ক্যানবেরার খেরোখাতা ৫

ক্যানবেরার খেরোখাতা ৫

১.
ক্যানবেরার খেরোখাতা সিরিজটা যখন লেখা শুরু করেছিলাম তখন ইচ্ছে ছিলো সপ্তাহে অন্তত একটি হলেও লিখবো। কিন্তু লেখা আর হয়ে উঠে না। ক্যালেন্ডার ঘেঁটে দেখলাম সেই ৭ ই মে শেষ লিখেছিলাম। জীবনের ব্যস্ততা – স্বসৃস্ট নানাবিধ ঝামেলা লিখতে বাধা দেয়। মাঝে মাঝে মনে হয় অলসতা রোগে আক্রান্ত।

২.
হাঁটি হাঁটি পা করে শেষ মেশ শীত এসেই গেলো ক্যানবেরায়। হাঁড় কাঁপানো শীতের জন্য ক্যানবেরা কুখ্যাত। প্রতিদিন রুটিন করে দেখছি তাপমাত্রা কত নামলো। আজ সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি নামবে শুনেই কাঁপছি যদিও ঘরে হিটার চলছে। গতকাল সকালে অফিসে যাবার সময় কুয়াশা দেখে সেই রকম নস্টালকজিক হয়ে পড়েছিলাম। বার বার দেশের কথা মনে পড়ছিলো। শীতে গ্রামের বাড়ী যখন যাওয়া হতো তখন খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহানো বা শীতের পিঠা এই বুশ ক্যাপিটালে পাওয়া হবে না বলে মনটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো শীতের পিঠা খাওয়া হবে কিন্তু মায়ের হাতের স্পর্শ পাওয়া হবে না। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে দেশে চলে যাই, ভাল্লাগে না আর এই স্বেচ্ছা নির্বাসন।

৩.
গত শনিবার এক ঝটিকা সফরে সিডনী যেতে হয়েছিলো। বরাবরের মতো খুব সকালে উঠে যাত্রা, আবার তাড়াহুড়ো করে সন্ধ্যার নীড়ে ফেরা। বউয়ের ছোট্ট একটা পরীক্ষা ছিলো ইউ. এন. এস.ডব্লিও তে। জাফর ইকবাল স্যারের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম, উনি পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই নাকি কোন বন্ধু বা আত্মীয়ের সন্ধান পেয়েছেন। আমারো মনে হয় সে ভাগ্য রয়েছে। বউ পরিক্ষ্যায় ব্যস্ত, আমি বাহিরে হাঁটছি, ভাবছি কি করা যায়। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমারই এক নেপালী সহপাঠীর সাথে। অনেক বছর পর দেখা। খালেদা থেকে ফখরু এসেছে ক্ষমতায়, ওয়াসার পানি অনেক গড়িয়েছে , বন্ধুর নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু সহপাঠিকে চিনতে ভুল হয়নি। রাজ্যের কথা ওর সাথে। কে কোথায় আছে, কার কটা বাচ্চা, কার চুল পেকে গিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভিয়েতনামি এক রেস্টুরেন্টে পেটপূজো সেরে সামান্য কেনাকাটা। আমার বউ বলে আমি নাকি গ্রোসারী শপিং ছাড়া অন্য কিছু করতে উৎসাহী নই। কথা সত্য। মেয়েদের সাথে যারা শপিং এ গিয়েছে তারা ছাড়া আর কেউ এর কস্ট বুঝতে পারবে না। দু ঘন্টা ঘোরাঘুরি করে কোনো কিছু কেনাকাটা না করতে একমাত্র মেয়েরাই পারে।

৪.
পথ চলতিতে আমরা অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করি। অনুভূতিশুন্য রোবটের মতো আচরন করি। একজন অসহায় মানুষ হয়তো চিৎকার করে কাঁদছে, এক পলক তাকিয়ে পরমুহুর্তেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি নিজের নিজের কাজে, হিসেব করতে থাকি বাজারের ফর্দ।
পাশের বাড়ী বার্মায় নার্গিসের তান্ডবের রেশ না কাটতেই চীনের ভুমিকম্প। টিভির খবরে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ দেখে নিজেকে সেই অনুভূতিশুন্য রোবটের মতোই মনে হয়। দেখছি, পরমুহুর্তেই ভুলে যাচ্ছি।

৫.
গতকাল এখানে ন্যাশনাল স্যরি ডে পালন করা হলো। শত শত বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের প্রতি অন্যায় – অবিচারের ক্ষত হয়তো একদিনের দূঃখপ্রকাশে দূর হয়ে যাবে না কিন্তু এটা সামান্য হলেও সেই ক্ষতে একটু ভালোবাসার পরশ বয়ে দেয়। ছোট্ট বেলার কথা মনে পরছে। উত্তর বংগের যে অংশে আমার বাড়ী সেই অংশে ১৫/২০ বছর আগেও ধান কাটার মৌসুমে দল বেঁধে আসা সাঁওতাল দেখতে পেতাম। গ্রামের বাড়ীর পাশে ছিলো মান্দাইদের সাজানো গোছানো ছোট্ট কুঁড়ে ঘর। আজ তার অনেকটুকুই নেই। সাঁওতালদের ঢাকের শব্দ আর কানে আসে না, মান্দাইদের পুজোর আনন্দ চোখে পরে না। বাংলার এই আদিবাসিরা নিরবে পরবাসী হলেও, এ চলে যাবার পেছনে আছে করুন ইতিহাস, যে ইতিহাস কেউ জানবে না। জানতেও চাইবে না। ক্যাঙারু দেশ থেকে স্যরি বলছি , আমার পুর্বপুরুষদের পক্ষ থেকে ভুমিপুত্রদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment