যে রোগে শিশু পড়তে চায় না ডিসলেক্সিয়া বা অক্ষর অন্ধত্ব
যারা হিন্দি সিনেমার খবর রাখেন তারা হয়তো রিসেন্টলি রিলিজ হওয়া আমির খানের মুভিটি দেখেছেন। হ্যা, আমি তারে জামিন পার মুভিটির কথা বলছি। ডিসলেক্সিয়া বা অক্ষর অন্ধত্ব রোগটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ মুভির কাহিনী। আমাদের দেশে অনেক শিশু এ রোগে ভুগে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগটি নির্ণয় করা বেশ কঠিন। মজার কথা হলো, এ রোগের চিকিৎসায় কোনো ওষুধেরও প্রয়োজন নেই। অদ্ভুত এ রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে আজকের লেখায়।
ডিসলেক্সিয়া কি
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ নিউরোলজিস্টের মতে, এটা শিশুদের একটা সমস্যা যেখানে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ঠিক থাকা সত্ত্বেও তারা কোনো কিছু লেখা বা পড়ায় সমবয়সী অন্য শিশুদের মতো সক্ষম হয় না। কোনো কিছু বানান করে পড়তেও তারা দুর্বলতা প্রকাশ করে। ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করালেও এরা পড়াশোনায় পিছিয়ে যায়। অথচ বুদ্ধির দিক থেকে এদের কোনো ঘাটতি থাকে না।
আমরা যেটা দেখি তার আকার-আকৃতি ব্রেইনে স্থায়ীভাবে গেথে যায়। সে কারণে চারপাশের জিনিসগুলো আলাদাভাবে চিনতে পারি। কাউকে না দেখেও শুধু তার কথা শুনে বলে দিতে পারি সেটা কার কণ্ঠ। কিন্তু ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ব্রেইন এ ধরনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বর্ণমালার অক্ষরগুলো ঠিকমতো চিনতে পারে না বা উল্টা-পাল্টা দেখে। এমনকি ক্লাসে বসে শত চেষ্টা সত্ত্বেও স্যারের লেকচার ঠিকমতো বুঝতে পারে না। যার কারণে এরা পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ে। একসময় পরিবার তথা শিক্ষকদের রোষানলে পড়ে। ফলে তারা নিজেদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। যেহেতু সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে এ রোগ সারা জীবন থাকে, তাই বড় হলে এসব রোগী বিষণ্নতায় ভোগে। এদের মধ্যে প্রচণ্ড স্কুল-ভীতি কাজ করে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এসব রোগীর না আছে কোনো চোখে সমস্যা, না আছে কোনো কানে সমস্যা। এদের ব্রেইনে কোনো সমস্যা থাকে না, মানসিকভাবে এরা বিকারগ্রস্ত থাকে না।
ডিসলেক্সিয়ার কারণ ও ধরন
ক্স আঘাতজনিত ডিসলেক্সিয়া : আমাদের ব্রেইনে একটি নির্দিষ্ট স্থান থাকে যেটি পড়ালেখার ক্ষমতা কন্ট্রোল করে। শিশু জন্মের সময় অথবা অন্য কোনো কারণে ব্রইনের ওই স্থানে আঘাত পেলে ডিসলেক্সিয়া হতে পারে। তবে আধুনিক যুগে এ ধরনের ডিসলেক্সিয়া খুব একটা দেখা যায় না।
প্রাথমিক ডিসলেক্সিয়া : প্রাইমারি বা প্রাথমিক ডিসলেক্সিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্রেইনের বাম দিকের একটি অংশ কোনো কারণ ছাড়াই ঠিকভাবে কাজ করে না। বয়স বাড়লেও ব্রেইনের ওই অংশ ঠিকভাবে কাজ করে না। ফলে বড় হয়েও এরা ঠিকমতো লিখতে, পড়তে ও বলতে পারে না। এ সমস্যা বংশ পরম্পরায় ছড়াতে পারে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।
সেকেন্ডারি বা জন্মগত ডিসলেক্সিয়া : শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় হরমোনগত কারণে এ সমস্যা হতে পারে। শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এ ধরনের সমস্যা ছেলেদের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে।
ডিসলেক্সিয়ার উপসর্গ : ক্লাসের শিক্ষক কিংবা মা-বাবা রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরতে পারেন না। তবে মানসিক বিশেষজ্ঞ কিংবা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগটি সহজেই নির্ণয় করতে পারেন।
বইয়ের পাতার অক্ষরগুলো শিশু সাধারণত উল্টা-পাল্টা দেখে। সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত তার এ সমস্যা থাকতে পারে। এরা স্কুলে বোর্ড দেখে দেখে খাতায় লিখতে খুব অসুবিধা অনুভব করে। শিশু পছন্দের গল্পটিও গুছিয়ে বলার ক্ষমতা হারায়। খেলাধুলা করতেও এরা আনাড়িপনা দেখিয়ে থাকে। সব শিশুই ডান কিংবা বাম হাতে শক্তিশালী হলেও এরা দুই হাতে মোটামুটি সমান শক্তি প্রকাশ করে থাকে। কোনো কিছুর সঙ্গে এরা তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। এমনকি মিউজিকের তালেও এরা শরীর দোলাতে পারে না। font>
কানে তেমন সমস্যা না থাকলেও এরা কোনো কিছু শুনে মনে রাখতে পারে না। একটি প্রশ্ন করলে অনেক সময় উত্তর করতে সমর্থ হলেও এক সঙ্গে অনেক প্রশ্ন করলে এরা কোনোটিরই উত্তর দিতে পারে না। একটি বাক্য বলার সময় মাঝের কিছু শব্দ তারা ভুলে যায় অথবা হারিয়ে ফেলে। ফলে বাক্যের অর্থ এমন হয়ে যায় যে, অনেকের কাছে তা হাস্যকর মনে হয়। তারা জানে তারা কি বলতে চাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করে ফেলে ভিন্ন কিছু। আস্তে আস্তে এরা বিষণ্ন হয়ে পড়ে। সহপাঠীদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে নো। একসময় স্কুল যেতেও ভয় পায়।
মা-বাবার করণীয়
শিশুর এ সমস্যা কাটাতে মা-বাবার ভূমিকাই প্রধান। প্রথমে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন। প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়ে স্কুল শিক্ষকের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। ভালো সাহায্য পেতে পারেন একজন আইকিয়াট্রিস্টের কাছেও। শিশুকে তার ব্যর্থতার জন্য কোনোভাবেই গালমন্দ কিংবা মারধর করবেন না। প্রাইভেট টিউটর বদলে নয়, শিশুর প্রতি আপনার সহমর্মিতা বাড়িয়ে দিন।
চিকিৎসা
চিকিৎসার জন্য মা-বা ও শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। শিশুর আশপাশের লোকজনের সহানুভূতিশীল হওয়া জরুরি। এদের অল্প অল্প করে পড়তে দিতে হবে। হোমওয়ার্ক একটানা না করে কিছুটা বিরতি দিয়ে করানো উচিত। একটানা ক্লাস না নিয়ে বিরতি দিয়ে ক্লাস করতে হবে। পড়ালেখার জন্য সম্ভব হলে কমপিউটারের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তবে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিলে খুব ভালো হয়।
পৃথিবীতে সব শিশুই সমান ব্রেইন কিংবা মেধা নিয়ে আসে। এরপরও সে-ই ভালো ছাত্র হয় যে বেশি চর্চা করে। কিন্তু ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশু চর্চা করার ক্ষমতা হারায়। এ ধরনের শিশুদের গরু কিংবা গাধা বলে গালি দিয়ে কি লাভ। এতে এসব প্রাণী খুশি হয় কি না জানি না, তবে তারা সুস্থ হওয়ার শেষ সম্ভাবনাটাও হারিয়ে ফেলে। তাই আসুন এদের প্রতি সদয় হই, গড়ে তুলি মেধাবী প্রজন্ম।
ডা. সাকলায়েন রাসেল saklayendmc@gmail.com | original source