ছেলেবেলার ঈদ, ওয়াসিম খান পলাশ প্যারিস থেকে
সাহিত্যের গভীরতায় আমি যেতে পারিনি কোন দিন। এখনো না। কোন গল্প লিখতে গেলে তালগোল পাকিয়ে ফেলি। কল্পনার প্রখরতা একদকম নেই। তাই সমসাময়িক কোন ঘটনা বা ঘটে যাওয়া কোন ঘটনাকেই আমার লিখায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি।
ঈদের স্মৃতি চারন করতে গিয়ে সেই ছোট্ট বেলার ঈদ গুলোকেই মনে পড়ছে বার বার। খুব মিস করছি সেই দিন গুলো। আবেগে হদয় স্পন্দন থেমে আসে বারবার। চোখের জল থামাতে পারছি না। আজ ঈদের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে শিশুকাল ও কৈশোরের ঈদ গুলোকেই জ়ীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদ মনে হয় আমার কাছে। যখন যুবক হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পদচারনা শুরু করলাম শৈশব ও কিশোর বেলার ঈদের আবেদনগুলো যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলো অনুভব করলাম।। আর এখন………..।
আমার জন্ম ঢাকাতে। ঢাকার বাসাবোতে। বাসাবো এলাকাটি হলো বর্তমান সবুজবাগ থানার অন্তর্গত। বাবা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊধ্বতন কর্মকর্তা। আর আমি ছিলাম বাবা – মায়ের খুব আদুরের বড় সন্তান।
রোজা শুরু হতেই ঈদের আমেজ শুরু হয়ে যেত। মায়ের কাছে আবদার, আমাকে কিন্তু এবার সুন্দর প্যান্ট শার্ট, জুতো কিনে দিতে হবে। স্কুলের বন্ধুদের সবার ভিতর থাকতো একটা অন্য রকম আমেজ। সবাই সবার বাবা মায়ের কাছে করত একই আবদার। মহল্লার প্রতিবেশী বন্ধুরা প্রতিদিন বিকেলে জড়ো হতাম কে কি কিনল, কে কি কিনবে জানার জন্যে। কেউবা রেডিমেট দোকান থেকে প্যান্ট – শার্ট কিনতাম আবার কেউবা বাবার সাথে দর্জির দোকানে গিয়ে শার্ট প্যান্টের মাপ নিয়ে পছন্দের কাপড়টি কিনে আনত। জুতা কিনতে চলে যেতাম আলিফ্যান্ট রোড, নিঊ মার্কেট বা রমনা ভবনে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিলো, ঈদের পোষাক কিনেই লুকিয়ে রাখতাম যেন কেউ না দেখতে পারে। দেখে ফেললেই পুরনো হয়ে যাবে, ঈদের দিন আর সারপ্রাইজ দেয়া যাবে না এই ভেবে। আবার কাপড় কিনে শার্ট প্যান্ট বানালে দর্জির কাছ থেকে কাপড়ের একটু অংশ কেটে রাখতাম। কাপড়ের টুকরো গুলো খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতাম যাতে বন্ধুরা দেখে না ফেলে।
ঈদ ঊপলক্ষ্যে কিছুদিন বেশ ঘুরা হতো মার্কেটে মার্কেটে। এলিফ্যান্ট রোড, নিঊ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, রমনা ভবন, মৌচাক মার্কেট, বাদ যেত না কোনটাই। বাবা সময় পেতেন না বলে, মাকে নিয়েই মার্কেটিংয়ে যেতে হতো। যতই ঈদের দিন এগুতে থাকতো – মার্কেটে, রাস্তা ঘাটে মানুষের ভিড় ততই বাড়তে থাকত। চারিদিকে খুশির এক আমেজ। মার্কেটে নতুন নতুন পোষাকের সমারহ। আমার খুব ভাল লাগত ভিড়ের চাপাচাপিতে মার্কেটে ঘুরে বেড়াতে। মা বাইরে বেরুনোর আগেই সাবধান করে দিতেন যেন ভিড়ের ভিতর মায়ের হাত না ছাড়ি, এদিক ওদিক ছুটা ছুটি না করি। ঈদের সময় ছেলেধরারা মার্কেটে ঘুরে বেড়ায়। ওরা দুষ্টু ছেলেদের ধরে নিয়ে রক্ত নিয়ে যায়। রক্ত চোষার ভয়ে মায়ের হাত একদম ছাড়তাম না আমি। তবে মার্কি টিংয়ের এক ফাকে স্ন্যাক্সের দোকানে যেতে ভুলতাম না কোন দিনও। প্যাটিস, পেষ্ট্রি আর লাচ্ছি ছিল আমার প্রিয় খাবার। তবে বায়তুল মোকারামের হাতে বানানো লাচ্ছি আমার খুবই প্রিয় ছিল।
ঈদের কেনাকাটা করে বাসায় ফিরতে খুব ভাল লাগতো। সহ পাঠি বন্ধুদের কথা মনে পড়তো, ওরা কি কিনল। বাড়ি ফেরার পথে মাকে বলে দিতাম, মা এটা এমন জায়গায় রাখবা যাতে কেঊ দেখে না ফেলে।
ঈদের ঠিক আগের দিন খুব মজা হতো। সন্ধ্যা বেলায় বাড়ির ছাদে চলে যেতাম ঈদের চাদ দেখবো বলে। ঈদের চাদ দেখা মাত্রই সারা মহল্লায় হৈচৈ পড়ে যেত। ছাদে দাড়িয়ে ঈদের চাদ দেখতাম। কাল ঈদ। চাদ দেখার পর মা টি.ভি অন করে দিতো। ততক্ষনে ঈদের গান শুরু হয়ে গেছে টি.ভি তে। বাবা অপেক্ষা করতেন টি.ভি নিউজের জন্য। অনেক সময় ঈদের চাদ ঈদের চাদ দেখা যেত না। খুব টেনশন লাগত তখন। কাল বুঝি ঈদ হচ্ছে না। অপেক্ষা করতে হতো রেডিও টি.ভির ঘোষনার জন্য। সেদিন খুব মনযোগ দিয়ে শুনতাম রেডিও – টি.ভি নিউজ।
আমার বাবা সবসময় বায়তুল মোকারাম মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তেন। মাঝে মধ্যে জ়াতীয় ঈদ্গাহে। আমাকেও বাবার সাথে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে হত। ঈদের দিন সকালে ৬টা – ৭টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে যেতাম। মা আগেই গরম পানির ব্যাবস্থা করে রাখতো। গোসল সেরে পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট আর টুপি পড়ে নিতাম। মা আতর লাগিয়ে দিতো। এর পর মিষ্টি মুখ করে যায়নামাজ নিয়ে ছুটতাম নামাজ পড়তে।
ঢাকা শহরের ঈদের সকালটি অন্য রকম লাগতো আমার কাছে। ঈদের দুদিন আগ থেকেই ঢাকার লোকচলাচল কমে যেত। অধিকাংশই গ্রামের বাড়িতে চলে যায় ঈদ করতে। ঈদের ছুটিই গ্রামে পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার একমাত্র সুযোগ। এ সময়টায় ঢাকাকে এক নিরব নগরী মনে হয় আমার কাছে। খুবই ছিমছাম, থাকে না কোন যানজট, কোন কোলাহ্ল। খাবারের রেষ্টূরেন্ট গুলো ছাড়া অন্য সব মার্কেট,দোকান পাট বন্ধ থাকে কয়েকদিন। ঢাকাবাসীর বিনোদনের জন্য বেশ ব্যাবস্থা আছে এই সময়টায়। শিশু – কিশোর- যুবকরা দলবলে ছুটে আসেন চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, সরোওয়ার্দী উদ্যান, সংসদ ভবন, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেনে। এছাড়া মিরপুর, কমলাপুর, মালিবাগ ও শহরের বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী মেলা বসে এই সময়টায়।
সাধারনত বায়তুল মোকারমে জ়াতীয় ক্রীড়া পরিষধের গেট দিয়েই প্রবেশ করতাম। উল্লেখ্য , পরবর্তীকালে জ়াতীয় ক্রীড়া পরিষধ আমার জীবনের একটি অংশ হয়ে গিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমি খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলাম। জাতীয় ও আন্তজাতিক পর্যায়ে খেলাধুলা করেছি। তাই নিয়মিত ক্রীড়া পরিষধে আসা যাওয়া ছিল। নিয়মিত আড্ডা দিতাম ক্রীড়া পরিষদে।
নামাজ শেষ করে বাবার পা ছূয়ে সালাম করতাম, কোলাকোলি করতাম। খুব খারাপ লাগত যখন রাস্তায় হাত পা কাটা পঙ্গু ভিক্ষুকরা হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইতো। মনে হতো ওরা যদি আমাদের মতো ঈদ করতে পারতো তা হলে কতই না মজা হতো। ফেরার পথে বাবা আমাকে বেলুন কিনে দিতেন। বাসায় ফিরেই মাকে সালাম করতাম। মা সালামি দিতেন।
এরই মধ্যে পাড়ার বন্ধুরাও বাসায় হাজির হতো। সবার পরনে নতুন নতুন রংবেরংয়ের শার্ট, প্যান্ট, জুতো। মা সবাইকে খাবার পরিবেশন করতেন। বন্ধুরা সবাই বেরিয়ে পরতাম বেড়াতে। ঈদের দিন প্রায় সব বন্ধুর সাথেই দেখা হতো। আড্ডা, হৈচৈ করেই কাটিয়ে দিতাম আমরা।
আমরা ঈদের দিনই প্লান করতাম পরের দিন কি করবো কোথায় যাবো। শিশু পার্ক, মিরপুর চিড়িয়াখানা নাকি নাকি অন্য কোথাও।
সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফিরতাম। বাসায় ফিরে দেখতাম বাবার বন্ধুরা বা কোন প্রতিবেশী খালাম্মা বেড়াতে এসেছেন। মা – বাবা আতিথেওতায় ব্যাস্ত। আমি চুপ করে টি.ভির সামনে গিয়ে বসতাম। ভাবনায় চলে যেতাম অনেক দূর।
২০-০৯-০৮ প্যারিস Polashsl@yahoo.fr