My teacher Dr. Abu Usuf Alam and a unsolved question
আমার স্যার ড. আবু ইউসুফ আলম এবং একটি অমিমাংসিত প্রশ্ন
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম হাবিবী (লন্ডন থেকে)
১৯৮৪-৮৫ সেশনের শিক্ষা বর্ষে আমি চবিতে ভর্তি হই।অনার্সের দুটি সাবসিডিয়ারি বিষয়ের একটি ছিল ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি। ড. ইউসুফ স্যার ছিলেন এই বিভাগেরই প্রফেসর। অবশ্য, পরবর্তীতে আরেকটি এম এ করার জন্য আমি ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে বেছে নিয়েছিলাম। এই বিষয়টি আমার অনার্সের মূল সাবজেক্ট না হলেও আমার সখ্যতা, আসা-যাওয়া, খাওয়া ও আড্ডা ছিল এই বিভাগের সাথেই বেশী।
যার কারণে আমার লিখিত বই এর জন্য কিছু লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলাম এই বিভাগেরই শিক্ষক জনাব রেজাউল করিম মামুন স্যারকে। ড. মঈনুদ্দীন খান স্যারের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মত।
ইউসুফ স্যারের অফিস ছিল কলা ভবনের প্রথম সিঁড়ির পাশে। উঠতে নামতে অফিসটি চোখে পড়ত। এই কারণেও অনেক সময় স্যারের সাথে দেখা্ হয়ে যেত। আবার অফিসে গিয়ে একটু বসতে হত দেখেছি বলে। খেয়েও আসতে হত প্রায় সময়। তিনি কখনো কোন দর্শনার্থীকে আপ্যায়ন না করে যেতে দিতেন না।
ছাত্র জীবনে তিনি সব সময় আমার পাশে ছিলেন। ভার্সিটির একাডেমিক প্রয়োজন ছাড়াও ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও আমি স্যারকে একান্ত বন্ধুর মত, মুরুব্বির মত কাছে পেয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে মানুষকে গ্রহণ করতে পারতেন। তাঁর মধ্যে কখনো কৃত্রিমতা ছিল না। তিনি পদ বা পদবীর জন্য কখনো ভূষণ এবং ভাষণ পরিবর্তন করেন নি। তিনি ছিলেন খাঁটি চাঁটগায়্যা ঘরানার জাতীয়তাবাদী বৈশ্বিক বাঙ্গালী। দেশ ছিল তাঁর চেতনায়, স্বকীয়তা ছিল ব্যক্তিত্বে, মনীষার দীপ্তি ছিল লেখায় এবং বক্তব্যে,-বক্তব্য ছিল রসময়, প্রাণময় চট্টগ্রামের শব্দ-সুধার বিপুল আয়োজন।
এরশাদ ও তৎ পরবর্তী ভিসি আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠায় দীর্ঘদিন চবি বন্ধ থাকার কারণে আমাদেরকে এম এ পরীক্ষা দিতে হয় ১৯৯২ ইংরেজিতে। আমি ২১ তম ব্যাচের ছাত্র।তখন ভিসি ছিলেন রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। থাকতাম আলাওল হলে। প্রভোস্ট ড. আহমদ নবী স্যার। আমার পুরাতন ডাইরীর হিসেব মতে, ১৩.১০ ‘৯১ ইংরেজির এক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে উপস্থিত হবার জন্য আমরা স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আসেন নি। এসেছিলেন, হিসাব বিজ্ঞানের ড. জহিরুল হক, ইসলামের ইতিহাসের ড. হাফিজুদ্দিন এবং রসায়নের প্রাক্তন ডিন-(নাম অস্পস্ট)। মনে পড়ে সেদিন আমি ৫টি বিষয়ে পুরস্কার পেয়েছিলাম। আমার লেখা একটি কবিতার নাম ছিল ‘ টুঙ্গি পাড়ার কৃষ্ণ চূড়া’।
ইউসুফ স্যার আমার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং লেখালেখির ‘রোগ’ সম্পর্কে জানতেন। তাঁর অফিসের পিছনের বটতলে আমি বহুবার বাউল বেশে, একতারা হাতে গান-কবিতা করেছি। ২১ তম ব্যাচের ‘রেগ ডে’ তে আমি একাধারে নগর কমিটি ও আলাওল হল কমিটির বাউল ছিলাম। দুবারই আমি মঞ্চে উঠে স্বরচিত গান গেয়েছি। হিন্দু-বুদ্ধ মন্দিরে করেছি নাটক ও কবিতা আবৃত্তি। করেছি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় নাটক। বুদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার জন্য আমি প্রায়শঃ আমন্ত্রিত হতাম। বলাবাহুল্য, রাউজানের একটি বুদ্ধমন্দিরে আমার লেখা বুদ্ধ সঙ্গীত প্রায় সময় গীত হয়। এ সব স্যার জানতেন। তাই তিনি ১৯৯৯ সালে আমার স্থায়ী ভাবে লন্ডনে আসাকে উৎসাহিত করেন নি।
পারিবারিক প্রয়োজনে আমাকে লন্ডনে চলে আসতে হলেও আমি স্যারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতাম।। অবশ্য, তার অনেকটাই হত আমার বন্ধু ড. এস এম রফিকুল আলমের মাধ্যমে। রফিক ভাই সব সময় আমাকে স্যারের কথা বলত এবং অসুখ-বিসুখের খবরা-খবর দিত।
সর্বশেষ আমি দেশে যাই ২০০৮ সালে। কয়েকদিন পর ড. রফিক সহ স্যারের সাথে দেখা করি। উনি তখন অন্য দুজন শিক্ষকের সাথে আলাপ চারিতায় ছিলেন। আমাদের দেখে অন্য শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ ঠিক আছে, ও কথা পরে হবে, আঁর লন্ডনী ছাত্র আইস্যে’, বলে সামনের চেয়ারে বসতে আদেশ করলেন। জেনে নিলেন ছেলেমেয়েদের কথা, সাহিত্যচর্চা কেমন চলছে, দিন কেমন যাচ্ছে, অক্সফোর্ডের পড়াশুনা কেমন চলছে, কতদিন আছি ইত্যাদি। ৫ জুলাই,’০৮ চবি আমাকে সংবর্ধনা জানায়। অনুষ্ঠানে আমরা স্যারকে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। গ্রুপ ছবি তোলার সময় স্যার বললেন, ‘ছবি দিয়ারে কি অইবু, হ দিন আছি’। (ছবি দিয়ে আর কি হবে? বাঁচবই বা কত দিন)।
আমার আশা ছিল, দেশে একটি গ্রামিন সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক এনজিও করব। ড. রফিক সহ বিষয়টি স্যারের কাছে প্রস্তাব করলে তিনি এতে উৎসাহিত হন। প্রয়োজনীয় বুদ্ধি-পরামর্শ দেবেন বলে সম্মতি জানান। এ সংক্রান্ত একটি কমিটি করে দিয়ে লন্ডনে চলে আসার আগে ড. রফিককে বলে আসি আমার লেখার সব ক’টি বই এবং আমার গানের একটি এ্যালবাম যেন স্যারকে উপহার দেয়।
একদিন রফিক ভাই ফোন করে ইউসুফ স্যারের লন্ডন ভ্রমনের বিষয়টি আমাকে অবহিত করে । আমার সে কী আনন্দ! স্যার আমার বাসায় আসবেন। একটু আপ্যায়ন করার সুযোগ পাব। তখনই আমি স্যারকে মোবাইলে ফোন করে স্বাগত জানাই। তার পরের দিনও বাসায় ফোন করে লন্ডনে আমার প্রস্তুতির কথা বলি। ভাবতে থাকি, কোথায় কোথায় স্যারকে নিয়ে বেড়াতে যাব, কখন সাংবাদিক সমিতির পক্ষে সংবর্ধনা দেব, কখন আমার পরিচালিত টিভিতে নিয়ে সাক্ষাৎকার নেব, তাঁর পদস্পর্শে আমার পরিচালিত কলেজকে একটু ধন্য করব, কি রান্না করব, কি খেলে স্যার খুশি হবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্যার ঠিকই লন্ডনে এসেছেন। তবে হাজার ব্যস্ততার কারণে আমার বাসায় আসতে পারেন নি।
বাসায় বসে বাংলাদেশের সংবাদ শুনছিলাম। বার বার টিভির পর্দায় একটি শিরোনাম। চবির ভিসি ড. আবু ইউসুফ আলম আর নেই! চোখকে সহসা বিশ্বাস করি নি। আবার পড়লাম এবং আবার! দেশে ফোন করি। দেশ থেকেও অনেকের টেক্স পাই। বিশ্বাস করতে হল। যা সবাইকে করতে হয়।
মনে পড়ল ছবি তুলার সময় বলা কথাগুলি’ ছবি দিয়ারে কি অইবু, হ দিন আছি’। তা হলে স্যার কি জানতেন যে, তিনি চবির ক্যাম্পাস ছেড়ে মানবমনেরমন্দিরে বিদ্যাদ্বীপের দীপ হয়ে জ্বলবেন?
তিনি চলে গেছেন বিশাল এক মনীষার বাগান বুকে নিয়ে। অগণিত অসংখ্য বিশ্বখ্যাত ছাত্রছাত্রী রেখে। যারা সারা জীবন স্যারের গুণগান গেয়ে বেড়াবে। যে ইতিহাসের ক্ষয় নেই।
জানি, জীবনের আগে মৃত্যুর সৃষ্টি। মরণ মানুষের পায়ে পায়ে হাঁটে।
কিন্তু কিছু মৃত্যু না এসেও তো পারে। কিছু মানুষ থেকে গেলে সৃষ্টির কী এমন ক্ষতি?
০১.১২.’১০ লন্ডন।
sagarsahara@hotmail.com