০৫ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পল ক্রুটজেন মনে করেন যে যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং মানুষের আওতার বাইরে চলে যায় তাহলে বায়ুস্তরের রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন করে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিংকে বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কালগেরী ইউনিভারসিটি’র চিন্তাবিদ ডেভিড কিথের উপদেশে মাইক্রোসফটের ক্রিয়েটর, বিলিয়ন ডলার ম্যান বিল গেটস জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গবেষণার জন্যে এযাবৎ প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছেন। বিল গেটস ইন্টেলেকচুয়াল ভেনচার নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন বিশিষ্ট বিনিয়োগকারী। এই প্রতিষ্ঠানটি বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটস্ফিয়ার স্তরে সালফার ডাই অক্সাইড স্প্রে করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে।
জেফ গুডেলের ‘ক্যন ডক্টর এভিল সেভ দি ওয়ারল্ড?’ প্রতিবেদনে প্রকাশ যে, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের ‘স্টার ওয়ার মিসাইল শিল্ড’প্রকল্পের প্রধান লয়েল ঊড এই ইন্টেলেকচুয়াল ভেনচারের সাথে জরিত। ঊড বিশ্বাস করেন যে, জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং অপরিহার্য। সময়ের অপেক্ষা মাত্র- এই সহজ আর সস্তা কারিগরি প্রযুক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতাদের চেতনা জাগরণের অপেক্ষা মাত্র।
ভার্জিন ব্লুর চিপ এক্সিকিউটিভ অফিসার বিলিয়নিয়ার রিচার্ড ব্রানসন গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে পৃথিবীকে বাচাতে ওয়ার রুম প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের লক্ষ হচ্ছে বাজার চাহিদার ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার সমাধান। এধরনের সমাধানে পৃথিবীর জল, বাতাস, মাটি, আর জীব-বৈচিত্র্য- সবকিছুকেই পণ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর সে কারণে পরিবেশবাদীরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রয়োগকে অস্থায়ী সমাধান, অনৈতিক, আর অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করছেন। তারা বলছেন জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা নষ্ট করবে। তাদের যুক্তি হচ্চে যে, বায়ু স্তরে সালফার ডাই অক্সাইড স্প্রে করে পৃথিবীতে সোলার রেডিয়েশন প্রবেশকে বন্ধ করা সম্ভব হলেও সমুদ্রের এসিডিফিকেশন কমানো সম্ভব না। পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা যে, সালফার ডাই অক্সাইড স্প্রে করে বায়ু স্তরের রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন করা শুরু হলে পৃথিবীর মানুষ আর নীল আকাশ দেখতে পাবে না।
পরিবেশবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, জীব-বৈচিত্র্য-এর ভারসাম্যতা তখনই কেবল নিশ্চিত করা সম্ভব যখন মাদার নেচারের অধিকার সংরক্ষণ করা যাবে। তাই সারা পৃথিবী জুড়ে পরিবেশবাদীরা মাদার নেচারের অধিকার সংরক্ষণে সকলকে এক হয়ে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
ওয়ার রুমের ওয়েবসাইটে জ়ে, এরিক, বিকেল আর লী লেন-এর এক রিপোর্টে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, পরিবেশবাদী আন্দোলনই হবে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগের প্রধান প্রতিবন্ধক। আর সে কারণে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগের বাস্তবায়ন হবে ঐ সকল দেশের নেতৃত্বে যেসকল দেশে পরিবেশবাদী আন্দোলন দুর্বল।
-অজয় কর। ক্যানবেরা থেকে।