Dilruba Shahana's Bangla Article Unsolved
অমিমাংসিত আলেখ্য – দিলরুবা শাহানা
টেলিফোনটা রাখার পর পরই আবার বাজলো। অস্বস্বি লাগছে। রিসিভার তুলবো কি না ভাবছি। বেজেই চলেছে। থামছেই না। সেই একই তরুণ কন্ঠ রাগী স্বরে আবার কিছু কথা শুনাবে না তো? বলবে না তো
‘শক্তি যখন আছে অযথা অপব্যয় কেন তার? আইভরী টাওয়ারের লোকদের গল্প ছেড়ে বাস্তবে নামুন…?’
টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করেই যাচ্ছে। তুলতেই শুনি শাš- গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন
‘অমুকের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
‘বলছি আপনি…’
প্রশ্ন শেষ করা হলনা। আবার গম্ভীর স্বরেই তবে তাড়াহুড়ো কথা
‘আয়্যাম দেবনাথ হোড়’
একটু বিরতি। অবাক কান্ড এই নামের কাউকে তো মনে পড়ছে না? হোড় ইংরেজীতে কিভাবে লিখে? নিশ্চয় whore নয়। জিজ্ঞেস করলাম
‘কে?’
‘ইট’স মি মণীষা’জ আঙ্কল’
মণীষার আঙ্কল! ওরে বাপ এতো দেখি নিমের পাতা চিবিয়ে মুখ তেতো করা লোক। আগের ফোনটা ছিল কথায় বারুদ দিয়ে উগরে দেন এমন একজনের, তার মুখ দিয়ে যেন আগুণের হল্কা বেরুচ্ছিল। আর মণীষার আঙ্কল গতবার মনে হয় নিমপাতা চিবিয়েছিলেন তাই কথা যেটুকু বলেছিলেন তা ছিল ভীষণ তিতা।
মণীষার আঙ্কল কে? আঙ্কল ওর চাচা, মামা নাকি খালু, ফুপা কোনজন হবেন? জানি না। ইংরেজী ভাষার এই এক সমস্যা। নাকি সীমাবব্ধতা? বাংলাভাষার মত প্রত্যেককে আলাদা আলাদা শব্দে সম্বোধন করলে ভাল হতো নাকি? এখনতো দেবনাথ হোড়কে মণীষার আঙ্কলই বলতে হবে।
নিঃসন্তান ভ্রমণবিলাসী আঙ্কল-আণ্টি আসার আগেই মণীষা নিরামিষ খেতে আর ওর মতে সদা প্রফুল্ল আঙ্কল-আণ্টির নানা অভিজ্ঞতার মজার মজার গল্প শুনতে আমাদের চারজনকে ডেকেছিল। ষ্টীভ-শ্যারন, আর আমরা দু’জন। ছ’জনের টেবিলে বাড়তি দু’টো চেয়ার জুড়ে আটজনের সিটিং ডিনারের ব্যবস্হা। ষ্টীভ ও শ্যারন এশিয়ার কয়েকটি দেশে শিক্ষকতা করেছে ও উন্নয়ন সংস্হাতেও জড়িত ছিল। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। বাচ্চা হবে ওদের। তাই আপাততঃ দু’বছর মেলবোর্নে থাকবে ওরা। শ্যারনের যাকে বলে ভরা গর্ভ। তারপরও নিরামিষ আর গল্পের দাওয়াত বাদ দিতে নারাজ ওরা। ওরা বেশ অনেকদিন ধরেই নিরামিষভোজী হয়ে গেছে। নানান ধরনের নিরামিষ রান্না করাও শিখেছে।
মণীষা শাক পনির, ছোলার ডাল কাচ কলা দিয়ে রান্নতো করেছেই ও আরও দু’তিন পদ করেছিল। আমার স্ত্রী করেছেন টমেটো-মাশরুম-রিকোটো চিজের ঝোল, বেগুন- পনির পিয়াজ পাতা দিয়ে ডিশ। আমার স্ত্রীর কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে নিরামিষ রান্না শিখেছে ষ্টীভ। ও করেছে আদা, পিয়াজ, কাচামরিচ, ধনে পাতা আর ঘি দিয়ে মাখা মাখা করে না ভেঙ্গে আস্হ রেখে মশুর ডাল।
খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতোই ছিল সব। তবে প্রতিশ্র“ত গল্গ শুনা হল না। মণীষার আঙ্কল-আণ্টি উপস্হিত ছিলেন ঠিকই। অনুপস্হিত ছিল তাদের হাসিখুশী আর বন্ধ ছিল তাদের গল্পের ঝাপি। বিষয়টা আন্দাজ করে মণীষাও যেন কিছুটা বিব্রত, কিছুটা হতভম্ব।
মণীষা বলেছিল ওর আঙ্কল আমেরিকাতে থাকেন। আমেরিকা একটি লিটিগেটিভ সোসাইটি। সেখানে বিচিত্র এক মামলায় জিতে ক্ষতিপূরণ বাবদ বেশ মোটা অর্থ অর্জিত হয় তার। সে অর্থের কিছু দান খয়রাত করেছেন আর কিছু তাদের একমাত্র নেশা ভ্রমণে খরচ করছেন এখন। মামলাটা ছিল মানহানির মামলা। মামলা করার কথা তার মাথায়ও আসেনি। ঘটনার অভিঘাতে বেচারা যখন মুষড়ে পড়া অবস্হায় তখন নিউইয়র্কের এক ল’ ফার্ম থেকে তাকে ডাকা হল। তার
া তার পক্ষে বিনা খরচে মানহানির জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করবে বললো। আরও বললো যে মামলা জেতার পর ক্ষতিপূরণ বাবদ যে অর্থলাভ হবে তার একটা অংশ উকিলের পারিশ্রমিক বাবদ তারা কেটে রাখবে। আমেরিকান সমাজ সম্বন্ধে যারা ধারনা রাখেন তারা জানেন ডেফেমেশন ও টর্ট স্যুট করে উকিলরা অনেক অর্থ নিজেরা যেমন উপার্জন করেন মানুষকেও অর্থ পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন। মণীষার আঙ্কল বরাবরই পরোপকারী। বাংলাভাষায় একটি প্রবচন আছে উপকারীকে বাঘে খায়। মণীষার আঙ্কল এমনি উপকার করতে গিয়ে বাঘের খপ্পরে না পড়লেও এক মহা বিপদের মুখোমুখী হন। এক বৃষ্টি মুখর দিনে বাচ্চা কোলে অর্ধসিক্ত এক মহিলা ছুটে এসে গাড়ীতে লিফ্ট চাইলে নরম মনের দেবনাথ হোর না করতে পারেন নি। গাড়ী কিছুদূর যাওয়ার পর মহিলা হঠাৎ ছুরি বের করে ভয় দেখিয়ে দেবনাথকে অন্য শহরে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। সন্ধ্যার দিকে ওই শহরে পৌঁছানো মাত্র পুলিশ গাড়ী আটক করে। প্রথমে পুলিশের ধারনা হয় দেবনাথ হোর হলেন ওই মহিলার কুকর্মের সহযোগী। দাগী অপরাধী মহিলা আরেকজনের বাচ্চা চুরি করে জোরজবরদস্হিতে দেবনাথকে সঙ্গী করে পালাচ্ছিল। টিভি চ্যানেলে, পত্র-পত্রিকায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ছবিসহ খবর প্রচার হল। পরে দেবনাথের নির্দোষিতার প্রমাণ পেয়ে পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আর খাড়া করলো না। তারপরও আত্মীয়-বন্ধু-সহকর্মী সবাই তাকে কেমন যেন অদ্ভুত চোখে দেখছে মনে হল। মানুষের বিপদ দেখলে সব আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যান এবার তারই আক্কেল সেলামী দিয়েছেন এমন কটূ মš-ব্যও শুনলেন দেবনাথ। পরিস্হিতির শিকার পরোপকারী দেবনাথ ভেঙ্গে পড়লেন ভীষণ। অসহায়ভাবে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করলেন বৃষ্টি সিক্ত কেন রক্তাক্ত হয়েও যদি কেউ সাহায্য চাইতে আসে একতিলও আর নড়বেন না। যা হোক শেষ পর্যš- সন্মানহানির ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থপ্রাপ্তির পর সবাই তার প্রতি সমাদরে গদগদ হল। যখন নানা ভাবে নানা জনের উপকার করেছেন লোকজন তাকে আদর-সমাদর দূরের কথা বোকাই ভাবতো। তবে তখনও কারও সাহায্যের দরকার হলে তার পিছু ছাড়তো না এটাও ঠিক।
এ সব ঘটনা মণীষাই বলেছিল। ইন্ডিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান হয়ে আমেরিকাতে ফিরবেন তারা। ইন্ডিয়া থেকে অষ্ট্রেলিয়ায় মণীষার কাছে পৌঁছালেন দু’জন যেন নতুন মানুষ। গম্ভীর, চুপচাপ, নিজেরা দু’জনেও নিজেদের মাঝে কথাটথা তেমন বলছেন না।
খাওয়ার টেবিলে ষ্টীভই টুকটাক নানা দেশ নানা ¯’ানের ঘটনা বর্ননা করলো। ওর অভিজ্ঞতায় দেখেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাধারন মানুষ সাধাসিধা ধরনের। মানুষকে সন্মান করে, সাহায্য করে। রাস্তার হদিশ জিজ্ঞেস করলে দু’পা এগিয়ে এসে দেখিয়ে দেবে এরা। যা কি না ইউরোপ-আমেরিকাতে সচরাচর কেউ করে না। আঙ্কলকে আলোচনায় উৎসাহিত করার জন্য মণীষা বললো
-‘এশিয়ান বলেই আঙ্কল এক মহিলাকে সাহায্য করতে গিয়ে কি বিপদেই না পড়েছিলেন, ঠিক না আঙ্কল?’
তারপরও ভদ্রলোক মাথা দুলিয়ে নীরব রইলেন। শ্যারন বললো
-‘অপকার করলে অনুশোচনা হয় বা হবে তবে উপকার বা সাহায্য করতে না পারলে বা না চাইলে তার জন্য বিবেক যন্ত্রণা বা অনুশোচনা কখনোই হবে না।’
হঠাৎ করেই মৌনতা ভেঙ্গে তেতো গলায় মণীষার আঙ্কল বলে উঠলেন
-‘না এই কথাটা একবারে ঠিক নয়।’
বলেই নীরবতায় ডুবে গিয়ে খাবার থালায় মনোযোগ দিলেন। তার চেহারা দেখে কথাটার ব্যাখ্যা চাওয়ার ইচ্ছা হল না কারও।
দু’দিন পরই আঙ্কল-আণ্টি আমেরিকা ফিরে গিয়েছিলেন। মণীষা পরে একবার ইতস্ততঃ করে বলেছিল
-‘ইন্ডিয়াতে দিনপনেরো ঘুরে বেড়ানোর সময় কিছু একটা ঘটেছিল মনে হয় তাই যেন দু’জনের ব্যক্তিত্বের এমন পরিবর্তন, একজন আরেকজনের থেকে বহু দূরে যেন।’
সেই আঙ্কল আজ ফোন করেছেন। দেবনাথ হোর বললেন
‘কিছু কথা বলতে চাই আপনার শোনার সময় হবে কি? কথা আমার দীর্ঘ সুতরাং বেশী সময় টেলিফোনে ব্য¯- থাকলে আপনার স্ত্রী আপনার উপর বিরক্ত হবেন নাতো?’
‘অসুবিধা নেই তবে দয়া করে আগামীকাল এইসময়ে ফোন করলে ভাল হয়’
গভীর শ্বাস ফেলে ভদ্রলোক বললেন
‘ঠিক আছে তবে, আগামীকালই কথা হবে।’
ভদ্রলোক বোধহয় স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে আছেন। ফোনে কথা বললে স্ত্রী বিরক্ত হয় নাকি? আমার স্ত্রী অন্ততঃ বিরক্ত হন না। আমি স্ত্রীর দিকে তাকালাম। উনি ভীষণ যত্নে ধূলোবালি ঝাড়পোছে নিবেদিত। হঠাৎ মনে হল আমার স্ত্রী কি তবে আমার ব্যাপারে উদাসিন, নির্লিপ্ত। আমি কার সাথে টেলিফোনে রসালাপে নাকি ঘষালাপে মত্ত তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই মোটে। কি জানি বুঝতে পারি না। তবে আমার যে কোন প্রয়োজনে, যে কোন দ্বিধাধ›ে˜ উনি আমার ত্রাণকর্তী। হোর পদবী শুনে তখন থেকেই ভাবছি। মণীষার পদবী হোর নয় এ আমি নিশ্চিত জানি। দেখি তো আমার স্ত্রী এমন পদবীধারী কাউকে জানেন কি না। উনি হচ্ছেন তথ্যের খনি। যে কোন বিষয়ে কোন কিছু তার কাছে জানতে চাইলে কেউ নিরাশ হয় না কখনো।
‘শুন হোর পদবী আছে এমন কাউকে চেন তুমি?’
‘চিনি না পরিচয় নেই তবে এমন পদবীধারী লোক আছে জানি’
‘কে আছে বলতো?’
‘ভারতে এক নামকরা চিত্রশিল্পী আছেন যার নাম সোমনাথ হোর।’
স্ত্রীর কথা শুনে তখন মনে পড়লো সোমনাথ হোরের কথা। হোর উনি ইংরেজীতে লিখেন hore। আমার ভুলো মন। আমার স্ত্রীর অসাধারন স্বরনশক্তি। আমি তার মন থেকে বিসৃত হয়ে যাব না কখনোই।
দেবনাথ হোর পরদিন ফোন করলেন। অনেকক্ষণ কথা বললেন। শেষে এসে মনে হল কথাতো নয় যেন হাহাকার করছেন ভদ্রলোক। নিরপরাধ নিঃসন্তান মানুষটির স্ত্রী তাকে বিয়ের তেত্রিশ বছর পর ছেড়ে চলে গেছেন। নিজের বিবেক যন্ত্রণা, স্ত্রীর অবুজপনা সব কিছু মিলিয়ে ভদ্রলোক দিশেহারা। উনি বললেন
‘যখন নষ্টাভ্রষ্ঠা এক মেয়েলোকের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার কথা রটেছিল, পুলিশ আমার পিছু নিয়েছিল তখনও উনি আমার পাশে শক্তিময়ীর মত দাড়িয়ে ছিলেন, আমার প্রতি ছিল তার অগাধ আস্হা আর এবার…’
বছর চারেকের বাচ্চাটা মা-বাবার সাথে মাইক্রোবাসে উঠতে চাইছিল না কিছুতেই। সে আবদার করছিল দেবনাথদের সাথে জিপে উঠে যাবে। ভারতের এক অঞ্চলে একপাশে পাহাড় অন্যপাশে গভীর খাদ। এমন জটীল পথে হঠাৎ পরিচিত অনাত§ীয় ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিতে চাইলেন না দেবনাথ। বাচ্চা মেয়েটি কান্না জুড়লো, দেবনাথের স্ত্রী শিশুটির কান্নায় গলে গিয়ে ওকে জিপে তুলতে আগ্রহী হলেন। দেবনাথ বৃষ্টিসিক্ত, রক্তাক্ত কি কান্নালিপ্ত কাকুতি কোনকিছুতেই টলবেন না বলেই স্হির রইলেন। বাচ্চাটা মাইক্রোবাসে উঠেও জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কাঁদছিল। দেবনাথের সš-ানহীনা স্ত্রী ক্রুদ্ধ ও ব্যথিত হয়ে নিশ্চল নিশ্চুপ বসে। পাঁচ কি সাত শ’ মিটার যাওয়ার পর ঘটলো ভয়ংকর কান্ড। মাইক্রোবাস ছিট্কে খাদে পড়লো। আমেরিকা থেকে আগত দেবনাথের সর্বাধুনিক সেল ফোনের কল্যাণে পুলিস, উদ্ধারকর্মী সবাই দ্র“ত খবর পেয়ে ছুটে এল। তবে মাইক্রোবাসের যাত্রীদের কেউ বেঁচে ছিল না। যখন গভীর শোকের আবহে চারপাশ আচ্ছন&egr
ave; তখন নীরবে উধাও হলেন দেবনাথের স্ত্রী। তিনদিন পর অনেক দূরে পাহাড়ী গ্রামের এক কিষানের বাড়ীতে জ¦রে অচেতন স্ত্রীকে খুঁজে পান দেবনাথ। মনে হল স্ত্রী তাকে চিনেন নি, নাকি ইচ্ছে করেই না চেনার ভান করে আছেন দেবনাথ আজও তা জানেন না। এখনও আছেন এক ছাদের নীচে দু’জন। অপরিচিত দু’জন মানুষ যেন।
দেবনাথের হƒদয় নিংড়ানো হাহাকার
‘বাচ্চাটাকে যদি আমার স্ত্রীর কথা শুনে জিপে তুলে নিতাম ও বেঁচে যেতো নাকি জিপ খাদে পড়তো?’
নিরুত্তর আমি আস্তে রিসিভার রেখে দিলাম।