বাঙালি একটি উপলব্ধি
ফেসবুকের দুটি পোষ্ট আমার এ লেখার অনুপ্রেরণা। জানিনা আমি বাঙালি বলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে চাইছি কিনা। তবে এ যৌক্তিকতা প্রমাণ আমরা সামান্য অনুসন্ধানের ফসল।
আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা জাতি হিসেবে বাঙালি । কারণ ১৯৫২ সালে এই বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু রাষ্ট্রভাষা করবার অপপ্রয়াস থেকে প্রথমবার বাঙালি চেতনার গভীরতা পায়। সেই থেকেই বাঙালি নিজেকে চিনতে শুরু করে। আর বুঝতে পারে এই চেতনা ধারণ করবার জন্য সে কিভাবে নির্যাতিত ও বৈষম্যর স্বীকার। এই চেতনা যতই প্রখর ও গভীর হতে থাকে ততই স্বাধীনতার দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এই চেতনার চুড়ান্ত আত্মপ্রকাশ।
বাঙালি চেতনা কি কেবল বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে? আমার উওর হল না- কেবল ভাষা চেতনাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বাঙালি চেতনা ছিল না। এ চেতনার মাঝে বৈষম্য ও নির্যাতনের ইতিহাস জড়িত। বাংলাদেশ ভুখন্ডে আমরা যারা জম্মেিেছ তারা সবাই মিলেই আমরা বাঙালি চেতনাকে নির্মাণ করেছি। বাংলাদেশে বসবাস ও জম্ম নেওয়ার কারণে আমরা তৎকালীন অবাঙালি পাকিস্তানীদের হাতে নির্যাতিত ও বৈষম্যর স্বীকার হয়েছি। সেদিন কেঊ চাকমা, মারমা, গারো কিংবা মুসলমান পরিচয় দিয়ে রক্ষা পাইনি। ১৯৭১ সালে যখন পাক হানাদার বাহিনী আঘাত করে এবং ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত যে লড়াই চলে তা ছিল বাঙালি চেতনার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ ভুখন্ডে আমরা যারা বাস করি তাঁরা কেঊ মুসলমান, কেঊ সনাতন ধর্ম কেঊবা খৃষ্টান ধর্ম পালন করি। তবে আমরা সবাই ভাব বিনিময় করতে পারি বাংলা ভাষায়। বাঙালি মানে একটি সংস্কৃতি। বাঙালি একটি সভ্যতা। বাঙালি চেতনা কেবল ভাষা নির্ভর নয়। জাতীয়তা শব্দটির মানে কেবল জাতি থেকে উত্থিত নয়। জাতীয়তা একটি চেতনা যে চেতনা একটি ভুখন্ডের মানুষই নয় যেকোন স্থানে থেকে ধারণ করতে পারে।
আমরা যারা বাংলাদেশের বাসিন্দা তাঁদের নানা ভাষা আছে। তবে আমাদের ভাব বিনিময়ের একটি ধারা আছে যাকে বলা যায় বাঙালিধারা। এই বাঙালি ধারাই আমাদের কৃষ্টি । যারা চাকমা বা যারা গারো তাঁরা সবাই এই ধারাকে অনুসরণ করে। আমি মুসলমান হয়ে যেমন বাঙালিত্ব হারাইনি যেমনটি কোন কোন সমালোচক দাবি করেন, তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে নিয়ে একজন মারমা বা খাসিয়া মানুষ তাঁদের পরিচয় হারায় না। রাষ্ট্র যখন বলছে জাতীয়তা বাঙালি, তখন রাষ্ট্র ২১০০ বছরের আগের বাঙালি চেতনাকে বোঝায় না। রাষ্ট্র ওই চেতনাকে বোঝায় যা আমাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
এই বাঙালিত্ব একটি উপলব্ধি যা ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে। বাঙালি মানে নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত বঞ্চিত ঐ জনগোষ্ঠী যারা মুক্তির সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি নতুন দেশের একটি নতুন পতাকার জম্ম দিয়েছিল। সেদিন যে চেতনায় একজন মারমা বা গারো যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সেটি ছিল বাঙালি চেতনা, বাঙালি যুদ্ধ অবাঙালি বিরুদ্ধে। সেদিন আমরা এক ছিলাম। সেদিন যে চেতনায় আমরা এক হতে পেরেছিলাম তা অবিশুদ্ধ ওই বাঙালি চেতনা নয় যা ২১শ বছর আগে ছিল। বাঙালি এমনই একটি নতুন মৌলিক চেতনা যার নতুন জম্ম ১৯৭১ সালে যা ১৯৭১ সালের আগের চেতনা থেকে পৃথক। এচেতনার অংশীদার বাংলাদেশের সবাই।
বাঙালি মানে একটি জীবনধারা যে ধারায় আমরা রান্না করি, খাই, অভিবাদন জানাই, শিক্ষা দেই, চিকিৎসা প্রদান করি, আনন্দ করি প্রভৃতি। তাই জাতীয়তা বাঙালি বলা মানে যারা বাংলা বলেন না তাঁদেরকে আলাদা করা নয় বা যারা বাংলা বলেন তাঁদের অগ্রাধিকার প্রদান নয়। বরং, বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধকে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, জাতীয় ঐক্যকে নির্দেশ করা। বাঙালি জাতীয়তা মানে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি নয়, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নয়- এ বাঙালি ঐ শ্বাশত বাঙালি যা নতুন প্রজম্মকে যুক্ত করে ভার্তৃত্বের বন্ধনে। এ বাঙালি মানে ‘আমরা বাঙালি’ উপলব্ধি – হোক সে হিন্দু, হোক সে মুসলমান, হোক সে মারমা, হোক সে চাকমা, হোক সে কোচ বা খাসিয়া। বাঙালি মানে আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক।
ড. ফরিদ আহমেদ
অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মেলবোর্ণ, ২রা এপ্রিল ২০১৫।