কয়েকবার বলুন, ডাহা মিথ্যেও সত্য হবে!
হঠাত করেই না-কি পরিকল্পনানুযায়ী কি-না জানি না, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে এই নিয়ে আমাদের দুই নেত্রীর মাঝে চলছে বিতর্ক প্রতিযোগিতা। শুরুটা করেছিলেন লন্ডনে বসে তারেক রহমান। কোথা থেকে কোন সূত্রের ভিত্তিতে কে জানে, বলে বসলেন যে, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নাকি জিয়াউর রহমান!!
প্রথমে ভেবেছিলাম বক্তৃতার জোসে হয়ত “স্লিপ অফ টাং” হয়েছে। কিন্তু এ কি! এখন দেখি বিএনপির চেয়ারপারসন খোদ খালেদা জিয়াও একই কথা বলছেন। সেই সাথে চ্যালা চামুন্ডারাও সুর মেলাচ্ছেন।
ব্যাপারখানা আসলে কি? এতদিন তো জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতেই বিএনপি মরিয়া ছিল। যদিও আওয়ামী শিবিরে এই নিয়ে মহা আপত্তি। তবুও একটি সময় সবাই এক রকম মেনেই নিয়েছিল যে, জিয়াউর রহমান-ই কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের কারণেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষক।
তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম যে, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন, কিন্তু এই পাঠে যে মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত ও উজ্জীবিত হয়েছিল সেটা তো অস্বীকার করার নয়। আবার ধরেই নিলাম যে, তিনি স্বাধীনতার ঘোষক নন, তাতেও তো মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান খাটো হয়ে যায় না। তাহলে অহেতুক বিতর্কের মানে কি?
ইতিহাস বলে যে, জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছিলেন। সে ইতিহাস কি তবে ভুল লেখা হয়েছিল? বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন কেন তা ঠিক করা হয় নি? তাহলে কি স্বাধীনতার পর থেকে ২০ এপ্রিল ১৯৭৭ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্রপতি ছিলেন না?
হঠাত জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্য বিএনপি কেন মরিয়া হয়ে উঠেছে তা সত্যি বোধগম্য নয়।
দেশে তো আসলে ইস্যুর অভাব নেই, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক করুন না কেন।
স্বাধীনতার ৪৪ বছরের মাথায় স্বপ্নে পাওয়া মহৌষধের ন্যায় তারেক রহমানের হাতে হঠাত কোন গোপন নথি সিন্দুক থেকে আবিষ্কার হলো কিংবা কোন জাদুবলে জিয়াউর রহমান রাতারাতি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়ে গেল, তা সত্যি বিস্ময়কর।
জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন কি না এই নিয়ে এই প্রজন্মের অনেক আওয়ামীপন্থী সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। কোথা থেকে কি ইতিহাস জেনেছে জানিনা কিন্তু কেউ কেউ খুব জোর দিয়ে দাবি করেন যে, জিয়াউর রহমান নাকি মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না। অথচ নামমাত্র (?) মুক্তিযোদ্ধা ব্যাপারটা খুব বেশি পরিষ্কার না হলেও আওয়ামীলীগের সভাপতি খোদ শেখ হাসিনাও জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বলে স্বীকার করেন।
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ- এই ইতিহাস কি তবে নয়া ইতিহাসবিদ তারেক রহমানের কথায় মিথ্যে হয়ে যাবে?
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কেন শুধু শুধু আমাদের বিভ্রান্ত করছেন? পাঠ্যপুস্তকে কয়েক বছর পর পর মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তিত ইতিহাস পড়তে পড়তে আমরা ক্লান্ত। যে যখন ক্ষমতায় আসে নিজেদের মত করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সাজিয়ে গুছিয়ে দেয় আমাদের। কিন্তু এখন আমরা আর পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে কিংবা দুই নেত্রী ও তাদের সাগরেদদের দেয়া ইতিহাসে বিভ্রান্ত হতে চাইনা।
অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি প্রবাহের এই যুগে আমরা নিজেদের তাগিদেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানছি, আরো জানব। তাই দয়া করে উল্টাপাল্টা বলে নিজেদের কৌতুকে পরিনত করবেন না।
খুব বেশি কিছু তো আমাদের নেই যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমাদের অতীব গর্বের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা আর দুদলের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিনত করতে দেব না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সকলের অমূল্য সম্পদ।
বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবদান যেমন মুছে ফেলা যাবে না, তেমনি সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার অবদানও খাটো করা যাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরাই যুদ্ধ করেছেন, আমরা দল-মত নির্বিশেষে সকলকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। আর স্বাধীনতাবিরোধীদের চরম ঘৃনা করি।
এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কাউকে চাঁদে দেখা গিয়েছে বললেই যেমন জনগণ হজম করে না, তেমনি সপ্তম প্রেসিডেন্টকে প্রথম বললেও তা কখনই প্রতিষ্ঠিত হবে না।
তবুও চেষ্টা করতে চাইলে করতে পারেন। শুনেছিলাম একটি মিথ্যে নাকি শতবার বললে তা সত্য হয়ে যায়। কোনো ভুল তথ্য বারবার দিলে তা সমাজে একসময় মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
কাজেই সবাই মিলে এই মিথ্যেও গলা মিলিয়ে বলতে থাকুন, সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হলেও হতে পারে একদিন। কত শত বছর লাগবে তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই।