প্যারিসের চিঠি : প্লাস দো লা কনকর্ড – ওয়াসিম খান পলাশ

প্যারিসের চিঠি : প্লাস দো লা কনকর্ড – ওয়াসিম খান পলাশ

প্যারিসের প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্লাস দো লা কনকর্ড এলাকাটি এক কথায় অপূর্ব। এলাকাটি যেমন ঐতিহাসিক স্থান তেমনি ব্যস্ত। একটি এথলেটিক্স ষ্টেডিয়ামের চারপাশ ঘিরে যেমন প্রসস্ত ট্র্যাক তৈরী করা থাকে ঠিক তেমনি স্থানটির চারপাশে প্রসস্ত বাকানো রাস্তা। মাঝখানের জায়গাটি টুরিষ্টদের জন্য, যেখানে আছে এক অপূর্ব পানির ফোয়ারা, আরব বর্ন খচিত বিশাল স্তম্ভ যার বিবরন পরবর্তীতে দেয়া হয়েছে । এর এক পার্শ্বে সবুজ পার্ক আর গাছ-গাছালি দ্বারা পরিবেষ্টিত। পার্কের পশ্চিম পার্শ্বে সামান্য দুরত্বে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ভবন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকলাস সাকোজির সদর দপ্তর। আমেরিকা, ব্রিটেন সহ বেশ কয়েকটি দেশের কুটনৈতিক মিশন রয়েছে এখানে। একটু দূরেই বিখ্যাত লুভ মিউজিয়াম। লম্বা ইউ আকৃতির বিল্ডিং। মাঝখানে বিশাল চত্বর, স্বচ্ছ কাচের পিরামিড আর চারিদিকে ফরাসি আকিটেক্টের নিপুন কারুকাজ।

ফরাসি রাজা লুইস XV এর সময় প্লাস দো লা কনকর্ড নির্মানের পরিকল্পনা করা হয় এবং নির্মিত হয়। রাজা লুইস XV একবার চিন্তা করলেন, প্লাস দো লা কনকডকে মূল ভিত্তি ধরে রাজ প্রসাদ বরাবর সুন্দর একটি এভিনিউ নির্মান করবেন তিনি। পরিকল্পনা মাফিক প্লাস দো লা কনকর্ডে এক বিশাল প্রসস্থ চত্তর তৈরী করেন। তার সময় কনকর্ড থেকে রাজপ্রসাদ পর্যন্ত এলাকাটি লোহার গ্রীল দিয়ে ঘেরা ছিল। ১৭৪৮ সালে রাজা সেন্ট লুইস এলাকাটির আরো সৌন্দয বৃদ্ধির জন্য ঐ সময়ের বিখ্যাত আকিটেক্ট জ়্যাক অঞ্জ গ্যাব্রিয়েলার শরনাপন্ন হন। জ্যাক অঞ্জ প্লাসটির চমংকার একটি ডিজাইন আকেন। প্লাসটিকে সামনে রেখে পিছনে দুইটি প্রাসাদ তৈরী করেন। দুই প্রাসাদের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে এক প্রসস্ত একটি রাস্তা। এছাড়া প্লাসটির চারিদিকের সৌন্দয বৃদ্ধির জন্য পাথর ও লোহার চিত্রকর্ম স্থাপন করেন। কিন্তু রাজা লুইসের প্রথম পছন্দ ছিল পাথরের ঘোড়া ( পুরুষ ঘোড়া )। পরবর্তীতে রাজা লুইসের পছন্দ মত সাদা পাথরের দুরন্ত ঘোড়া তৈরী করা হয় এবং স্থাপন করা হয়।

১৭৬২ সালের ২৭ শে জুলাই পাথরের মূর্তি ও চিত্রকর্মগুলো প্লাস দো লা কনকডে বসানো হয়। ঘোড়া ও ঘোড়া পৃষ্ঠে উপবিষ্ট রাজার মূর্তিকে পূর্ব দিকে মূখ করে একটু বাকানো অবস্থায় বসানো হয়েছে। দেখলে মনে হবে ওরা শহরের দিকে তাকিয়ে আছে। এছাড়া দুই প্রাসাদের মাঝখানে ২০ মিটার প্রসস্ত এভিনিউ । ১৭৬০ হতে ১৭৭৫ সালের মধ্যেই প্লাসটিকে আকর্ষনীয় করে ফেলা হয়। আর্কিটেক গ্যাব্রিয়েল এরই মধ্যে উত্তরদিকের দুইটি প্রসাদের কাজও শেষ করে ফেলেন। স্কয়ারটির বাম দিকে, পূর্রপাশ্বে বেশ অনেকগুলো আবাসিক হোটেল তৈরী করা হয়।

১৭৭৭ সালে সম্পূর্ন কাজ শেষ হয়। রাজা লুইস দুইটি প্রাসাদের একটিকে মিউজিয়াম তৈরীর সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন যাতে ফরাসি, ইউরোপিয়ান ও অন্যান্য দেশের দূর্লভ চিত্রকর্ম ও স্যুভেনির সংরক্ষন করা হয় । পরবর্তীতে মিউজিয়ামটি সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

রাজা অপর প্রাসাদটি নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের দপ্তর করেন। সে সময় নৌপরিবহন মন্ত্রনালের কাজ ছিল পারীজিয়ানরা যে জাহাজে করে সেইন নদী পারাপার হতো সে গুলো তদারকি করা। সেইন নদী প্যারিস শহরকে দ্বিধা বিভক্ত করেছে। অবিশাস্য হলেও সত্য যে, সেইন নদীর এই দ্বিধাবিভক্তি এই নগরীকে আরো আকর্ষনীয় করে তুলেছে। রাজা লুইসের সময় নদী পারাপারের জন্য বাতো বা জাহাজ ব্যবহার করলেও এখন তৈরী করা হয়েছে অসংখ্য ব্রীজ। উপর দিয়ে যেমন গাড়ি চলাচল করে তেমনি নদীর নীচ দিয়ে চলাচল করে ট্রেন ও মেট্রো। আর সেইন নদীর উপড় দিয়ে চলাচল করে বিলাস বহুল প্রমোদ তরী। আছে ভাসমান রেস্তোরাও।

১৮৩১ সালে আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান মোহামদ আলী ফ্রান্সকে একটি অবেলেস্কি উপহার দেন। ২২০ টনের এই অবেলিস্কিটি ১৮৩৬ সালের ২৫ শে অক্টোবর প্লাস দো লা কনকর্ডে বসানো হয়। অবেলিস্কির সারা গা জুড়ে লিখা অসংখ্য প্রাচীন মিশরীয় প্রতীক লিপি।
প্লাস দো লা কনকর্ড বর্তমানে দেশী বিদেশী ভিজিটরদের অন্যতম একটি পছন্দের স্থান। বছরে বেশ কয়েকবার মেলা বসে এখানে। সর্বশেষ ক্রিসমাস আর নববর্ষ উপলক্ষ্যে মাসব্যপী মেলা বসেছিল এখানে। আর সামারের ছুটিতে এলাকাটি হয়ে উঠে জন সাধারনের ভ্রমন ও বিশ্রামের স্থান। দলে দলে মানুষ ভীড় করেন এখানে। কেউবা সারাদিন ঘুরেফিরে কেউবা পার্কের বেঞ্চে একটু হেলান দিয়ে দিন কাটিয়ে দেন।
আবার বয়স্ক ফরাসিরা গ্রুপ বেধে আসেন পেতংক খেলতে। পেতংক খেলাটি অনেকটা আমাদের দেশের মার্বেল খেলার মতো। টেনিস বল আকৃতির ষ্টিলের বল দিয়ে মাটিতে ছোট ছোট গর্ত করে মার্বেল খেলার মতো করে খেলতে হয়। এ সময়টায় ছোট ছোট অনেক গ্রুপকে পার্কের এদিক ওদিক সারাদিন পেতং খেলতে দেখা যায়। প্লাস দো লা কনকর্ডে বিশাল আকৃতির একটি চরকি আছে ফরাসি ভাষায় যাকে লা রুল বলে। ভিজিটরদের পাশাপাশি পারীজিয়ানরাও এখানে আসেন বন্ধু বান্ধব, পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটাতে।

polashsl@yahoo.fr

02/04/10
Paris


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment