বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবনা – অমিত আহমেদ
কালেভদ্রে ইন্টারনেটে ক্রিকেট ফোরামগুলোতে ঢুঁ মেরে দেখি। এম্নিতেই। কে কি বললো, নতুন কি ঘটলো, কে সেঞ্চুরি মারলো – এসব মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে। এসব ফোরামে অনেকটা মজা করেই অনেকে “বাংলাদেশ” প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। সেগুলো পড়তে গিয়ে আমার সবসময়ই কান লাল হয়ে যায়। বাংলাদেশ নিয়ে দুই ধরণের মন্তব্য হয়। খুব অপমানজনক, কিংবা বড়ভাই সুলভ। দু’টোই অসহ্য। যারা অপমান করতে চান তাদের খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। বাংলাদেশের শোচনীয় হারের অভাব নেই। সেগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নোংরা ভাবে বলা হয়। বলা হয় “বাংলাদেশকে টেস্ট-স্ট্যাটাস দেয়া উচিত হয়নি। এক্ষুণি সেটা কেড়ে নেয়া হোক।” বড়ভাইয়েরা আবার একটা “আরে, হবে হবে” ধরণের ভাব নেন। শ্রীলংকার উত্থানের উদাহরণ দিয়ে বলেন “গরীব দেশ, নতুন দল, একটু সময় লাগবে।”
এই যে কদ্দিন আগে আমাদের কিছু খেলোয়াড় আইসিএল-এ চলে গেলো এই নিয়ে সব ক্রিকেট ফোরামেই বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। তাদের সবার প্রায় একই রকম কথা “গেছে ভালো হয়েছে। এমনিতেই বা কি হাতি ঘোড়া মারছিলো?” অনেকে আবার একধাপ এগিয়ে এসে বলে “বাংলাদেশের মতো জঘন্য দলের টেস্ট-স্ট্যাটাস কেড়ে নেবার এই মোক্ষম সুযোগ!” আমি দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে যাই।
ওরা যে জিনিসটি মাথায় রাখেন না সেটি হলো “আমাদের সুযোগের অভাব।” বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগটা পাচ্ছে কই? আইসিসি নির্ধারিত বাৎসরিক বাধ্যতামূলক খেলাগুলো বাদে ভালো দলের সাথে বাংলাদেশের খেলার সুযোগই হয় না। কেউ খেলতে চায় না। তাদের কথা বাংলাদেশের সাথে খেললে স্পনসর পাওয়া যায় না। টিকেট বিক্রি হয় না। টিভিতে কমার্শিয়াল আসে না। খেলাতেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না।
তা এসব তো কোনো নতুন কথা নয়। একটি নতুন দল আসলে অভিজ্ঞতার অভাবে এমন হবেই। সময়ের সাথে সাথে দল ঋদ্ধ হবে। ফ্যান বাড়বে। আর সেই সাথে সাথে বাড়বে ব্যবসায়িক আগ্রহ। সেই সুযোগই তো আমরা পাচ্ছি না।
হ্যাঁ, সুযোগ দিতে পারতো ভারত, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলংকা। কিন্তু সেই সুযোগ এই নবাবের বাচ্চারা আমাদের দেবে না। এক পাকিস্তান বাধ্য হয়েই ("নিরাপত্তা সন্তোষজনক নয়" অভিযোগে অন্য দেশ প্রায়শই সিরিজ বয়কট করে) আমাদের সাথে আইসিসি তালিকা বহির্ভূত খেলা বেশি খেলেছে। শ্রীলংকা তাও আইসিসির তালিকা ধরে খেলাগুলো শেষ করে, ভারত তাও করে না। ভারতের কাছ থেকে অনেকদিন থেকেই আমাদের আমন্ত্রণ পাওনা হয়ে আছে, তা তারা নানান অজুহাতে কেবলই এড়িয়ে যাচ্ছে।
এসব কারণে এমনও হয়েছে যে এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ নেই! এই সমস্যা সহজে মিটবে না। কারণ বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড সিরিজে বাংলাদেশ নিয়ে সবার উন্নাসিকতা প্রকাশ পেয়ে গেছে। আমাদের খেলার টিভিস্বত্ত কিনেছিলো ভারতীয় সংস্থা নিম্বাস । ওরা বলে দিয়েছে লাভ হয়না বলে বাংলাদেশের খেলা ওরা সম্প্রচার করবে না। করতে বাধ্য নয়। আইসিসির টিভি ক্যামেরা নিয়ে কিছু নিয়ম ঠিক করে দেয়া আছে। সেই মেনে ওরা টিভি ক্যামেরা অবশ্য দিচ্ছে, মোট বারোটি। যেখানে একটি সাধারণ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ছাব্বিশ কিংবা তার বেশি টিভি ক্যামেরা দেয়া হয়।
ক’দিন আগে শুনলাম চ্যানেল আই নাকি নিম্বাসের কাছ থেকে মাত্র পনেরো হাজার ডলারে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড সিরিজের সম্প্রচার-স্বত্ত কিনে নিয়েছে। কাল শুনি সে পরিকল্পনায় নাকি বাগড়া দিয়েছে বিটিভি। তারা বলে বিটিভি ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো চ্যানেল খেলা সম্প্রচার করতে পারবে না! এসব ঝামেলায় সমস্যা হয়েছে আমাদের, প্রবাসীদের। আন্তর্জাতিক কোনো টিভি চ্যানেলে খেলা সম্প্রচার হয়নি বলে আমরা খেলা দেখতে পারিনি। সারাক্ষণ ক্রিকইনফোর পাতা খুলে বসে থাকতে হয়েছে।
স
ব হিসেব করে যা বুঝলাম এই সিরিজ আয়োজন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিশাল পরিমান টাকা জলে চলে যাবে। শুধু খেলার টিকেট বেচে লগ্নি করা টাকা উঠে আসবে না। এভাবে লস দিয়ে নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজনের ক্ষমতা বিসিবি-র নেই বলেই মনে হয়।
আমাদের দেশে ক্রিকেট প্রতিভার অভাব আছে তা আমি বিশ্বাস করি না। নতুন যারা আসে, বয়স যতই কম হোক, তাদের সবার হাতে অসংখ্য শট। দুর্দান্ত বোলিং অ্যাকশন। আমি সবসময়ই মুগ্ধ হই। তবে সমস্যা হলো তারা সময় মতো পারফর্ম করতে পারে না। করলে যে ম্যাচ জেতা কোনো ব্যাপারই না তার প্রমান গতকালের ম্যাচ । অনেকে বলে আমাদের খেলোয়াড়দের দেশপ্রেম নেই। একদম রদ্দি কথা! সমস্যা দেশপ্রেমের নয়। প্রতিভারও নয়। সমস্যা হলো পেশাদারিত্বের। আর এই পেশাদারিত্ব নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেললে কখনোই আসবে না।
সেটি যখন সম্ভব হচ্ছে না তখন আমরা কয়েকটি বিকল্প দেখতে পারি –
১) কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ডের সাথে নিয়মিত হোম-অ্যাওয়ে সিরিজ চালু করা। এই তিন দেশের এতে আপত্তি হবে বলে আমার মনে হয় না।
২) ঘরোয়া লীগকে শক্তিশালী করতে হবে। কেনিয়া আর আয়ারল্যান্ডের একটি-দুটি করে দল আমাদের ঘরোয়া লীগে খেললে দুর্দান্ত একটি জিনিস হবে।
৩) বয়সভিত্তিক লীগ জোরদার করা। এতে ছোট বয়স থেকেই পেশাদারিত্বের তালিম হবে।
এসব করেও হয়তো আইভিলীগের স্বাদ অনাস্বাদিতই থেকে যাবে। তবু ওদের শ্রদ্ধা আদায় করে না নেয়া পর্যন্ত এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখি না।
© অমিত আহমেদ | original post