পচিঁশে ফেব্রুয়ারী- ঘটনা বিশ্লেষন
পচিঁশে ফেব্রুয়ারী। দেশে একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল। কাপুরুষ ঘাতকেরা কেড়ে নিলো একঝাক সোনালী সন্তান। ছেলে হাড়া মায়ের আহাজ়ারী দেখি, স্বামী হাড়া বধুর কান্না দেখি, পিতা হাড়া শিশুর অবুঝ মুখ দেখি। শোকের ভাষা নেই, সান্তনার ভাষা নেই। কে দেবে ফিরিয়ে স্নেহের সন্তান, ভালোবাসার মানুষ, অথবা মাথার উপর ছায়া দেওয়া পিতাকে? হাজারো মাইল দূরে থেকেও বুকের ভেতর বেদনা আর একটা চাপা ক্ষোভ অনুভব করি।
পচিঁশে ফেব্রুয়ারী ও এর পরবর্তী দুই-এক দিনে দেশ যখন ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক, তখন টেলিভিশন, পত্রিকা আর অনলাইনে কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তির তড়িৎ মনগড়া দ্বায়িত্বহীন ঘটনা বিশ্লেষন, সেনাবাহিনীর মুন্ডু উৎপাটন ইত্যাদি এদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ জাগায়। যারা ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে প্ররোচিত করে, বিভাজনের বিষ বপনের চেষ্টা করে, দেশ ও জাতির ‘শত্রু’ ছাড়া এদের আর কি পরিচয় হতে পারে?
সেনাবাহিনী উড়ে আসা কোন দানব নয়, সরকারের আর দশটা প্রতিষ্টানের মতো একটি প্রতিষ্টান যা দেশ প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এর সদস্যরা ভীন-গ্রহ হতে আসে না, দেশেরই সন্তান যারা ‘নিজ় জীবন উৎসর্গ করে হলেও মাতৃভুমি রক্ষা’র মহতী কাজে ব্রত। এই কাজটি নিষ্ঠা আর দক্ষতার সাথে পালন করার অপরাধেই বুঝি এই সোনার সন্তানদের অশুভ শক্তির হাতে প্রান দিতে হলো।
পচিঁশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র। এইধরনের ব্যাপক ও নির্মম ঘটনা ঘটানোর জন্য পুর্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন। পর্দার আড়াল থেকে এই পরিকল্পনার নিয়ন্ত্রনকারীরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুটা হলেও জ্ঞ্যান রাখে বলেই প্রতিয়মান হয়। সেই জ্ঞ্যান রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে আসতে পারে অথবা বহিঃরাষ্ট্র থেকেও আসতে পারে।
এতগুলো বিডিআর জওয়ানকে এই কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য শুধু অর্থের প্রলোভনই যথেষ্ট নয়। কারন, এইসব জওয়ানেরা এইরকম ত্রকটি ঘটনার সাথে জড়িত থাকার পরিণাম নিশ্চয় জানতো। তাহলে তাদেরকে কি এই ধটনার সাথে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করা হয়েছিলো? সেই সম্ভবনাও খতিয়ে দেখা দরকার। যদি তারা বাধ্য হয়ে থাকে তাহলে যে বা যারা তাদেরকে এই কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করেছে তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান বলতে হবে।
পচিঁশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা নিয়ন্ত্রনে সরকারের পদক্ষেপ ও ভুমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন আসছে। অনেকের মতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সময়ক্ষেপনের কারনে প্রানহানির সংখ্যা বেড়েছে ও ঘাতকেরা পালানোর সুযোগ পেয়েছে। এই মুহুর্তে কি করা যেত, কি করলে কি হতো তা বিতর্ক সাপেক্ষ। সময় ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যা উপযুক্ত মনে করেছে, সেভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেছে।
তবে ঘটনাকালিন ও পরবর্তীতে সরকার প্রধানের কিছু বক্তব্য অদুরদর্শীতার পরিচয় দেয়। সরকার প্রধান বল্ছেন- যারা ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল তাদের ক্ষমা করা হবেনা। শুধু সরাসরি কেন, যারা পর্দার আড়াল থেকে ঘটনার পরিকল্পনা, মদদ ও নিয়ন্ত্রন করেছে তাদের কি হবে? তারা কি ক্ষমা পেয়ে যাবে? রাষ্ট্রদোহিতার পর্যায়ে পরা এইরকম একটি কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কেউই ক্ষমা পাবার অধিকার রাখেনা। তাহলে সরকার প্রধান শুধু কেন সরাসরি জড়িতদের কথা বলছেন?
পচিঁশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা তদন্তে ইতমধ্যে কমিটি গঠন হয়েছে। আলামত সংগ্রহ, সরাসরি জড়িতদের সনাক্তকরণ ও জিজ্ঞাসাবাদ- গতানুগতিক তদন্তের এই প্রক্রিয়ায় ঘটনার উৎসে পৌছানোর সম্ভবনা ক্ষীণ। ঘটনার পরিকল্পনাকারীদের পরিকল্পনার সুক্ষতা ও দক্ষতা থেকে এটা অনুমেয় যে ঘটনার সাথে জড়িত বিডিআর জওয়ান ও তাদের মধ্যকার যোগসুত্র ধ্বংস ও নিশ্চিন্ন করার পরিকল্পনাও তাদের ছিলো।
এইধরনের ঘটনার তদন্তের একটি তত্ত্ব আছে, তা এইরকম- unless an incident is an accident, it will most often than not will have beneficiary/ies…… the benefit for the beneficiary/ies may or may not be apparent…… find the beneficiary/ies and you may find the cause and the culprit. এইরকম একটি ঘটনার মাধ্যমে কে বা কারা লাভোবান হতে পারে তাও তদন্ত করে দেখা দরকার।
পচিঁশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পরিকল্পনাকারীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট- সেনাবাহিনীকে একটি বিরুদ্ধ দল হিসাবে ভাবমুর্তি দেওয়া, সেনাবাহিনীর উপর কালিমা লেপন, সেনাবাহিনীকে হেয় করা এবং সর্বোপরি এইসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দূর্বল করে অশুভ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিল করা। এইধরনের প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয়। ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নামধারী একটি দলকে কাজে লাগিয়ে এই রকম একটি প্রচেষ্টা আমরা খুব নিকট অতীতেই দেখেছি। এই দুটি ঘটনার বেশ কিছু সামঞ্জস্যও আছে।
সমসাময়িক সময়ে বিশেষ ব্যাক্তিবর্গকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষেদাগারে বিশেষ তৎপর দেখা। এই ধরনের অসাবধান ও অদুরদর্শী বক্তব্য অনেক সময় অজ্ঞ্যাতেই অশুভ শক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের পথকে সহজ করে। হাভার্ড রিভিউয়ে সরকার প্রধানের এক উপদেষ্ঠার একটি লেখা পরে এইধরনের অসাবধানতা ও অদুরদর্শীতা চোখে পরে। বিশেষ তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়াই তার লেখায় ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইসলামী জঙ্গীতে ভরে যাচ্ছে’ এধরনের একটি আভাস ছিল। এরূপ বক্তব্য দেশের ভাবমুর্তির কতটা উন্নতি বা ক্ষতি সাধন করে তা ভাবা দরকার। দেশ ও সমাজের প্রতিনিধিদের তাদের বক্তব্য ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
পচিঁশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, পর্দার আড়াল থেকে ঘটনার পরিকল্পনা, মদদ ও নিয়ন্ত্রনকারী শক্তি- সকলকে দ্রুততার সাথে খুজে বের করা প্রয়োজন। দাবার ঘুটি থেকে দাবাড়ুদের খুজে বের করাটা এসময়ে বেশী জরুরী। তা নাহলে ঘুটি বদলে এই দাবাড়ুরা শীঘ্রই নতুন খেলায় নেমে পড়বে। কুঠির ষড়যন্ত্রকারীদের সমুলে বিনাশ করতে না পারলে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী…’ গানটিকে ‘একুশে’ বাদ দিয়ে হয়তো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারী…’ গেতে হবে, তবে গানটি তখন স্মৃতিমূলক থাকবে না, বাংলাদেশ নামক দুঃখী দেশটির মানুষের নিত্যজ়ীবনের গান হয়ে থাকবে।
[শাওন খান, মার্চ ২০০৯। E: shawon@gmx.com]