বাংলাদেশের নির্বাচনী ফলাফলে আনুপাতিক হার প্রবর্তন

বাংলাদেশের  নির্বাচনী ফলাফলে আনুপাতিক হার প্রবর্তন

বাংলাদেশের নির্বাচনী ফলাফলে আনুপাতিক হার প্রবর্তন

সূচনা ঃ

যৌক্তিক কারনেই আধুনিক জগতে রাজাশাসিত, ধর্মগুরু বা তার প্রতিনিধি শাসিত, সেনা শাসিত সরকারের তুলনায় গনতন্ত্রকে অনেক বেশী ভালো বলে মনে করা হয় ।বাইরের দুনিয়ায় বাংলাদেশের গনতন্ত্রকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, কারন বিশ্বে এইটিই একমাত্র মুসলিম দেশ যেখানে বহুদলীয় গনতন্ত্রের চর্চা আছে । তবে আদর্শ গনতন্ত্রের জন্য সকল মানুষের সমানাধিকার থাকার প্রয়োজন হয় এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা ছাড়া এটি সম্ভব নয় । বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে একটি বিশেষ ধর্মকে রাস্ট্রধর্ম ঘোষনা করার ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হয়েছে । এছাড়াও সঙ্গত কারনেই এদেশের গনতন্ত্রের চর্চাকে উজ্জ্বল বলার কোন কারন নেই । প্রায় ৪২ ( ১৯৭১-২০১৩) বছরের জীবনে এই দেশটিতে প্রায় ১৫ (১৯৭৫-১৯৯০) বছর ছিল সামরিক শাসন অথবা সামরিক শাসকদের ঘোষিত তথাকথিত ‘গনতান্ত্রিক শাসন’ । এই হিসেবে বলা যায়, এই সময়কালে গনতন্ত্র আছে মাত্র ২৭ (১৯৭১-১৯৭৫ ও ১৯৯১-২০১৩) বছর , যার মধ্যে ২২ বছরই আছে ধর্মনিরপেক্ষতাহীন অবস্থায় । এমনকি এই খন্ডিত গনতান্ত্রিক আমলেও এর সাফল্য কার্য্যক্ষেত্রে মানুষ তেমন একটা দেখে নি । এই সরকারেরগুলির ব্যর্থতার কারণ সম্বন্ধে বলা হয়, (১) জনপ্রতিনিধি হিসেবে উপযুক্তঙ্গুন সম্পন্ন লোকের নির্বাচিত না হওয়া এবং (২) আইন প্রনয়নের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে অর্থকরীভাবে লাভজনক কাজ করানো । তাহলেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, উপযুক্ত লোক নির্বাচিত হতে পারছে না কেন ?”

এর সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে – (১) দেশে উপযুক্ত লোক নেই, অথবা (২) উপযুক্ত লোকের নির্বাচিত হবার মতন অবস্থা নেই । আমরা জানি, দ্বিতীয় উত্তরটাই সত্য । এক্ষেত্রে উপযুক্ত লোকেরা কিভাবে নির্বাচিত হবে তার পথ বের করাই হচ্ছে সমস্যার সমাধান । আজ আমরা আলোচনা করব, বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন কি ভাবে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন করতে পারে । এখানে ‘কেয়ার টেকার’ টার্মটি এই কারনে উল্লেখ করা হল যে আমাদের সংবিধানে এই সরকারের রূপরেখা উল্লেখ করা আছে, এই ধরনের সরকারের অধীনে দেশে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এ পর্য্যন্ত বাংলাদেশে দলীয় সরকারগুলির অধীনে (জিয়াউর রহমান, হোসেন মোহাম্মাদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার সরকার) কোন নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় নি ।

আমাদের দেশে এ পর্য্যন্ত (১) ১৯৭৩, (২) ১৯৭৯, (৩) ১৯৮০, (৪) ১৯৮৮, (৫) ১৯৯১, (৬) ১৯৯৪, (৭) ১৯৯৬, (৮) ২০০১ ও (৯) ২০০৬/৮ সালে মোট ৯টি নির্বাচন হয়ে গেছে । এর মধ্যে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ এর নির্বাচন হয়েছে ‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে । আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা ধরে নিয়েছি যে ‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা নিরপেক্ষ হয়ে থাকে । নির্বাচনের পরপরই নির্বাচন কমিশনের সকল তথ্য পুনঃ নীরিক্ষা না করায় এ ব্যাপারে প্রকৃত সত্য জানা সনভব নয় । তবে প্রতিবারেই নির্বাচনের পর বিজয়ী দল মহা উল্লাসে ফল গ্রহন করেন, আর পরাজিত দল ‘কারচুপি, ইঞ্জিনীয়ারিং’ ইত্যাদি নানা অজুহাতে ফল বর্জন করেন । তাদের অসহযোগিতায় বিজয়ী দল সুষ্ঠু ভাবে শাসন কাজ পইচালনা করতে পারে না । আসলে পরাজিত দলের অসন্তুষ্ট হবার ন্যয্য কারন আছে । যেমন, গত নির্বাচনে বর্তমানে আওয়ামী লীগ মাত্র ৫৭% ভোট পেয়ে ২৬৩ সিট, আর বি এন পি ৪২% ভোট পেয়া ৩৩ টি সিট নিয়ে আছে । এটিকে কি কোন ভাবে স্বাভাবিক বলা যায় ? আজকের আলোচনায় কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এই অস্বাভাবিকতার দিকটি আলোচনা করবো ।

আমাদের আলোচনার বিষয় হবে মূলতঃ তিনটি – (০১)‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হয়ে থাকে, (০২) দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হয়ে থাকে এবং (০৩) কি করে ‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে নির্বাচনে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় ।

প্রসঙ্গক্রমে প্রথমেই পপুলার ভোট এবং আনুপাতিক ভোটের বিষয় আলোচনা করা দরকার। পপুলার ভোটে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত ব্যাক্তি নির্বাচিত হন, আর বাকী সব ভোট সঠিক অর্থেই নষ্ট হয়ে যায় । যদিও গনতন্ত্র একটা সম্মিলিত দল বা মোর্চার খেলা, একক কোন প্রার্থীর প্রচেষ্টা এখানে কোন ভূমিকা রাখে না, পপুলার ভোটে কিন্তু প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় শুধুমাত্র স্বতন্ত্রভাবে প্রাপ্ত সর্বাধিক ভোটের দ্বারা, যা গনতন্ত্রের মুল নীতির সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ নয় । জনগন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মাধমে আসলে ভোট দেয় পার্টিকে । পার্টির পরাজিত প্রার্থীর সেই ভোট নষ্ট করে আসলে তাদের পার্টির প্রতি সমর্থনের চিত্রটিই বদলে ফেলা হয় । যেমন – ২০১৩ সালে বি এন পির ৩৩ টি (৩০০ এর) সিট কি এই পার্টির প্রতি ৪২% ভোটারের সমর্থনের চিত্র প্রকাশ করে ? ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের ৬২ টি (৩০০ এর) সিট কি এই পার্টির প্রতি ৪০% ভোটারের সমর্থনের চিত্র প্রকাশ করে ?

(০১)‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হয়েছিল ঃ

আমাদের দেশে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবার অর্থ সবচেয়ে উপযুক্ত লোকটির নির্বাচিত হওয়া নয় । কারন প্রার্থীর যোগ্যতা বিচারে উপযুক্ত যোগ্যতা থাকার কথা বলা হয় না । বরং সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকটির নির্বাচিত হওয়ার কথা হয় । আমরা দেখবো, কেয়ার টেকার সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনে সেটাই বা কতটুকু নিশ্চিত হয় । এই উদ্দেশ্যে আমরা ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৬/৮ সালের নির্বাচনের ফলাফলের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষন করবো । এর মূল ফলাফলগুলি নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে ।

এইসব নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা দলগুলিকে আমরা ৫ টি গ্রুপে ভাগ করেছি । এগুলি হলো (১) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, (২) বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি, (৩) বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, (৪) ছোট ছোট দলগুলি এবং (৫) স্বতন্ত্র প্রার্থীগন । এখন আমরা বিবেচনা করবো, এই পাচটি গ্রুপ এই নির্বাচনগুলিতে কি পরিমান (% হারে) ভোট পেয়েছিল, এই হারে ভোট পেলে আনুপাতিক হারে তাদের কয়টি সিট পাওয়া উচিত ছিল, বাস্তবে তারা কয়টি সিট পেয়েছিল এবং এই সংখ্যা আনুপাতিক হারে প্রাপ্তব্য সিটের সংখ্যার চাইতে কত কম বা বেশী ।

আমরা জানি বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার ভোটার সংখ্যা ভিন্ন রকম, প্রার্থীর সংখ্যাও বিভিন্ন । তাই কোন দল পপুলার ভোটে সর্বমোট যত ভোট পায়, ঠিক সেই হারে সিট পায় না । এই পরিবর্তনকে আমরা বলতে পারি ডেভিয়েশন । ডেভিয়েশন আলাদা হতে পারে, কিন্তু একই দেশে এই ডেভিয়েশনের ট্রেন্ড একই দেশে একই সময়ে মোটামুটি একই রকম বা কাছাকাছি থাকবে । যদি তা না থাকে তবে অবশ্যই কারচুপি হয়েছে বা ইলেকশন ইঞ্জীনিয়ারিং এর সন্দেহ করা যেতে পারে ।

“কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা মোটামুটি নিরপেক্ষ হয়” এ রকম একটা সাধারন ধারনা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে । উপরের চারটি নির্বাচনের ফলাফলের ডেভিয়েশনের ট্রেন্ড বিচার করে আমরা বিচার করবো, এই নিরপেক্ষতার ধারনা কতটুকু গ্রহন যোগ্য ।

কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৪টি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষন ঃ


উপরের ফলাফলে দুইটি দলের (ক) ভোটের হার ও সিট সংখ্যার অস্বাভাবিকতা দেখুন ঃ

(ক-১) ১৯৯১ সনে আওয়ামী লীগ ৩০,১% ভোট = ৮৮ সিট, বি এন পি ৩০,৮% ভোট = ১৪০ সিট ।

(ক-২) ১৯৯৬ সনে আওয়ামী লীগ ৩৭,৪% ভোট = ১৫১ সিট, বি এন পি ৩৩,৬% ভোট = ১১৬ সিট ।

(ক-৩) ২০০১ সনে আওয়ামী লীগ ৪০,০২% ভোট = ৬২ সিট, বি এন পি ৪১,৪% ভোট = ১৯৩ সিট ।

(ক-৪) ২০০৮ সনে আওয়ামী লীগ ৫৭,১% ভোট = ২৬৩ টি সিট, বি এন পি ৪২,৮% ভোট = ৩৩ টি সিট ।

(খ) আনুপাতিক হারের সঙ্গে ডেভিয়েশনের অস্বাভাবিকতা দেখুন ঃ

(খ-১) ১৯৯১ এর নির্বাচনে বিজয়ী বি এন পি ৫২% ধনাত্মক (এবং আ লীগ ২,২% ঋনাত্মক) ডেভিয়েশন পেয়েছে ।

(খ-২) ১৯৯৬ এর নির্বাচনে বিজয়ী আ লীগ ৩৫% ধনাত্মক (এবং বিএনপি ১৩ % ঋনাত্মক) ডেভিয়েশন পেয়েছে ।

(খ-৩) ২০০১ এর নির্বাচনে বিজয়ী বি এন পি ৫৬% ধনাত্মক (এবং আ লীগ ৪৮% ঋনাত্মক) ডেভিয়েশন পেয়েছে ।

(খ-৪) ২০০৮ এর নির্বাচনে বিজয়ী আ লীগ ৫৪% ধনাত্মক (এবং বিএনপি ৭৪% ঋনাত্মক) ডেভিয়েশন পেয়েছে ।

(গ) উপরের ফলাফল দেখে মনে হয়, একজন কেউ গোপন স্থানে বসে একবার বি এন পির সিট কেটে আওয়ামী লীগের সীট বাড়িয়েছে, আবার পরের বার উল্টোটা করেছে । যতই দিন যাচ্ছে, তার সাহসও তত বাড়ছে, কারন ডেভিয়েশনের পরিমান একটু একটু করে বাড়ছে।

(গ-১) ১৯৯১ সালে সে জাতীয় পার্টির সিট তেমন কাটার (৩%) সাহস পায় নি (এর আগেই জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল), আওয়ামী লীগেরও না, সে সিট কেটেছে ছোট ছোট দলের ৫০%, আর স্বতন্ত্রদের ৭৭% । ৫২% ডেভিয়েশন নিয়ে জিতেছে বি এন পি ।

(গ-২) ১৯৯৬ সালে সে বি এনপির সিট তেমন কাটার (১৩%) সাহস পায় নি (এর আগেই বিএনপি ক্ষমতায় ছিল), সে সিট কেটেছে জাতীয় পার্টির ৩৫%, আর ছোট ছোট দলের ৮৫%। ৩৫% ডেভিয়েশন নিয়ে জিতেছে আওয়ামী লীগ ।

(গ-৩) ২০০১ সালে সে দুঃসাহসিক কাজ করেছে । আওয়ামী লীগের সিট কেটেছে ৪৮%, জাতীয় পার্টির ৩৬%, আর স্বতন্ত্রদের ৫০%। ৫৬% ডেভিয়েশন নিয়ে জিতেছে বি এন পি ।

(গ-৪) ২০০৮ সালে আবার সে একই রকম, কিন্তু বিপরীতধর্মী দুঃসাহসিক কাজ করেছে । বি এন পির সিট কেটেছে ৬৭%, স্বতন্ত্রদের ৬০%। ৫৪% ডেভিয়েশন নিয়ে জিতেছে আওয়ামী লীগ ।

নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে আনুপাতিক হার আর প্রাপ্ত সিটের সংখ্যার মধ্যে আমরা যে ডেভিয়েশনের কথা বলছি তার ট্রেন্ড একই থাকবে, কোন দল এবার একটু বেশী পাবে, কোন দল পরের বার একটু বেশী বা কম পাবে । উপরের ফলাফলে দেখা যায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী বা যে সব দলের ক্ষমতা দখলের তেমন কোন আশা নেই, তাদের ডেভিয়েশন সব সময় ঋনাত্মক।

এবারে ভোট কারচুপি আর সিট কারচুপি সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক । ভোট কারচুপি তো অনেক রকম হতে পারে – যেমন জাল ভোট, আগেই বাক্স ভরে রাখা, বাক্স ছিন্তাই করে আবার ফেরত দেয়া, ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে যেতে না দেয়া বা ভয় দেখিয়ে ভোট আদায় করা ইত্যাদি। আর উপরে যে সিট কারচুপির কথা বলা হয়েছে তা করা হতে পারে নির্বাচনী অফিসে । সেখানে নানা স্থান থেকে ফলাফল আসছে । শেষ দিকে দেখা গেল একজন প্রার্থীর ভোট সংখ্যা (ধরা যাক) ২০০০ বাড়িয়ে দিলেই সে জিতে যাবে । সাধারনতঃ স্বতন্ত্র বা ছোট দলের তেমন প্রভাব থাকে না, বড় দলের থাকে, তাই তাদের থেকে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীদেরকে কিছু ভোট যোগ করে দিলেই তারা জিতে যাবে । ডেভিয়েশনের ট্রেন্ড স্বাভাবিক হলে মাঝে মাঝে স্বতন্ত্রদেরও ভোটের হারের তুলনায় সিট সংখ্যা বেশী হত । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মনে হয় কেয়ার টেকার সরকারের সময়েও নির্বাচন কমিশনের উপর দুটি দলের একেক সময় একেকটির প্রভাব থাকে । যাই হোক, কিছু সিট হের ফের করা হলেই ফলাফল আনুপাতিক হারের থেকে দূরে চলে যাবে এবং তাতে এ ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে । এই কাজ কারা কি ভাবে করে আমাদের জানা নেই । কিন্তু নির্বাচন কমিশনের দেয়া ফলাফল থেকে এই কাজ চলে বলেই মনে হয়।

(০২) দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হয়েছিল ঃ

বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল পাঁচটি- (০১) ১৯৭৩ সালে, (০২) ১৯৭৯ সালে, (০৩) ১৯৮০ সালে,(০৪) ১৯৮৮ সালে,(০৫) ১৯৯৪ সালে ।

উপরের একই পদ্ধতিতে আমরা এই নির্বাচনগুলির ফলাফল বিশ্লেষন করব ।

দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৫টি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষন ঃ

দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোন আলোচনা না করাই উচিত । বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা এখন পর্য্যন্ত এই ধরনের নির্বাচন করার মতন চারিত্রিক বল বা উদারতার দেখাতে পারেন নি । নেতারা এখন পর্য্যন্ত তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের মসনদে বসিয়ে সুখে চোখ বোজার সুলতানী মুঘলী স্বপ্নে বিভোর ।

(০৩) কি করে নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যায় ঃ

বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব একমাত্র এবং কেবলমাত্র কেয়ার টেকার সরকারের মাধ্যমে । তবে এদেশে এই ধরনের সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলে এমন মাত্রার ডেভিয়েশন থাকে যে প্রায় সকল ক্ষেত্রে পরাজিত দল কারচুপির অভিযোগ করে তা গ্রহন করতে রাজী হয় না । এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অসন্তোষ লেগেই থাগে । এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার যে, আমাদের দেশে মনে হয় নির্বাচন কমিশন মনে করে যে নির্বাচন হয়ে গেলেই তাদের দায়ীত্ব শেষ । এটা না করে তাদের উচিত হবে, ভোটের সব হিসাব বুঝিয়ে তার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা । উপরে সীট কাটার যে কথা বলা হয়েছে, তা কাল্পনিক না সত্য ভোট পুনঃ নীরিক্ষা করলেই কিন্তু তা ধরা পড়তো । আর তেমন ব্যবস্থা থাকলে কেউ প্রতারনার চেষ্টা করতো না । এটা স্বাভাবিক যে বিজয়ী দল যেহেতু সুবিধাভোগী ( যেমন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ মাত্র ৫৭% ভোট পেয়ে তারা ৮৭% সিটের সুবিধা ভোগ করছে) তাই তারা পুনঃ নীরিক্ষার ব্যপারে আগ্রহী হয় না ।

বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন নিরপেক্ষ করা, নির্বাচনের ফল সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য করা এবং নির্বাচনের উপর কারো অনাস্থা হতে পারে এমন কারনগুলি দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিভিন্ন দল, মোর্চা বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের উপর নির্ভর করে বিজয়ী নির্ধারন করা।

কিভাবে এটি করা যায় এখন আমরা তাই আলোচনা করবো । কম্পিউটারের এই সহজলভ্যতার যুগে এই কাজটি অত্যন্ত সোজা । এটি করার জন্য সাধারন ভাবে যা যা করতে হবে আমরা তা বর্ননা করছি ।

(১) গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন হবে দল বা মোর্চা ভিত্তিক । দল বা মোর্চার পরিচয় হলো তারা নির্বাচনে একটি সাধারন মেনিফেস্টো বাস্তুবায়নের অঙ্গীকার করবেন । যারা মোর্চা গঠন করবেন তারা নিজেরা এর পরিচালক থাকবেন এবং নিজেরা নির্বাচনে অংশগ্রহন করবেন না, দলের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয় । দল বা মোর্চা তাদের মেনিফেস্টোতে বিশ্বাসী এমন উপযুক্ত প্রার্থীকে তাদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষনা করবেন । নির্বাচিত কোন প্রার্থী দল বা মোর্চা ত্যাগ করলে তার সদস্যপদ হারাবে । নির্বাচন কমিশন প্রার্থীকে উপযুক্ত ঘোষনা করার পর দল বা মোর্চা উপযুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে প্রার্থী ঘোষনা করবেন । কোন দল বা মোর্চা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃতি পেতে হলে তাদেরকে মোট সিটের (আমাদের দেশে ৩০০) এক পঞ্চমাংশ সিটে প্রার্থী দিতে হবে ।

(২) দল বা মোর্চার সমর্থন না পেলে বা অন্য কোন কারনে কোন উপযুক্ত প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রারথী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারবেন ।

(৩) জাতীয় নির্বাচনে দল বা মোর্চার সর্বোচ্চ সংখ্যা হবে পাঁচ, আর কোন সিটে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন সর্বোচ্চ দশ জন । এর ফলে সর্বোচ্চ ১৫টি মার্কা সহ কেন্দ্রীয় ভাবে সব রকম নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ব্যালট পেপার মুদ্রন করা সম্ভব হবে । দল ও মোর্চার মার্কা নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় ভাবে নির্ধারন করে দেবেন । আর স্বতন্ত্রদের মার্কা স্থানীয়ভাবে নির্ধারিত হবে ।

(৪) ভিড় এড়ানোর জন্য প্রয়োজনে পর পর দুইদিন ভোট গ্রহন করা হবে এবং সম্পুর্ন ভোট ভিডিও ক্যামেরায় রেকর্ড করা হবে । কোন কেন্দ্রে বিন্দুমাত্র সন্দেহজনক কিছু দেখা গেলে সেই কেন্দ্রের ফল বাতিল করে নতুন করে ভোট গ্রহন করা হবে ।

(৫) ভোট গননার সময় বিভিন্ন মার্কার ভোট আলাদা আলাদা বাক্সে রাখা হবে এবং ক্রমিক নম্বর ও স্বাক্ষর দিয়ে প্রতি ১০০ এর বান্ডিল করে রাখা হবে, যাতে পরে তা নীরিক্ষা করা যায় ।

(৬) নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দল, মোর্চা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর (সকল স্বতন্ত্র প্রার্থীকে এক সাথে ধরে) মোট ভোট, শতকরা হার এবং এই হার অনুযায়ী আনুপাতিক নিয়মে প্রাপ্ত সিটের সংখ্যা ঘোষনা করবেন । একই সঙ্গে তারা প্রতিটি দল, মোর্চা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোটের % হার প্রকাশ করবেন । এর পর তারা প্রতিটি গ্রুপ থেকে সর্বোচ্চ শতকরা হারে পাওয়া ভোটের ভিত্তিতে বিজয়ী প্রার্থীদের নাম ঘোষনা করবেন ।

এই পদ্ধতির দুটি প্রধান সুবিধা হল, (ক) ভোট একেবারে শেষ না হবার আগে কেউ ফলাফল জানতে পারবে না । তাই কোন বিশেষ কেন্দ্রে কাউকে দুটি বাক্স ভলে দিলেই যে সে নির্বাচিত হবে এমন কোন গ্যারান্টী থাকবে না । যেসব কারনে আমাদের দেশে ভোটের সময় স্বাভাবিক উত্তেজনা এবং তা থেকে নানা অপরাধ হয় (যেমন, আমাদের প্রার্থী নির্বাচিত হলেই আমি ঠিকাদারী কাজটা পাব, অনেক টাকা ঢেলেছি- উনি না জিতলে তো সব গেল, ইত্যাদি) এইগুলির কোনটিই এই পদ্ধতিতে থাকবে না ।

(খ) এই পদ্ধতিতে প্রার্থীকে শুধু নিজের জন্য কাজ করলে চলবে না, বরং দল বা মোর্চাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করতে হবে । আসলে এই দল বা মোর্চাকে জনপ্রিয় করার মধ্যেই রয়েছে গনতন্ত্রের সফলতার মূল কথা ।

উপসংহার ঃ

বাংলাদেশের মানুষ বড় দুঃখী । পাকিস্তানীদের হাতে তারা শোষিত হয়েছে দীর্ঘ ২৪ (১৯৪৭-১৯৭১) বৎসর । বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যারা পেরেছে তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে, পঙ্গু হয়ে বেঁচে রয়েছে । যারা সে সুযোগ পায় নি তারা পাকিস্তানীদের হাতে চরম ভাবে নিগৃহীত হয়ে প্রান দিয়েছে । দেশ স্বাধীন হবার পর আজ তারা দেখে, দেশের সার্বিক প্রশাসন পরিচালনার কল কাঠি যাদের হাতে সেই সব রাজনীতিকরা সর্ব ক্ষেত্র ব্যর্থ । দেশের একটি শাসনতন্ত্র আছে, এই শাসনতন্ত্রে তাদের অধিকার দেয়া হয়েছে অযোগ্য লোকদের সরিয়ে তাদের পছন্দের লোকদের ক্ষমতায় বসানোর । কিন্তু নির্বাচক প্রকৃয়ায় কিছু ত্রুটি থাকায় নির্বাচন বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে । এ অবস্থায় এ পদ্ধতি সংশোধন করার তাদের অধিকার আছে । আমরা দেখেছি, কেয়ার টেকার সরকার পদ্ধতি এদেশের জন্য উপযুক্ত । তবে কিছু সঙ্গত কারনে এই পদ্ধতিটিও কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করে । এই বিতর্ক দূর করার একটি উপায় এখানে বর্ননা করা হয়েছে ।

বর্তমানে যে ক্ষমতাসীন সরকার আছে তারাও কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচিত হয়ে এসেছে । তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে কোথাও এই নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের কথা ছিল না । এক কথায় বলা যায়, এদেশের মানুষ তাদেরকে এই পদ্ধতি বদলের অধিকার দেয় নাই । তা স্বত্তেও তারা যদি চিরস্থায়ী বা বংশানুক্রমিক ভাবে ক্ষমতা দখল করার জন্য কোন পরিবর্তন এনে থাকে সেটা তাদের নিজের দায়িত্ব । তাদের নিজেদেরকেই আবার তা সংশোধন করে দিয়ে যেতে হবে । তাদের ভুলের জন্য সাধারণ মানুষের যদি প্রাণ যায়, তারা যদি কষ্ট ভোগ করে থাকে সে জন্য সৌজন্যের খাতিরে দুঃখ প্রকাশ করাও তাদের উচিত হবে ।

শেষ

বিজন বিহারী শর্মা, অধ্যাপক স্থাপত্য বিভাগ, আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালায়, ঢাকা ।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment