স্পর্শ
অ
‘সৃষ্টি’ সাহিত্য পরিষদ থেকে বের হওয়ার পথে কবি তাবাসসুম পিছন দিক থেকে আমায় ডাকলো- এরে এখটু ওবাও। থুরা দরখার আছে। আমি পিছনের দিকে তাকাই। আবছা আলোতে কুমকুম আপু ওনার ভ্যানিটি ব্যাগে যেন কী খুঁজছে। তাবাসসুম আপু আমার থেকে বয়সে বড় না হলেও একেবারে ছোট্টটিও নয়। যৌবনের বসন্ত যেন উপচে পড়ছে ওনার দেহের শৈল্পিক ভাঁজে ভাঁজে। সাহিত্য আসরের উনি অনেকটা প্রাণভ্রোমরা। যেমন রূপ তেমনি গুণ। তিনি মূলত মার্কিন অধিবাসী। মাস তিনেকের জন্য দেশে বেড়াতে এসেছেন।
সাহিত্য আসরে উপস্থিত হন বোরকা পড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও উনি বোরকা আনতে দ্বিধাবোধ করতেন না। আপুর বোরকা নিয়ে আমাদের অপার কৌতূহল থাকলেও কখনোই আমরা তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি নি। আজও উনি কালো বোরকা পড়ে এসেছেন। পাঁচশ টাকার একটি নোট আমায় দিয়ে বললেন- আমারে কেজি দুয়েখ মিষ্টি আনিয়া দিতা ফারবায় নি?
-জি অয়। কিজাত মিষ্টি?
-সাদাটা আনিও ।
-জী আইচ্ছা।
টাকা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। কাছেই মিষ্টির দোকান থাকায় মিনিট দশেক পরে ফিরে এলাম। আপু তখন অন্য কবিদের সাথে কথা বলছিলেন। ডিসট্রাব হবে ভেবে আর ওনাকে ডাকলাম না। ঠিক ঐ সময় বাসা থেকে আমার জরুরি কল আসে। আমি তড়িঘড়ি করে বিদায় নেওয়ার জন্য বিথি আপুর কাছে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললাম- তাইনরে দিলাইবা।
-আফনে দেউক্কা না?
-আমার এখটু জলদি বাসাত যাওয়া লাগে… পারবা নি আফনে?
-আইচ্চা
আমি বিদায় নেই।
এর প্রায় সপ্তাহখানেক পর আবারও সাহিত্য আসরে মিলিত হলাম। তাবাসসুম আপুকে দেখেই আমার মিষ্টির হিসাবের কথা মনে পড়ল। পাঁচশ টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। কীভাবে যে এই স্বল্প টাকাগুলো ওনাকে দিব ভেবেই কূল পাচ্ছিলাম না। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ওনার দিকে তাকাই। আপুও তাকান। বোরকা পরিহিত থাকার কারণে শুধু চোখ দুটিই দেখার সৌভাগ্য হল। আপুর চোখ দুটোকে কেন যেন আমার খুব আপন মনে হল। কয়েকশ শতাব্দী ধরে যেন এ চোখ জোড়া আমার পরিচিত! চাহনির ভাঁজে ভাঁজে যেন হীরক জ্যোতির বিচ্ছুরণ! দৃষ্টির আঙিনায় কেবলি মায়াবি আবেশ ছড়িয়ে রাখে।
সাহিত্য আসরের কাজ শেষ হলে বরাবরের মতই তিনি সবার পরে বের হন। আমি একটু আগে বের হলেও বাহিরে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পর তাবাসসুম আপু আসলো। আমি হাতমুঠ করে ওনার হাতে দিয়ে বললাম- আফা, টেখাগুন রাখি দেউক্কা, মিষ্টি কিনিয়া থোরা বেশি অইছিল –
– আরে! আত ছও খিতার লাগি? টেখার মাতাত ধরিয়া দেও।
লজ্জায় আমার যেন তখন মাথা কাটা যাবার মত অবস্থা! আমি কোন সময় ভাবতেও পারি নি, বিষয়টিকে উনি নেতিবাচক হিসেবে দেখবেন। এই অন্ধকারের মধ্যেও আমি প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করলাম। ঘনঘন ঢুক গিলতে লাগলাম। মনে হল গলাও যেন শুকিয়ে আসছে। আমার মনে পড়তে লাগলো ‘বিলাসী’ গল্পের ‘মৃত্যঞ্জয়’ এর অন্ন পাপের কথা। লুচি নয়, সন্দেস নয়, পাঠার মাংস নয়। ভাত খাওয়া যে অন্ন পাপ! তেমনি চুরি নয়, ডাকাতি নয়, ধর্ষণ নয়। এ যে ভিন পুরুষের হাতের ঈষৎ স্পর্শ! এ যে কত বড় গর্হিত অপরাধ সে চিন্তা মাথায় আসতেই মাথা গরম হয়ে ওঠতে থাকে। কিন্তু নিজের ভুল স্বীকারের মধ্যেও যে মহত্ত্ব লুকায়িত সে তত্ত্বটিও আমার অজানা ছিল না। আমি মাথা ঈষৎ নত করে বললাম- Sorry siser. I am extermly sorry.
কথাটি বলেই আমি দ্রুত বিদায় নেই। নানাবিধ দিক চিন্তাভাবনা করে সেদিন রাতে আর ঘুম হল না। কোন বই খুললেও মনোনিবেশ করতে পারি না। কবিতা লিখতে বসলেও যেন দ্রুত শব্দ হারিয়ে যায়। কেমন এক লজ্জার বাতাস যেন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমার নিজের রুমের ভেতরও আমি লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠি। ঘামতে থাকি। ফ্যানের সর্বোচ্চ পাওয়ারেও যেন এ ঘাম মুছার মত নয়! ছটফট করতে করতে নির্ঘুম একটি রাত কেটে যায়।
আ
সকালে ঘুম থেকে উঠে টেবিলের ড্রয়ারের চাবিটি আর খুঁজে পেলাম না। অনেক সার্টফিকেট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি রয়েছে ড্রয়ারে। আজ কয়েকটা এপ্লিকেশন ড্রপ করার শেষ তারিখ। সুতরাং চাবিটা যে কোন মূল্যেই দরকার। বিপদ যখন আসে তখন নাকি সব দিক দিয়েই আসে! আমার কেন যেন মনে হল চাবিটি সেই সাহিত্য আসরে ফেলে এসেছি। সবার আগেই যদি সেখানে যাওয়া যায় তাহলেই হয়ত পাওয়া সম্ভব।
একটু ফ্রেস হয়েই আমি রওয়া দেই। মিনিট দশেকের মধ্যে সেখানে পৌঁছাই। আমি পৌঁছামাত্রই দেখলাম সাহিত্য পরিষদের দারোয়ান এসে হাজির। আমি তাকে বিস্তারিত খুলে বললাম। সে তখন বাহিরের গেট ও রুমের দরজা খুলে দিয়ে বলল- যাউক্কা। নিচের বায়জু এখটু বালা খরি খেয়াল খরবা।
-জি আইচ্চ।
আমি যে চেয়ারে বসে ছিলাম সে চেয়ারের পাশেই দেখলাম একগোছা চাবি পড়ে রয়েছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। চাবিগোছা তুলতেই দেখলাম সে চেয়ারের বিপরীত দিকে ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগের মত কী যেন পড়ে রয়েছে। গতকাল ঐ চেয়ারে অবশ্য তাবাসসুম আপুই বসেছিল। আমার কৌতূহলের মাত্রা বেড়ে গেল। চাবিগোছা প্যান্টের পকেটে ভরে ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে গেলাম। হাত দিয়ে ব্যাগটি ধরার মুহূর্তেই তার গতদিনের ঘটনার কথা মনে হল।
আমার হাত কাঁপতে লাগলো। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। শেষপর্যন্ত ব্যাগটি ধরার সাহস পেলাম না। বের হয়ে দরজার কাছে এলাম। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল- ওখানে যদি মূল্যবান কিছু থাকে এবং এটা যদি অন্য কারও হাতে পড়ে, যদি সে না দেয়…! মুহূতেই আমার শরীর শিউরে ওঠলো। আমি ফিরে গিয়ে ছোট্ট ব্যগটি হাতে নেই। একেবারেই হালকা মনে হল। প্রয়োজনীয় জিনিস আছে কিনা কিংবা ব্যাগটি পরিত্যাক্ত কিনা তা বুঝার জন্য ব্যাগটির চেইন খুললাম। চেইন খুলে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ কপালে ওঠার মত অবস্থা! মনে মনে ভাবলাম, ইস! ব্যাগটি যদি অন্য কারো হাতে পড়ত, তবে ওনার কী বিপদেই না পড়তে হত!
আপুর বাসার ঠিকানা আমার জানা ছিল না, থাকলে হয়ত বাসায়ই যেতে পারতাম। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, সেও কোন প্রকার তথ্য দিতে পারলো না। এদিকে ব্যাংক ড্রাফট করে চাকরির এপ্লিকেশনও ড্রপ করতে হবে। একটু দেরি হলেই ব্যাংকে আবার বেশ লম্বা লাইন ধরতে হয়। সে যে কী বিড়ম্বনা! প্রত্যক্ষ শিকার না হলে বুঝা মুশকিল। বাধ্য হয়ে বাসায় চলে আসলাম।
সাপ্তাহখানিক পর আবারও সন্ধ্যায় সাহিত্য আসরে যোগদান করলাম। আসর তখনও শুরু হয় নি। তাবাসসুম আপু ভিতরে ঠুকবে এমন সময় ক্ষীণস্বরে বললাম- আফা, এখটু দরখার আছিল। যদি এখটু সময় দিতা।
ওনার যেন সময় খুবই কম। মনে হচ্ছিল ট্রেন কিংবা বিমান ছেড়ে দিবে! অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও দাড়ানো আর কি! তাই অন্যদিকে তাকিয়ে খুব তুচ্ছ তাচ্ছিল্লের স্বরে বললেন
– আইচ্ছা কও । শর্টলি খইবায়।
– জি আইচ্চা
আমি ব্যাগটির একপাশে ধরে বাড়িয়ে ধরে বললাম- এই নেওক্কা। আফনে যাওয়ার সময় মনে অয় ফালাইয়্যা গেছলা। এমন সময় আমার মুঠোফোন বেজে ওঠে। আব্বুর ফোন। আমি রিসিব করতেই উনি বললেন- তোমার আম্মার লাগি ওষুদ কিনছ নি বাবা।
-জি না, এখনো কিনছি না। অউ যাইরাম। আফনে চিন্তা খরইন না যে। আমি আইরাম।
আমি তাবাসসুম আপুকে বললাম- আপু Sorry. দেখিলাইন আফনার সবতা ঠিক আছে নি। আপু ব্যাগের চেইন খুলে দ্রুত সব চেক করতে থাকে। তারপর এক মুহূর্তের জন্য চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- Oh! My god. You are really helpful, you are so great.
আমি তার দিকে তাকাই। বৈদ্যুতিক আলোর চেয়েও যেন তখন তার চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছিল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গদগদ কণ্ঠে বললেন- আমার আমেরিকান সিটিজেনশিপ গ্রীন কার্ড, পাসপোর্ট, চাবি যদি তোমার কাছ তাকি না পাইতাম, অর্থাৎ ব্যাগটা যদি আর না পাইতাম তাইলে পরবর্তীতে আমেরিকা যাওয়া আমার লাগি খুব কষ্ট অইত। … তোমার মত মানুষ অয় না। আমার জীবনে দেখা সবচাইতে অনেস্ট মানুষ তুমি। তুমার কাছে চির ঋণী অয়ি গেলাম…।
আপু কাছে এসে। আমার পিঠে হাত বুলায়। মনে হল কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়ে বুঝি জড়িয়েই ধরবে। আমি হাত ছাড়িয়ে দ্রুত পিছনে সরে আসি। মৃদু হেসে বলি- আমারে ছইন না যে! দূর তাকি আশীর্বাদ করুক্কা। … আর বালা থাখবা।
কথাটি বলেই আমি বিদায় নেওয়ার জন্য পা বাড়াই। কিছুদূর গিয়েই আমি পিছনে তাকাই। মেয়েটি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অষ্পষ্ট আলোয় তার সুশ্রী চোখের দিকে তাকিয়ে তখন কেবলি কবিগুরুর সেই বিখ্যাত পংক্তিদ্বয় মনে হতে লাগলো-
“হে সাত কোটি বাঙালির মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করো নি”।