প্যারিসের চিঠি : প্যারিসের মেট্রো যেন এক গোলক ধাঁধার চক্কর
প্যারিসের মেট্রো নিয়ে কিছু না লিখলে প্যারিস নিয়ে লিখাটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। প্যারিসের অত্যাধুনিক আন্ডার গ্রাউন্ড মেট্রো যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিশ্ব বিখ্যাত। মাকোরশার জালের মতো বিস্তৃত পুরো প্যারিস শহরের আন্ডার গ্রাউন্ড যোগাযোগ ব্যাবস্থা। শহরটাকে আপনি একটি বক্স ভাবতে পারেন। বক্সের ভিতরটা যেমন ফাকা থাকে, নগরীর নিচটা তেমনি ফাকা। উপরে দালান কোঠা, গাড়ী চলাচলের জন্য প্রশস্ত সব রাস্তা, তেমনি মাটির নীচ দিয়ে চলে মেট্রো, ট্রেন। এই মেগাসিটির উপর দিয়ে যানবাহনের চাপ কমাতে মেট্রো ও আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। প্যারিসে মেট্রোর মোট ১৬টি লাইন এবং ৫ টি ট্রেন লাইন। ১৬টি মেট্রো, সিটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মাকরশার জালের মতো বিস্তৃত। অনেকটা গোলক ধাধা । মেট্রো গুলো শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলাচল করে। ট্রেন গুলো মুল শহর থেকে দূরে, রেজো পারীজিয়া পর্যন্ত চলাচল করে। এ ধরনের ট্রেন গুলোকে R.E.R বলে। ট্রেনগুলোর শহর অতিক্রমের জন্য আন্ডার গ্রাউন্ডের গভীরে বিশাল বিশাল ষ্টেশন তৈরী করা হয়েছে। প্রধান প্রধান ষ্টেশনগুলো ৭ –১০ তলা পর্যন্ত গভীর। এসব ষ্টেশন গুলোতে রয়েছে অত্যাধুনিক সব লিফট, সিড়ি,চলমান সিড়ি,মুভিং পথ।আর রয়েছে যাত্রীদের সহজ চলাচলের জন্য দিক নির্দেশিনা চিহ্ন। যাত্রীরা দিক নির্দেশনা অনুসরন করে সঠিক গন্তব্যের পথটি বের করে নিতে পারেন। এসব ষ্টেশনে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যোগাযোগের জন্য রয়েছে প্রসস্ত পাসাজ। পাসাজগুলো কখনো পায়ে হাটার পথ,কোথাও চলমান রাস্তা। বড় বড় ষ্টেশন গুলোতে রয়েছে একাধিক মেট্রোর সংযোগ। ষ্টেশনগুলোর প্রতিটি কোনায় সেট করা আছে অত্যাধুনিক ক্যামেরা,আছে বিশেষ ধরনের ইন্টারকম ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনি ষ্টেশনের ভিতর কোনো সমস্যায় পড়লে যেকোনো সময় মেট্রো অথোরিটির সাহায্য নিতে পারেন। বড় বড় ষ্টেশনগূলোতে আছে ফাষ্ট ফুড থেকে শুরু করে, ক্যাফে বার, তাবা, ফুল, পারফিউমের সপ, ষ্টুডিও, রেডিমেট কাপড়, জুতা, বিজু প্রভৃতি দোকান ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এখানকার বড় বড় মেট্রো ষ্টেশন গুলোতে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ লাখ যাত্রী পারাপার হয়।
সারা প্যারিসে ৩৭৫ টি আন্ডার গ্রাউন্ড মেট্রো ষ্টেশন আছে। রাস্তা দিয়ে আপনি যে দিকেই দুই মিনিট হাঁটবেন একটি মেট্রো ষ্টেশন পেয়ে যাবেন। প্রতিটি মেট্রোর প্রবেশ মুখ রাস্তার মুখ ঘেষে তৈরী করা। ২১ টি লাইনের করসপন্ডেন্স গুলো এতটাই জটিল যে স্বয়ং পারীজিয়ানরা হার হামেশাই ডিরেকশন ভূল করে থাকেন। ধরুন আপনি প্যারিস নর্দ থেকে আইফেল টাওয়ার দেখতে যাবেন। আপনাকে টোকাডেরো কিংবা বীর হাকিম ষ্টেশনে যেতে হবে। এজন্য আপনাকে ৬ বা ৯ নাম্বার মেট্রো ধরতে হবে। একবার মেট্রো চেঞ্জ করতে হবে। শুধু মেট্রো চেঞ্জ করলেই হবে না, প্রতিবারই আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে কোন ডিরেকশানে আপনি যাচ্ছেন। ডিরেকশন ভুল করলে আপনি পথ হারিয়ে ফেলবেন।
এখানে প্রতিটি করেসপনডেন্সেই আপনাকে আন্ডার গ্রাউন্ড দিয়ে অনেক খানি পথ হাটতে হবে।কোথাও সিড়ি, কোথাও চলমান সিড়ি,কোথাও আবার লিফট। যে ষ্টেশনগুলোতে ৩-৪ টি লাইনের করেসপনডেন্টস সে গুলোতে একটু পর পরই মেট্রো নাম্বার, ডিরেকশান, বোর্ডে পরবর্তী ষ্টেশন গুলোর নাম দেয়া থাকে। এতে করে যাত্রীরা সহজেই গন্তব্যে চলাচল করতে পারেন। চলাচলের পথগুলো এমন ভাবে করা জ্যাম লাগবেনা কোনো দিনও। প্যারিস নর্দ , লে হাল, গার দো লিওন, ছা লেজার, লা দে ফন্স, উবার, শাল দো গোল এতোয়াল, ন্যাশন, গার দো অস্টালেজ, বেরসি ষ্টেশন গুলো অত্যাধুনিক। পথচারীদের চলাচলের সুবিধা ও একটু বসে রেষ্ট নেয়ার জন্য এই ষ্টেশনগুলোতে লিফট, চলমান সিড়ি, যাত্রীদের বসার সুব্যবস্থা, ক্যাফে বার, স্নাক্সের দোকান, আছে রেডিমেট কাপড়ের দোকান, জুতার দোকান, অরনামেন্টসের দোকানও।
নগরীতে বড় বড় ৬ টি ষ্টেশন আছে যেখান থেকে আর্ন্তজাতিক ও ইন্টারসিটি ট্রেনগুলো চলাচল করে। প্যারিস নর্দ, প্যারিস ইষ্ট,গার দো লিওন, গার বেরসি, গার দো অষ্টালেজ ও মনপারনাস উল্লেখযোগ্য।
মেট্রোগুলো চলে ইলেকট্রিসিটিতে। চাকাগুলো বিচিত্র রকমের। কোনোটা টায়ারের চাকা, কোনটা আবার ট্রেনের চাকার মত। দরজাগুলো ইলেকট্রিক হাইড্রলিক প্রসারে খোলে এবং বন্ধ হয়। চালক আসনে বসেই সবকিছু কন্ট্রল করে থাকেন। বিদ্যুত ব্যবস্থা এতটাই অত্যাধুনিক যে, কোনো অবস্থাতেই এক মুহুর্তের জন্যে বিদ্যুৎ যাবার সম্ভবনা নেই। বায়ু চলাচল ব্যাবস্থাও আধুনিক।
১৪ নাম্বার লাইনের মেট্রোটি অত্যাধুনিক। ড্রাইভার বিহীন এই মেট্রো অত্যন্ত দ্রুত গতি সম্পন্ন এবং বেশ নীচ দিয়ে চলাচল করে। এর ষ্টেশন গুলোও বেশ আধুনিক। ফ্রান্স সরকার একবার প্রতিটি লাইনের মেট্রোকে ড্রাইভার বিহিন অটো করার পরিকল্পনা করেছিলেন , ষ্টেশনগুলো ক্লিনিংয়ের জন্য রোবট ব্যাবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতে করে অনেক দক্ষ লোক বেকার হওয়ার আশঙ্খায় এ পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন আপাতত।
প্যারিস শহরটি সেন নদী দ্বারা দ্বিধাবিভক্ত। এই নদীর নীচ দিয়েও মেট্রো,ট্রেন চলাচল করে।ট্রেন গুলো এক তলা,দ্বোতলা।
প্যারিসের মেট্রোর যে জিনিষটি প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে সেটি হলো রংবেরংয়ের চোখ ধাঁধানো সব পোষ্টার। প্রতিটি মেট্রো ষ্টেশনের দুই ধারের দেয়ালে দেখা যায় এই পোষ্টারগুলো। বিশ্বের নামী- দামী কোম্পানীগুলো প্রতিনিয়তই তাদের সামগ্রী নিয়ে হাজির হচ্ছে এই সব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে।
প্যারিসের মেট্রোর সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন আর এ টি পি নামের একটি সংস্থা। এদের রয়েছে নিজস্ব প্রশাসন,টেকনিশিয়ান, সিকিউরিটি বাহিনী, কন্টোলার, ক্লিনিং টিম ইত্যাদি।
প্যারিসের মেট্রো সবার কাছে এক গোলক ধাঁধা। বিদেশি পর্যটক,এমনকি ফরাসীরাও যারা দূরের কোনো প্রভিন্সে বসবাস করেন, একটি বারার জন্যে হলেও আসেন প্যারিসের মেট্রোতে ঘুড়ে বেড়াতে। প্যারিসের মেট্রো যেন এই স্বপ্নীল সিটিকে যেন আরো স্বপ্নময় করে তুলেছে। ঠিক পাশাপাশি এই এর সাবওয়েই অনেক ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়ের জায়গা এখন। এই ছিন্নমুলদের প্রায়ই এদিক ওদিক পায়চারী করতে দেখা যায় । এটা যেন কেমন এক বাস্তবতা।
১১।১১।০৯
polashsl@yahoo.fr